(Power of Habit by Charles Duhigg, Part One, Chapter One: The Habit Loop)
অভ্যাস চক্রঃ
এই অধ্যায়ের মুল বিষয় হলো অভ্যাস কিভাবে কাজ করে তার স্নায়ুতান্ত্রিক ব্যাখা।
আমরা প্রত্যেক দিন অনেক কাজ করি যেটা নিয়ে আমাদের কখনো খুব বেশী চিন্তা করতে হয়না, যেমন চুল আচড়ানো, বাইরে যাবার সময় জুতা পায়ে দেয়া ইত্যাদি। এই কাজগুলি আমরা অভ্যাস বশত করে থাকি। শুধু নিত্য দিনের ছোট ছোট কাজ নয়, অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত আসলে মানুষের অভ্যাসের ফসল। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষক ২০০৬ সালে জানান মানুষ শতকরা ৪০% কাজ করে থাকে অভ্যাস থেকে, যেখানে মস্তিষ্ক খুব বেশী সিদ্ধান্ত গ্রহন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায়না।
একটা কাজ যখন বার বার করতে হয় তখন মস্তিষ্ক এটাকে অভ্যাসে পরিণত করে যাতে এই কাজটা করবার সময় তার কষ্ট কমে যায়, যেমন সাধারন দৈনন্দিন কাজ (উদাহরণ হাটা কিম্বা খাওয়া)। এতে এসব কাজ করতে মস্তিষ্কের কষ্ট কম হয়, একটা প্রোগ্রাম চালানোর মত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজটা মস্তিষ্ক করে ফেলতে পারে। এতে মস্তিষ্কের দক্ষতা বাড়ে এবং মস্তিষ্ক অন্য কাজ করার সুযোগ পায় । মস্তিষ্কের গভীরে একটা জায়গা আছে যাকে বাসাল গ্যাঙ্গিলা (Basal Gangila) বলে, সেখানে সে অভ্যাসের প্রোগ্রাম জমা করে রাখে। একজন ড্রাইভার যখন সকাল বেলা যখন গাড়ির চাবী হাতে নেয়, সাথে সাথে তার বাসাল গ্যাঙ্গিলায় গাড়ি চালানোর অভ্যাসের প্রোগ্রাম চালু হয়ে যায়, তখন মস্তিষ্কের যে অংশ চলমান কাজের জন্য চিন্তা কিম্বা বিশ্লেষন করে, সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় সেই অংশকে ড্রাইভিং নিয়ে ব্যস্ত হতে হয়না, সেই অংশটি তখন অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হতে পারে। এ কারনেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বের হবার সময় আপনি অফিসের মিটিং বা অন্য কাজ নিয়ে চিন্তা শুরু করতে পারেন। বাসাল গ্যাঙ্গিলায় এই প্রোগ্রাম জমা থাকে এবং সময়মত চালু হতে পারে বলে প্রত্যেকবার ছুটির পর নতুন করে গাড়ি চালনা শিখতে হয়না।
একটি নতুন কাজ এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবার পর, এই দুই রকম ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যে কাজ করতে হয় বিজ্ঞানীরা গবেষনাগারে তার পরীক্ষা করেছেন। একটি গোলক ধাধার মধ্যে মস্তিষ্কে প্রোব লাগানো ইদুরকে বন্দী করে রাখা হয়। তারপর একটি ঘন্টা বাজিয়ে তার সামনের বাধা উঠিয়ে নেয়া হয়, গোলক ধাধার অন্য একটা জায়গায় তার জন্য খাবার রাখা থাকে। ঘন্টা বাজবার পর সামনের বাধা উঠে গেলে ইদুরটি গোলকধাধা ঘুরে খাবারটি খুজে বের করে। এই সময়ের মস্তিষ্কের সিগন্যাল মাপা হয় প্রোব দিয়ে। বেশ কিছুদিন একই গোলকে একই জায়গায় খাবার দেয়া হয়, একইভাবে ঘন্টা বাজিয়ে তাকে সামনের বাধা সরিয়ে দেয়া হয়। যখন ঘন্টা শুনে খাবার সংগ্রহ কররার বিষয়টি যখন অভ্যাসে পরিনত হয়, তখন বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন প্রথম অবস্থার তুলনায় মস্তিষ্কের কাজের পরিমান উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে অভ্যাস তৈরি হবার বিষয়টি তিনটি ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ইঙ্গিত-কাজ-পুরস্কার
( Cue-Routine-Reward) চক্র। মস্তিষ্ক যখন ইংগিত পায়, সে তখন একটা কাজ সম্পন্ন করে যেটা তাকে একটা আকাংখিত পুরষ্কার দেয়। যেমন ইদুরের পরীক্ষায় যেভাবে ব্যাখা দেয়া হয়, ঘন্টার শব্দটা ইঙ্গিত, এটি পেলেই তার বাসাল গ্যাঙ্গিলা সক্রিয় হয়, সে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে (কাজ) গিয়ে খাবার খায় (পুরষ্কার)। এভাবে সময়ের সাথে একই কাজ করতে করতে থাকলে মস্তিষ্ক সেটা স্বয়ংক্রিয় করে ফেলে সেই প্রোগ্রাম বাসাল গ্যাঙ্গিলায় লিখে ফেলে। মানুষ মস্তিষ্ক না খাটিয়ে অনায়াসেই সেই কাজ করে যেতে থাকে।
