
চার বছর। শুনতে কেমন অল্প লাগে। কিন্তু আমি তো জানি এই চারটি বছর আমার কাছে কত দীর্ঘ। কতোদিন কতোদিন তোমায় দেখিনা মাগো। শুনিনা তোমার কন্ঠস্বর। সেই যে ২০০৬ এ জুলাই মাসে হঠাৎ করে ফোনে বললে, “তুই আসবি না মা? আমি কি শেষ দেখা তোকে দেখবোনা”? কিন্তু এর মাস ছয়েক আগেই তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো। তবুও তুমি এভাবে কেন বলেছিলে মা? তখন তো তুমি এমন অসুস্থও ছিলে না। তোমার কথায় ছুটে গিয়েছিলাম। সাত দিন পরেই রোজা শুরু হবে হবে এ অজুহাতে চলে এসেছিলাম। তুমি কত করে বললে কয়েকটি রোজা তোমার সাথে কাটিয়ে আসতে। শুনিনি তোমার কথা। স্বার্থপরের মত নিজের সংসারের টানে চলে এসেছিলাম। যাদের জন্য আমার সেই স্বার্থপরতা, যাদের জন্য বিয়ের পর একটি ঈদও তোমার সাথে না কাটানো সেই তারা তো আজ আমার পাশে নেই মা। সবাই নিজের নিজের ক্ষেত্রে ভিষন ব্যাস্ত। বেশ হয়েছে। এমন স্বার্থপরের এই তো পাওয়া উচিত।
আনন্দ উৎসবে তোমার পাশে না থাকলেও তোমার অসুস্থতায় আমি কিন্তু সব সময় তোমার পাশে থেকেছি। এটা কিন্তু তোমায় স্বীকার করতেই হবে মা। নেফ্রাটাইসের চিকিৎসার সময় বারডেমে, ক্যান্সারের কেমোথেরাপির সময় ক্লিনিকে, অন্যান্য সময় সিএমএইচ এ। তুমি জানতে চরম স্বার্থপর হলেও তোমার কষ্টের মুহুর্তে আমি ঠিকই ছুটে আসবো। থাকবো তোমার পাশে। শেষের দেড়টা মাস আমি তোমার পাশে ছিলাম। একটুও নিজের সংসারের কথা ভাবিনি। তাতে কিইবা লাভ হলো? তুমিই তো কেমন স্বার্থপরের মত আমাদের ফেলে চলে গেলে। একবারও ভাবলে না, তোমাকে ছাড়া বাবা কি ভাবে থাকবেন। তুমি না সবসময় উনার কথা চিন্তা করতে? বলতে “আমি না থাকলে এই একরোখা মানুষটা কি করে চলবে? তোমাকে ঘিরেই যে তাঁর দিন-রাত্রি আবর্তিত হত। তুমি যখন আইসিইউতে তখন তোমার বিয়ের ৫০ বছর পুর্তি হলো। বাবা একরাশ ফুল নিয়ে তোমার বিছানার পাশে রাখলেন একটু ক্ষনের জন্য। তোমার পান্ডুর মুখে একচিলতে হাসি দেখার জন্য। তুমি কি তখন জানতে আর ক’দিন পরেই তুমি একা একা চলে যাবে না ফেরার দেশে?
আগে মনে চাঁপা দুঃখ ছিলো, ভাবতাম, তোমার যত ভালোবাসা সবটুকুই ভাইয়া আর ছোটবোনের জন্য। মাঝখানে আমি বড় অবহেলিত, বঞ্চিত। এখন বুঝি, মা তার কোন সন্তানকেই অবহেলা, বঞ্চিত করতে পারেন না। তোমার মনের মাঝে সব সময়ই এই জেদি, একরোখা মেয়েটির জন্য এক সমুদ্র ভালবাসা ছিলো। সিস্টারদের কাছে শুনেছি, রাতে যখনই তোমার চেতনা হতো তুমি আমার নাম ধরে ডাকতে। কেন ডাকতে মা? কিছু কি বলতে চেয়েছিলে তুমি? নাকি মনের ভুলে যেমন তুমি সব সময় আমাদের এক জনকে ডাকতে গিয়ে অনুপস্থিত অন্য জনকে ডাকতে তেমনি ডেকেছিলে?
অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করেছ। যখনই জিজ্ঞাসা করেছি, “মা তোমার কি কষ্ট হচ্ছে”? তুমি মানা করতে। হঠাৎ করে চোখ মেলে প্রশ্ন করতে “খেয়েছ? আহা! তোমাদের কত কষ্ট হচ্ছে”। নিজের কষ্ট অগ্রাহ্য করে সন্তানের সামান্য কষ্টে আকুল হতে আর কে পারে তুমি ছাড়া?
সভা-সমিতির কোন কাজে ঢাকা গিয়েও যখন তোমার সাথে দেখা না করে ফিরেছি, তুমি একটুকু রাগ করনি। কত খুশী হতে তুমি আমার ওসব কাজে। কবে কোথায় আমার লেখা পড়ে তুমি সব সময় আমায় তাগাদা দিতে লেখার জন্য। বলতে, “তুই অনেক ভালো লিখিস। দেখিস একদিন অনেকেই তোর লেখার প্রশংসা করবে। আহা! মা, আমি আজ ব্লগে লিখি। তুমি দেখলে না। অনেকেই তোমার মতই আমার লেখা পছন্দ করে, আমাকে ভালবাসে। তুমি কি তা দেখতে পাও মা?
তোমার কত সাধের বাড়ি আশ্রয়। আজ সেখানে অন্য লোকের বাস। তুমিহীনা ও বাড়িতে বাবা কি করে থাকেন? তবুও তোমার কথা ভেবে মাঝে মাঝে ঘুরে আসি সেখানে। তোমার গাছগুলো কত বড় হয়েছে। বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারিনা। সব জায়গায় তো তোমার স্মৃতি। এখনও নাকি মাছওয়ালা নিতাই তোমার কথা বলে। শীতে আর খেজুরের রস খাওয়া হয়না। খাওয়া হয়না দুধ চিতুই। তোমার আদরের ছেলে এখন অনেক ভালো আছে, সুখে আছে। থাকবেই তো, তুমি তার জন্য এতো দোয়া করতে। তোমার দোয়া মাথায় নিয়ে সে কি খারাপ থাকতে পারে?
তোমার ছোটমেয়েটা এখনও তোমার জন্য মন খারাপ করে বসে থাকে। আর আমি? প্রতি রাতে অদৃশ্য তোমার সাথে কথা বলি। তুমি কি শুনতে পাও মাগো? মৃত্যুকে এতো কাছ থেকে দেখার পর, তোমার সেই প্রশান্তি মাখা মুখ দেখার পর থেকে মৃত্যুকে আর ভয় হয়না। মনে হয় মৃত্যুই সত্য, মৃত্যুই সুন্দর। আর সে সুন্দর সত্যর মাঝে কবে তোমায় পাশে পাবো সে অপেক্ষায় আছি। “তোমায় অনেক অনেক ভালবাসি মা”।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২০