লেখার নাম :- চট্টগ্রামে গোলাম আজমের প্রকাশ্য সম্মেলন ও আমাদের প্রতিরোধ
লেখকের নাম :- মনিটর
প্রকাশের তাং :- ২০০৭-১২-০৫ ১৭:১৭:৫২
বিস্তারিত :-
২৪ জুলাই ১৯৯৪। চট্টগ্রামে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে আমরা সবাই একত্রিত। আমরা মানে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-জাসদ-বাসদ-ইউনিয়ন এবং ছাত্রদলের একাংশ সম্ভবত নোমান গ্রুপ)। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি গোলাম আজমকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে চট্টগ্রামে। আমাদের উপর দায়িত্ব - যে কোনো মূল্যে গোলাম আজম তথা জামাত-শিবির গং-এর সম্মেলন ঠেকাতে হবে। আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই তখন ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষের ছাত্র। কেউ কেউ পাশ করে ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র। সেদিন আমাদের একটি মাত্র স্বপ্ন ছিল - গোলাম আজমকে রুখতে হবে।
২৪ জুলাই থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে চোরাগোপ্তা হামলাসহ গণ্ডগোলা শুরু হয়ে গেছে। আমরা শিবিরের ছেলেদের যেখানে পাচ্ছি মারছি, ওরাও আমাদের ছেলেদের যেখানে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এই গন্ডগোল চূড়ান্ত রূপ নেয় ২৬ জুলাই ১৯৯৪। সেই কালো দিন - নাগরিকত্ব্ পাওয়ার পর এই প্রথম প্রকাশ্যে গোলাম আজমের সমাবেশ। আয়োজনে জামাত-শিবির গং।
২৬ জুলাই সকাল থেকেই নগরীর শহীদ মিনার চত্ত্বর, নিউমার্কেট এলাকা, লালদীঘির পাড়, পুরাতন বিমান বন্দর এলাকা, কোতোয়ালীর মোড়সহ চকবাজার এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। আমরা সংকল্পবদ্ধ কোনোভাবেই এদের (জামাত-শিবির) জড়ো হতে দিব না। কিন্তু পুলিশ-বিডিআর তথা তৎকালীন বিএনপি সরকারের ছত্রছায়ায় তারা শেষ পর্যন্ত একটা মোটামুটি সংখ্যায় জমায়েত করতে সফল হলো। যদিও এই সফলতা তারা শেষ পর্যন্ত আমরা ধরে রাখতে দিইনি।
বেলা প্রায় ৩টা। গোলাম আজম জনসভায় হাজির। আমরা আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না, ফায়ার ওপেন করলাম। যতো দ্রুত সম্ভব স্টেজের কাছাকাছি যেতে যেন আমাদের নিশানা মিস না হয়। কিন্তু ততোক্ষণে দাড়িওয়ালা তরুণ-যুবক জামাত-শিবির কর্মীরা গোলাম আজমকে ঘিরে ফেলেছে চতুর্দিক থেকে। আমার মনে হচ্ছিল ওই নাপাক কুকুরকে ওরা সবাই মিলে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
আমরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমরা লালদীঘিতে, আরেক গ্রুপ শহীদ মিনার থেকে বিমান অফিস এলাকায়, আরেকটা কোতোয়ালী, আরেকটা আন্দরকিল্লা এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে। শিবিরের ক্যাডার বাহিনীর অবস্থানও মূলত বিমান অফিস-লালদীঘি-আন্দরকিল্লা-চকবাজার এলাকা। চট্টগ্রাম ও মহসীন কলেজ তাদের ব্যারাক (উল্লেখ্য আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র, জানি না পরীক্ষা দেব কি করে)। আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। লালদীঘি থেকে কোতোয়ালী-নিউমার্কেট এলাকা আমাদের দখলে পুরোপুরি। চতুর্দিক থেক সবকিছু ছাপিয়ে মুহুর্মুহু শ্লোগান - ''জয় বাংলা'' আর ''দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই কর।''
প্রকম্পিত চট্টগ্রাম - প্রকম্পিত আমরা। এরই মাঝে মাইকে শিবির কুত্তাগুলোর ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে - ''মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী।''
কিন্তু ওরা গলা ফাটিয়ে খুব সুবিধা করতে পারছে না। ফায়ার ওপেন হয়ে গেছে। ততোক্ষণে পুলিশ-বিডিআর-শিবিরের জানোয়ারগুলোও ফায়ার করছে। পুরো এলাকা রণক্ষেত্র।
