সে রাতে উত্তেজনায় একটুও ঘুম হয়নি আমার, ভোররাতে চন্দন ভাইয়ের ফোন- ঢাকা থেকে আসা টিম বাস অলংকার মোড়ে, আমি যেন মুরাদপুর চলে আসি। বাসা থেকে রাস্তায় নেমে আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, একটা কোন রকম বাহন দূরে থাক কোন মানুষ ও চোখে পড়ছেনা। অবশেষে একটা সিএনজি অটো ধরে মুরাদপুর পৌঁছেই দেখি আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন, এতটুক পথ এসে আমি একজন সবাইকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি বলে নিজের উপর রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছিল। বাসে উঠতেই খুব পরিচিত সৌম্য ভাই, রাব্বি ভাই, রাহাত ভাই, তারেক ভাইদের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়।সোটামুটি সকাল সকাল আমরা বান্দরবান শহরে পৌঁছে যাই। এরপর হেঁটে কাইক্ষ্যংঝিরি যাওয়ার জিপ(চান্দের গাড়ি) স্টেসনে পৌঁছি। অনিচ্ছা সত্বেও জিপের ভেতরে বসে আঙ্গুলের কড়ে সময় গুনছিলাম কবে শেষ হবে বিরক্তিকর একচল্লিশ কিলোমিটার পথ।শেষে আর না পেরে "Y" জংশনে এসে জিপের পেছনেই দাঁড়িয়ে পড়ি। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, পাশে কয়েকশ ফুট খাদ, আর আমার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। মনে হচ্ছিল জিপের পেছনে দাঁড়িয়েই আমি ঘুমিয়ে যাবো। জিপের ছাদে যারা ছিলেন তাদের গান শুনেই বোঝা যাচ্ছিল তারা বেশ মজা করছে। এভাবে একসময় কাইক্ষ্যংঝিরি চলে আসি, এরপর ট্রলারে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পথে আর্মি ক্যাম্পে একবার আমাদের থামতে হয়, রুমা বাজারে পৌঁছে মামুনের হোটেলে দুপুরের খাওয়া পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর আমাদের আসল কাজ শুরু হয়।
মনা ভাই আর টুটু ভাই আমাদের সবাইকে ট্রেকিং এর ড্রেস করে নিতে বলে আর্মি ক্যাম্পে আমাদের সবার তথ্য জমা রেখে ট্রেকিং এর অনুমতি নিয়ে আসেন। এবার শুরু হাঁটা, তখন দুপুর দু'টো বাজে। লাইরাম্পি পাড়ার প্রথম পাহাড় বেয়ে উঠতেই আমার জান বাহির হওয়ার জোগাড়, চিন্তা করছিলাম এই শুরুতেই যদি টায়ার্ড হয়ে যাই তাহলে দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দিব? ঐ পাহাড় থেকে নেমেই ঝিড়ি মেলে, সে ঝিরি পথেই আমাদের যেতে হবে বগা লেক। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথম জোঁকের কামড়টা খাই, সাথে ব্যাগ খুলে লবণ নিতে গিয়ে বোনাস হিসেবে মেলে দলনেতা টুটু ভাইয়ের ঝাড়ি। তারপরও ওনার অগোচরে আমরা যাত্রাপথের ছবি তুলতে থাকি, যেন সেসব অসাধারণ মুহুর্তগুলোকে ফ্রেমে বেঁধে রাখার একটা ব্যার্থ চেষ্টা।
চমৎকার ঝিরি পথে নুড়ি পাথরের উপরে হাঁটতে কেমন লাগে সেটা তারাই শুধু বুঝবে যারা বর্ষায় ভরা ঝিরি পথে ট্রেকিং করেছেন। এভাবে ক্লান্তিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বগামুখপাড়া চলে আসি, সেখানে আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি আগেই ঠিক করা ছিল। চা বিস্কুট খেয়ে আবারও আমরা পথ হাঁটা শুরু করি। টুটু ভাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আরও অর্ধেক পথ যেতে হবে, আঁধার হয়ে গেলে তখন পথ চলা খুব কষ্টকর হয়ে পড়বে। তার আশংকার কথা শুনে আমাদের পায়ের জোড় বেড়ে যায়। ঝিড়ির সুমধুর কলকল ধ্বনি আমার কানে সফট মিউজিক হয়ে ছিল প্রায় পুরোটা পথ। একসময় ঝিরি শেষ হয় এবং সেখান থেকেই একনাগাড়ে বিপদজনক খাড়া ঢাল বেয়ে আমাদের বগালেক পৌঁছাতে হবে ভবতেই কেমন যেন একটা ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিল।
সে পথ আর শেষই হতে যায়না যেন, খুব খাড়া তার সাথে আছে গিরিখাদ, এক ফুট এদিক ওদিক পা ফেললেই সোজা জান্নাতে! পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের আনাগোনা খালি চোখে না দেখলে মনে হয় আমার জীবনটাই বৃথা যেত। তখন প্রায় আঁধার জেঁকে বসেছে, সবার কাছে টর্চলাইট। খুব সাবধানে পা ফেলছি আসরা। একটা জায়গায় পাথুরে ঝর্ণা বিপদজনক বাকে নেমে গেছে, পার হোয়ার সময় পিছলা খেলেই সোজা পরপারে। রিস্ক না নিয়ে সেটা দড়ি বেঁধে সবাই পার হয়ে আসি। নিচে মুরংপাড়ায় কুকুরের হাঁক শুনতে শুনতে অন্ধকার রাতে নিজেকে কোন থ্রিলার ছবির নায়কের মত লাগতেছিল। এর অল্পক্ষণ পরেই আমরা বগালেক দেখতে পাই, সমূদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১২১০ ফিট উপরের প্রাকৃতিক লেক। বগালেকের পাড় ঘুরে আমরা বম পাড়ায় এসে পৌঁছি, ব্যাগপ্যাক রেখে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঝাপিয়ে পড়ি স্বপ্নের বগা লেকে।