কিছু দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রাজধানীর তেজগাঁও থানা এলাকার নাখালপাড়ায় অবস্থিত ৫ নম্বর ন্যাম ভবনের অষ্টম তলার ৭/বি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এসএসএফের সহকারী পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলামের বাসায় এক গৃহপরিচারিকা গত ৫ই নভেম্বর নিহত হয়েছে। ঐ গৃহপরিচারিকার নাম মিনা (১৫)। মিনার গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছার লাউড়িতে। তার বাবার নাম আবদুল হামিদ। এই ঘটনার সহকারী পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম নিজে বাদী হয়ে তেজগাও থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশের কাছে তরিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, মিনা মানসিক রোগী ছিল। সে রাত ১২ টা থেকে ৩ টার মধ্যে যে কোন সময়ে কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। এজাহারে বলা হয়, গতকাল রাত দেড়টার দিকে তরিকুল ইসলাম কর্মস্থলে ছিলেন। এ সময় তার স্ত্রী তাকে ফোন করে প্রথমে জানান মিনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাকে একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো ঝুলন্ত অবস্থায় পান।
ন্যাম ফ্ল্যাটের ঐ বাসায় পুলিশ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী থাকেন। তেজগাঁও থানা সূত্র জানায়, ৫ তারিখ দিবাগত রাত সোয়া তিনটার দিকে উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালিয়ার রহমানের নেতৃত্বে তেজগাঁও থানার এক দল পুলিশ নাখালপাড়ার ৫ নম্বর ন্যাম ভবনের অষ্টম তলার ৭/বি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এসএসএফের সহকারী পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলামের বাসায় যান। পুলিশ ঐ বাসার দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি কক্ষ থেকে গলায় সবুজ রঙের ওড়না পেঁচানো অবস্থায় মিনাকে খুঁজে পায়। পরে মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, মিনার গলায় কালো দাগ দেখা যায়। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্ত ও লাশের আলামত দেখে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে।
...................................................................................................
উপরের ঘটনাটি থেকে কিছু অসঙ্গতি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, আর তা হল-
(১) জনাব তরিকুল ইসলাম, যিনি নিজেই এসএসএফের সহকারী পুলিশ সুপার, তিনি পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, মিনা মানসিক রোগী ছিল। কিন্তু কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি কোন মানসিক রোগীকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে রাখবে? তাহলে কি আইনের ধ্বজাধারী তরিকুল নিজেও বিকারগ্রস্থ? আর কোন মানসিক রোগীকে দিয়ে কাজ করানোটাও বেআইনী, তা তো এসএসএফের সহকারী পুলিশ সুপারের জ্ঞাত না থাকার কথা নয়। এখানে উল্লেখ্য যে, তরিকুলের প্রতিবেশীদের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিনা আদতে কখনোই মানসিক রোগী ছিল না। তবে তার উপর চলত ঐ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর অমানুষিক নির্যাতন।
(২) জনাব তরিকুল এজাহারে বলেছেন, রাত দেড়টার দিকে তরিকুল ইসলাম কর্মস্থলে ছিলেন। এ সময় তাঁর স্ত্রী তাঁকে ফোন করে প্রথমে জানান মিনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাঁকে একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো ঝুলন্ত অবস্থায় পান। এহেন অসঙ্গতিপূর্ণ কথায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, "ন্যাম ভবনের ঐ ফ্ল্যাটটি কি এতোটাই বিশাল, যে একজন মানুষের ঝুলন্ত লাশ খুঁজে পাওয়া যায় না???
(৩) লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, মিনার গলায় কালো দাগ দেখা যায়। উপরন্তু, তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্ত ও লাশের আলামত দেখে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের দাগ ঐ পুলিশ কর্মকর্তাদের চোখে পড়েনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক ডিউটি অফিসারের ভাষ্যমতে, “তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেখেছি ক্ষতের চিন্থ।” এমতাবস্থায় পুলিশের মিথ্যাচার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না।
(৪) দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত পুলিশের ভাষ্যমতে, পুলিশ ন্যাম ভবনের ঐ ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে লাশ মেঝেতে দেখতে পায়। অথচ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত পুলিশের ভাষ্যমতে, তখনো লাশ ফ্যানের সাথে ঝুলানো ছিল। এখানে পত্রিকাভেদে তথ্য ভিন্ন, কিন্তু পুলিশ সেই একই।
(৫) প্রতিবেশীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিনাকে যখন তখন গালাগালি, মারধর করত ঐ দম্পতি। তাকে বাড়িতে, বা ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। তাদের এহেন আচরণে মিনার জীবন হয়ে উঠেছিল বিষময়।
আর যদি এটি আদতেও আত্মহত্যার ঘটনা হয়ে থাকে তবে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, মাত্র ১৫ বছর বয়সী একটা মেয়ে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। মানুষ তখনই নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, যখন সে জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। তাই আমরা ধরে নিতে পারি, মিনার সাথে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে যা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। সম্প্রতি বখাটেদের উৎপাতে অনেক কিশোরী-তরুণী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, এ নিয়ে অনেকেই সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু যদি ঘরের মাঝে থাকে যৌন সন্ত্রাসীদের বাস, তবে তা থেকে মুক্তির উপায় কি???
এই ঘটনাটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজে চলমান নির্মমতা, নির্যাতন ও উর্দি পরা সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ারের নামে সাধারণের আওয়াজ রোধের যে অকথিত অপারেশন পরিচালনা করছে, এ তারই প্রতিফলন মাত্র। আমার বাবা ছোটবেলায় একটা কথা বলতেন, “চোর বুইড়া হইলেও চুরির অভ্যাস ছাড়ে না। সে চুরি করতে না পারলে ঘরের মধ্যেই নানান জিনিষ নাড়া-চাড়া করবেই।” এই কথার রেশ ধরেই বলছি, তারা পুলিশ হেফাজতে, জেলখানায়, মাঠে-ঘাটে কথিত ক্রস-ফায়ারের নামে নির্যাতন, হত্যা করতে করতে তাদের অবস্থা হয়ে গেছে সেই চোরের মত। এখন তারা বাইরের মানুষকে হত্যা, নির্যাতনের সুযোগ না পেয়ে ঘরেই তার চর্চ্চায় রত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার মিনা নামের নিষ্পাপ মেয়েটা।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় একটাই, আর তা এই উর্দি পরা সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমেই। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। কিন্তু তা করাটা মোটেও সহজ নয়। কারণ, তারা যে নিজেরাই আইনের ধ্বজাধারী সরকারী সন্ত্রাসী, সরকারী দলের বদল হলেও, তাদের অবস্থান অনড়। আর এক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারত, সেই মিডিয়াও অজ্ঞাত কারণে বড়ই নীরব। মিডিয়াকে এই আড়মোড়া ভেঙ্গে জাগতে হবে, জাগাতে হবে জেগে জেগে ঘুমানো সমাজের মানুষগুলোকে। আমাদের সবাইকে নিজেদের জায়গা থেকে মানবতাবোধ জাগ্রত করার কাজটি করে যেতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নাই। আর এভাবে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমরা একদিন পৌছাতে পারব সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে, যে সমাজ হবে সাম্যের, যেখানে থাকবে সকলের সমান অধিকার……
(বি.দ্রঃ কোন বিশেষ কারণে, বা বিশেষ মহলের অজ্ঞাত কারণে কোন পত্রিকাই আমার এই লেখা ছাপতে চাইনি। তাই ফেসবুক ও ব্লগে সবার সাথে শেয়ার করছি...সম্ভব হলে এই লেখা আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন)
--শাহেরীন আরাফাত
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:৪৩