এই অধ্যায়ে অভ্যাস চক্রের এই বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তারিত কেস স্টাডি দেয়া আছে। ইউজেন পলি (Eugene Pauly) নামে এক ভদ্রলোক ভাইরাল এনসেফালাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন, কারন তার মস্তিষ্কের বাইরের দিক ভাইরাসের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছিল যা সাম্প্রতিক স্মৃতি জমা রাখে। তাকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ সময় পরীক্ষা করেন। দেখা যায় তিনি নতুন কিছু মনে রাখতে না পারলেও, নতুন কিছু অভ্যাস তাকে দিয়ে রপ্ত করানো যায়। যেহেতু তার মস্তিষ্কের বাহরের স্তর যেখানে স্মৃতি সংরক্ষিত হয় সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু বাসাল গ্যাঙ্গিলা অক্ষত রয়েছে তাই তার পক্ষে বেশ কিছু অভ্যাস রপ্ত করা সম্ভব হয়েছে বলেই বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত। যেমন বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তিনি যখন শোবার ঘরে অবস্থান করেন তাকে রান্নাঘর কোনটা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারেন না কিনতু ক্ষিধা পেলে রান্না ঘরে যেয়ে রেফ্রিজারেটর থেকে খাবার বের করে খেতে পারেন। বাড়ির বাইরে থাকা অবস্থায় তাকে তার বাড়ি কোনটা কিম্বা কোথায় থাকেন জিজ্ঞেস করলে বলতে পারেন না কিন্তু নির্দিষ্ট পথে একটা দুরত্ব ঘুরে বাসায় আসতে সক্ষম হন।
ইউজেন পলি কে নিয়ে গবেষনা প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পর অভ্যাসের বিষয়টা একাডেমিক ফিল্ডে একটা গুরত্বপুর্ণ স্থান দখল করে। বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় কোম্পানিগুলো মানুষের অভ্যাস সমন্ধে আরো বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হয়। তারা অভ্যাসের স্নায়ুতান্ত্রিক এবং মনস্তাত্বিক ব্যাখা, অভ্যাসের শক্তি এবং দুর্বলতা, অভ্যাস কিভাবে তৈরি হয়, কিভাবে তা বদলানো যায় এসব জানতে আগ্রহী হন।
গবেষক্দের মতে যে কোন কিছুই অভ্যাস চক্রের ইঙ্গিত ( CUE) হতে পারে যেমন চকোলেট, কিম্বা টিভির বিজ্ঞাপন, দিনের একটা সময়, কোন একটা জায়গা, কোন আবেগময় স্মৃতি কিন্তা বিশেষ কোম্পানির কর্মী ইত্যাদি। কাজ (Routine) হতে পারে খুবই জটিল কিম্বা খুবই সরল একটা কাজ। পুরস্কার (reward) হতে পারে কোন খাবার, মাদক, একটা ভালো কাজ কিম্বা একটা খারাপ কাজ ইত্যাদি যেটা শরীর বা মনের একটা প্রশান্তি দেয় বা একটা প্রয়োজন পুরণ করে, একটা আবেগকে জাগিয়ে তোলে, কারো কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া বা নিজের মনের মধ্যে একধরনের ভালো লাগা ইত্যাদি।
গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে অভ্যাস খুবই শক্তিশালী। মানুষের অজান্তেই এই অভ্যাস তৈরি হতে পারে অথবা এটাকে পরিকল্পিতভাবে তৈরিও করা যায়। অভ্যাস আমাদের জীবনকে শক্তভাবে প্রভাবিত করে। এক সময় একটা খারাপ অভ্যাস হয়ে গেলে তা খারাপ জেনে বা বুঝেও মানুষ তা সহজে ছাড়তে পারেনা। অভ্যাস সময় নিয়ে মস্তিষ্কের অজান্তে তৈরি হয়। আমরা অভ্যাস চক্র সমন্ধে জানিনা বা সচেতন থাকি না তাই ধীরে ধীরে অভ্যাস তৈরি হলেও তাই আমরা বুঝতে পারিনা বা এটাকে পরিবর্তন করতে পারিনা। বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান মানূষের অভ্যাসকে সফল্ভাবে তাদের ব্যবসার জন্য ব্যবহার করে।
তবে কোন একটা খারাপ অভ্যাস হয়ে গেলেই সেটা আমাদের জীবনের চুড়ান্ত পরিণতি এটা ভাবার কোন কারন নাই। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষ যে কোন অভ্যাস বাদ দিতে পারে, নতুন অভ্যাস তৈরি করতে পারে, একটা অভ্যাসকে পরিবর্তন করা যায়। এই বিষয়গুলি নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তি অভ্যাসের মত প্রতিষ্ঠানের এবং সমাজের কিছু অভ্যাস থাকে যেগুলি সেখানকার আচরন/কার্যক্রম/সফলতা নির্ধারণ করে। সফল নেতারা এগুলি কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানে ও সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে আসেন সেগুলি নিয়েও পরবর্তী অধ্যায় গুলোতে পর্যায়ক্রমে আরো আলোচনা আসবে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২০ বিকাল ৩:২০