বই পর্যালোচনাঃ অভ্যাসের শক্তিঃ পর্ব ৫
Book Review: Power of Habit-Part Two -Chapter Four: Keystone Habits or The Ballad of Paul O’Neill
একটি মুল অভ্যাস বদলিয়ে অনেক বড় পরিবর্তন আনা যায়ঃ পল ও’নেইল এর যুগান্তকারী উদাহরন
আগের তিন অধ্যায়ে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ের অভ্যাস নিয়ে কথা বলেছি। এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে যে একটি প্রতিষ্ঠানে কিভাবে এই অভ্যাস কাজ করে। একটি মুল অভ্যাস ( keystone habit) বদলিয়ে কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি বদলিয়ে ফেলা যায়, কিছু কেস স্টাডি দিয়ে সেটা আলোচনা করা হবে।
১৯৮৭ সালে এলকোয়া (Alcoa), শতাব্দী প্রাচীন আমেরিকান এলুমিনিয়াম কোম্পানি সিইও হিসাবে পল ও’নেইল (Paul O’Neill) কে নিয়োগ দেন। তিনি ব্যবসা সেক্টরে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না, উনি সরকারি আমলা ছিলেন। দীর্ঘদিন সরকারী চাকরি শেষে সম্প্রতি একটি বেসরকারী অফিসে যোগ দিয়েছেন। এলকোয়ার জন্য এটা এমন এক সময় যখন কোম্পানির অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিল, একের পর পর ভুল সিদ্ধান্তে কোম্পানি গ্রাহক হারাচ্ছিল, ক্ষতি বাড়ছিল এবং শেয়ার মার্কেটে দাম পড়ে যাচ্ছিল। প্রথম যেদিন তিনি শেয়ার মার্কেট এনালিস্ট আর কিছু বড় বিনিয়োগকারীদের সাথে মিটিং করেন, সবাই আশা করেছিল তিনি কোম্পানির লাভ বাড়ানোর উপায় নিয়ে কথা বলবেন, ম্যানেজমেন্টের প্রিয় শব্দ যেমন প্রফিট, কস্ট কাটিং, রাইট সাইজিং, সিনার্জি এসব নিয়ে কথা বলবেন, ট্যাক্স সিস্টেম নিয়ে বিষেদাগার করবেন, রেগুলেশন নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে তিনি উপস্থিত অডিয়েন্স কে বলেন সিইও হিসাবে তার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে এলকোয়াতে কাজের পরিবেশ নিরাপদ করা। তিনি কোম্পানিকে আমেরিকার মধ্যে সবচে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র হিসাবে তৈরি করতে চান। যদিও উচ্চ ঝুকিসম্পন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে এবং আমেরিকার অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এলকোয়ার কর্মক্ষেত্রের নিরাপ্ততার চিত্র খুব খারাপ ছিল না। তিনি জানান “শুন্য কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা” কে নিজের টার্গেট হিসাবে গ্রহন করেছেন। ওই মিটিং থেকে বের হয়ে অনেকেই তাদের এলকোয়ার শেয়ার বিক্রি করে দেন, সবাই নিশ্চিতভাবেই ধরে নেন বেসরকারি খাতের অনভিজ্ঞ এই সিইও কোম্পানিকে সামনে আরো ডুবাবে।
একবছর পর এলকোয়ার লাভ রেকর্ড পরিমান বৃদ্ধি পায়। উনি ২০০০ সালে যখন তিনি এলকোয়া ছেড়ে দেন, তখন এলকোয়ার আয় ৫ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে, কোম্পানী মুল্য দাড়িয়েছে ২৭ বিলিওন ডলার। পল ও’নেইল যেদিন কাজে যোগদান করেছিল সেদিন যদি কেউ এক মিলিওন ডলারের এলকোয়ার শেয়ার কিনত তাহলে ২০০০ সাল উনার যাবার দিন পর্যন্ত সে আরো এক মিলিওন ডলার পেত ডিভিডেন্ড হসাবে আর শেয়ারের দামেও ৫গুণ বেশী মুনাফা করতে পারত।
পল ও’নেইল আসলে কি করেছিলেন?