আমরা আমাদের পিছন দিক আর ডানদিক থেকে নতুন করে আক্রান্ত হলাম। আমাদের একটা অংশ হতভম্বতা কাটিয়ে উঠে পুলিশ-বিডিআরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। আমরা তখন কেউ কেউ ক্রলিং করে, কখনো নিচু হয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়তে চাইছি শিবিরের জমায়েতের ভিতর। উদ্দেশ্য যতো দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে স্টেজের কাছে, গোলাম আজমকে প্রাণে মেরে ফেলতে হবে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম শিবিরে কর্মীরা সংখ্যায় আরো বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে বিডিআর সমানে গুলি করছে। তাদের আড়াল থেকে ও ডানদিক থেকে শিবিরের ক্যাডাররাও গুলি চালাচ্ছে। পূর্ব প্ল্যান অনুযায়ী আমি আশা করেছিলাম পেছন থেকে (কোতোয়ালীর দিক থেকে) সাপোর্ট পাব, কিন্তু কারোরই দেখা নেই। আমাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেল। ডেসপ্যারেটলী আমরা বিডিআর-শিবিরের ব্যুহ ভাঙার চেষ্টা করলাম। এই অবস্থার মধ্যে থেকেও আমি দেখতে পারলাম শিবিরের কুত্তাগুলো গোলাম আজমকে আরো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। আমার যে বন্ধুটির হাতে লঙ্গরেঞ্জের রাইফেল ছিল, দেখলাম ও মাথা ঠান্ডা রেখে রাইফেলের নলটা ঘুরাল গোলাম আজমের দিকে। ও আমাদের বেস্ট শ্যুটার। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম নিশানা যেন মিস না হয়। ও গুলি করল ...
দিনটা আমাদের ছিল না। নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট, গোলাম আজমকে ঘিরে রাখা জটলার বাম পাশের কারো গায়ে গুলিটা লাগল। আমি চিৎকার করে বললাম, ফায়ার চালিয়ে যা। কিন্তু ততোক্ষণে বন্ধুটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, আমাদের বেস্ট শ্যুটার মাটিয়ে শুয়ে আছে। কিছু সময়ের জন্য আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। সম্বিৎ ফিরে পেতেই এগিয়ে গেলাম টার্গটের দিকে। আমার হাতে ছিল একটা নাইনএমএম। কিন্তু ততোক্ষণে কুত্তা গোলাম আজমকে আরো নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে জামাত-শিবির জটলা। দমাদম গুলি করতে থাকলাম জটলায়। দিব্য দেখতে পেলাম পটাপট ৩/৪ জন কীট খসে পড়ল জটলা থেকে।
মিশন সাকসেস হলো না দেখে আমরা দ্রুত পিছু হটি। শুয়ে থাকা বন্ধুর কাছে যাই। এখনো মারা যায়নি, পায়ে ও কোমরে গুলি লেগেছে। ধরাধরি করে এগোতে থাকলাম কোতোয়ালীর দিকে। এখন আমাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়াল বিডিআর। ওরাও ছাড়ছে না, আমরাও ছাড়ছি না। কিন্তু এরই মাঝে বেরিয়ে যেতে হবে। এরই মাঝে খবর পেলাম আমাদের আরেক বন্ধু সিটি কলেজের ছাত্রলীগের মণি বিডিআরের গুলিতে নিউমার্কেটে মারা গেছে।
[][][][][][][][][][]
আজ এতোগুলো বছর পরে এই ঘটনাকে মিনিংলেস বলেই মনে হচ্ছে। কোনোরূপ স্বার্থ ছাড়া কয়েকজন উঠতি তরুণ শপথ নিয়েছিল, ''প্রাণ যায় যাক, গোলাম আজমকে মেরেই মরব।''
প্রায় সুইসাইড স্কোয়াডের মতো এই গ্রুপের ওইদিনের কাজকর্মকে আজ এতো বছর পরে কোনোভাবেই গ্লোরিফাই করতে পারি না। এখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আমাদের ধর্ষিতা মা-বোনদের জঠরে আর আমাদের ভাইয়ের কবরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে। এখন কেন জানি মনে হয় ওইদিনের 'জয় বাংলা' ধ্বনি আমার রক্তকে আগের মতো আন্দোলিত করে না।
তারপরও কখনো কখনো, থেকে থেকে, ভেতরে ভেতরে গর্জে উঠি। আরেকবার, শুধু আরেকবার যদি ২৬ জুলাই ৯৪ ফিরে আসত ; এবার আর তাহলে ওই কুত্তার বাচ্চা গোলাম আজমকে ফিরে যেতে দিতাম না।
http://www.somewhereinblog.net/blog/TMSblog/28749937