তিনি প্রতিষ্ঠানের একটি মুল অভ্যাস (keystone habit) পরিবর্তন করেন, যা পুরো কোম্পানির সংস্কৃতি পরিবর্তন করে দেয়। এলকোয়া আমেরিকার সবচে নিরাপদ কোম্পানিতে পরিণত হবার সাথে সাথে অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিনত হয়। তিনি বলেন, আপনি মানুষকে আদেশ করতে পারেন না, মানুষের মস্তিষ্ক এভাবে কাজ করে না । সুতরাং আমি এমন একটি জায়গায় লক্ষ্য নির্ধারন করেছিলাম যা সবাই আনন্দের সাথে গ্রহন করে। তার আগের সিইও কিছু পরিবর্তনের জন্য কাজ শুরু করলে কর্মচারীরা ধর্মঘটের ডাক দেন। কিন্তু পলের নিরাপত্তা কর্মসুচী সবাই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে গ্রহন করে। আবার একসাথে আপনি অনেক অভ্যাস তৈরি/বদলাতে পারবেন না। এজন্য একটা মুল অভ্যাস বেছে নেয়া দরকার। যে মুল অভ্যসাটা এমন যে তা চেইন রিএকশন তৈরি করতে পারে যা অন্যান্য অভ্যাসকে প্রভাবিত করে, যেটা কে তিনি নাম দেন মুল অভ্যাস (keystone habit)। এটা দিয়ে ব্যাখা করা যায় কেন হঠাত করে একজন লোক চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমতে পারে, সেই সাথে কাজে তার মনোযোগ এবং দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং আগেই কাজ শেষ করে এসে বাসায় এসে স্ত্রী বাচ্চাদের সাথে রাতের খাবার গ্রহন করতে পারে। ব্যায়ামের একটি অভ্যাস (মুল অভ্যাস) রপ্ত করতে পারায় তার অন্য জায়গাগুলিতে উতকর্ষতা আসে। দেখা যায় যারা ব্যায়ামের অভ্যস গড়তে পারে তারা ভাল খাবারের অভ্যাস গড়ে তোলে, ধুমপান ছাড়তে কিম্বা কমাতে পারে, ক্রেডিট কার্ডে খরচ করার ব্যাপারে সংযত হতে পারে। গবেষকরা আরো দেখেছেন যে পরিবারে সবাই একসাথে রাতের খাবার খায় সে পরিবারের বাচ্চারা ভালো হোমওয়ার্ক করে, ভালো গ্রেড পায়, তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রন ভালো হয় এবং তারা আত্মবিশ্বাসী হয়।
ষাটের দশকে পল যখন হোয়াইট হাউসে বাজেট ম্যানেজমেন্টের দ্বায়িত্ব পান, তখন থেকে তিনি প্রতিষ্ঠানের অভ্যাস নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। তিনি দেখেন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গুলো যৌক্তিক কারন বুঝে কিম্বা প্রকৃত প্রয়োজন বিবেচনায় নেয়া হয়না বরং এক ধরনের অভ্যাসগত ভাবে নেয়া হয়। তারা আসলে সিদ্ধান্ত নেয়না বরং এক ধরনের ইংগিত (CUE) এর বপরীতে স্বয়ংক্রিয় কাজ (Routine) বাস্তবায়ন করেন এবং তা থেকে প্রমোশন কিম্বা পুনরায় নির্বাচিত হাবার পুরস্কার (reward) আশা করেন। অভ্যাস চক্রের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে, অর্থাত এখানে ইঙ্গিত-কাজ-পুরস্কার (Cue-routine-reward) তথা অভ্যাস চক্রের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
তিনি উদাহরন দেন, দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকায় কম্যুনিটি হাসপাতাল বানানোর প্রবণতা তৈরি হয়। যেটা সরকারী অফিসের একটা অভ্যাসে পরিনত হয়। একজন কংগ্রেসম্যান যখনি স্বাস্থ্য বাজেট পান, তিনি একটি হাসপাতাল বানান, কিন্তু সেখানে আদৌ হাসপাতালটি প্রয়োজন কিনা সেটা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। তারা একটি বিল্ডিং বানাতে আগ্রহী হন যেটা তারা ভোটের সময় দেখাতে পারবেন যে এটা আমি করেছি। পলের মতে এটা অভ্যাস থেকে হয় এবং এটা বিপদজনক, কারন এতে আসল কারন অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্ত হয় না, ফলে মুল সমস্যাও দূর হয় না। এজন্যই সরকারি বিভিন্ন অফিস দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে না, কারন তারা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে না পৌছে অভ্যাসগত ভাবে কাজ করছেন।
মুল অভ্যাস রপ্ত করার ব্যাপারটা অনেকটা ছোট বিজয়ের (small win) মত। একটা ছোট বিজয় আরো ছোট ছোট বিজয়ের জন্য আকাংখা এবং পথ তৈরি করে। যেমন এলকোয়াতে নিরাপত্তার বিষয়গুলিতে যখন জোড় দেয়া হয়, বিভিন্ন প্রসেস নতুন করে সাজানো হয়, তখন একজন অপারেটরকে ক্ষমতায়ন করা হয় যেন সে কোন অনিরাপদ কিছু দেখলেই প্রসেস বন্ধ করে দেয়, যেটার জন্য আগে তার ম্যানেজারের অনুমতি লাগত। শধু তাই নয়, সিইওর ফোন নাম্বার সবাইকে দেয়া হয় এবং নিরাপত্তা ইস্যু সমাধান না হলে সরাসরি সিইওর কাছে ফোন করতে উতসাহিত করা হয়। দেখা যায় কর্মচারিগন তাকে শুধু নিরাপত্তার বিষয় নিয়েই ফোন করছেনা না, তারা বিভিন্ন আইডিয়া শেয়ার করছে যার কোনটা হয়ত কোম্পানির জন্য অত্যন্ত সুফল বয়ে আনছে, যেটা তারা আমলাতান্ত্রিকতা ভেদ করে কখনো তার ম্যানেজারকে বলারই সুযোগ পায়নি। নিরাপত্তা প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করতে যেয়ে প্লান্টে যে পরিবর্তনগুলি আনতে হয় যেমন গলিত এলুমিনিয়াম ছিটকে না পড়া, তাতে কোম্পানির অপচয় কমে যাচ্ছে কিম্বা কোন মেশিন বদলিয়ে নতুন মেশিন বসানো হচ্ছে তাতে দ্রব্যের গুনগতমান ভালো হচ্ছে। এভাবেই নিরাপত্তাকে প্রধান লক্ষ্য ধরলেও সেটা কোম্পানির লাভ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই নিরাপত্তার অভ্যাস তৈরির জন্য পল অভ্যাস চক্রের আশ্রয় নেন। তিনি নিয়ম করেন যখনি একটা দুর্ঘটনা ঘটবে/কেউ আহত হবে (ইংগিত/cue), ২৪ ঘন্টার মধ্যে সে ইউনিটের প্রেসিডেন্টকে পলের কাছে রিপোর্ট করতে হবে, তার সাথে একই ধরনের দুর্ঘটনা আরেকটা না ঘটে সেজন্য একটা পরিকল্পনা দিতে হবে (কাজ/routine) এবং যারা এই অভ্যাসটা রপ্ত করতে পারবে শুধু তারাই প্রমোশন বা অন্য ইনসেন্টিভ পাবে (পুরস্কার/reward) । মুল অভ্যাস চক্রের মাধ্যেমে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে এই অভ্যাস প্রতিষ্ঠিত করেন যা পুরো প্রতিষ্ঠানকে বদলিয়ে দেয়।
পল ও’নেইল এর এই মুল অভ্যাস (keystone habit) এর ধারনা আধুনিক ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসাবে পরবর্তীতে বিভিন্ন কোম্পানি গ্রহন করে এবং বর্তমানে এটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই অধ্যায়ে মাইকেল ফেল্পস এর ছোট থেকে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মুল অভ্যাস এর প্রভাব সম্মন্ধে বিস্তারিত কেস স্টাডি আছে সেটা থেকেও দিক নির্দেশনা পাবেন। মুল অভ্যাস (keystone habit) পরিবর্তনের মাধ্যমে সার্বিক উতকর্ষতা আনবার ব্যাপারটি ব্যক্তিক্ষেত্রেও প্রজোয্য। আপনি নিজেও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব সফলতার অভ্যাস কি, কিভাবে তা তৈরি করা যায় এবং এক্ষেত্রে স্টারবাকসের উদাহরণ।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২০ বিকাল ৪:৫০