আমাদের মফস্বলের বাড়ীর সামনের গলিটা ধরে একটু এগুলেই মামুনদের বাড়ি। মামুন আমার স্কুল জীবনের শেষের দিকের বন্ধু ছিল। এভাবে বললাম এই জন্য যে মামুনরা থাকতো অন্য কোথাও, ওদের এই বাড়িটা ভাড়া দেওয়া ছিল অনেক দিন। সম্ভবতঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা নিজেদের বাড়ীতে এলো বসবাস করতে। ওর স্থুল শরীরের কারনে আমরা মাঝে মাঝে মটু বলে ডাকতাম। কিন্তু অত্যন্ত ভাল ছেলে ছিলো। ভদ্র, ন্ম্র। যখন স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠলো, কি এক অজ্ঞাত রোগে সে মারা গেল। বাবার একমাত্র ছেলে। ঢাকায় হাসপাতালে ছিল বেশ কিছুদিন। একদিন হঠাৎ শুনলাম ও আর নেই। লাশ এলো ঢাকা থেকে। আমরা সবাই দেখতে গেলাম। তেমনিই আছে। শুয়ে আছে কফিনে। এত রোগশোকের পরও দেখলাম মুখটা তেমনি নির্মল। ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি লেগে আছে যেন। আমরা বন্ধুরা খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। শুধু আমরা নই, পাড়ার সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিল, এমন এক টগবগে তরুণ মরে গেল!
এই মামুনের বড় বোন, ইরানী আপার একদিন বিয়ে হলো ধূমধাম করে। বর মানে আমাদের জামাইবাবু একজন সাংবাদিক, আবার লেখালেখিও করেন। নাম মাহফুজ সিদ্দিকী। যদিও তাদের দাম্পত্ত জীবন সুখের হয়নি। এক সময়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ইরানী আপারও জীবনের অবসান হয়েছিল কোনও এক অজানা অভিমানে। হয়তো এই দাম্পত্ত জীবনের কারনেই। সে আরেক অধ্যায়।
এই বইটির নাম মনে পড়লো আজকাল আমাদের সমাজে প্রেম-প্রণয়ের নামে জিঘাংসা আর বর্বরতা দেখে। কি হচ্ছে এসব! প্রেম যেন সত্যিই এখন সর্বনাশী! খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে খুন করেছে। আসলে প্রেমিক-প্রেমিকা তো নয়, একজন পুরুষ বা একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালবাসতে চেয়েছে, হয়তো আকারে ইংগিতে বুঝিয়েছে, হতে পারে প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি তাকে ভালবাসতে রাজি নয়। তার অর্থ কি তাকে মেরে ফেলবো রাজি হলো না বলে? প্রেমের প্রস্তাব করে তুমি যদি বছরের পর বছর অপেক্ষাই না করতে পারলে তাহলে কিসের প্রেম, কিসের ভালবাসা! আর তুমি যদি মেয়েটির মন ভুলানোর জন্য বা তোমাকে আকর্ষণীয় করার জন্য তার কাছে তোমার সকল গুনাগুন তুলে ধরতে না পারো, সেটা কি তার দোষ! এ কেমন ভালবাসা, যাকে ভালবাসতে চাই তাকেই আবার নিজ হাতে মেরে ফেলি! জোর করে ভালবাসা! প্রস্তাব দিয়েও ভালবাসা হয় বলে তো মনে হয় না। এতো এক ধরনের রসায়ন। ক্রিয়া-বিক্রিয়া যখন শুরু হয় তখন মন থেকেই ডাক আসে, আসে ভাল লাগা। আজকাল চেংড়া ছেলেপেলেরা সবাই নিজেকে নায়ক মনে করে, তো নায়িকা না পাওয়ার তো কারন নেই। এরা ধরেই নেয় যে তাদের জন্য নায়িকা মানে চুটকি। এতসব গুনবান নায়কের জন্য নায়িকাদের লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কথা! সম্ভবতঃ এই রকম ভাবনা থেকেই কারও প্রত্যাখ্যানে মাথা তেতিয়ে ওঠে। অতঃপর জিঘাংসায় হত্যা অথবা ধর্ষণ। কারও অন্তরে যদি বিন্দুমাত্রও প্রেম-ভালবাসা জেগে ওঠে, সে কখনো হত্যা বা ধর্ষণ করতে পারে না। হ্যাঁ পারে, অনেক নজির আছে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে…আত্মহত্যা! যদিও সেটা অপরাধ এবং কাপুরুষের কাজ। অথবা একটা অন্তর্গত অভিমান নিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করেছে দিনের পর দিন। অথবা দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে থেকে থেকে...অবশেষে একদিন দেখা মিললো দুজনার চোখে চোখে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মনের টানে। আবার কখনও প্রেমিক তার ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে তার পছন্দের মানুষটির মঙ্গল কামনা করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, এমনও আছে। সেই তো ভালবাসা যা প্রেমিককে অভিমানী করে তুলে, সেই তো ভালবাসা যা উৎসর্গে আরও মহীয়ান করে তুলে। যেই প্রেমের ব্যর্থতায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় না, অথবা যেই প্রেমের জন্য দুঃখ আর কষ্টের বিলাস নিয়ে বেঁচে থাকার সাহস থাকে না, অথবা যেই ভালবাসা ত্যাগী বা যোগী হতে শেখায় না, সে কি আর ভালবাসা, সে কি আর প্রেম! অথচ আজ সমাজে যাদের দেখি এরা কারা? নায়ক কোথায় এখন! এরা তো খলনায়ক। এরা আর কিছুই নয় শুধু শরীরকেই দেখেছে। মন আর মগজে এক ধরনের বিকৃত রুচি ধারন করে কামুক লালসা চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়ে এইসব হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বরতা চালাচ্ছে প্রতিদিন। এরা absolutely perverted element. প্রেমিক নয় মোটেও। ভাবতেও অবাক লাগে আমাদের দেশের রিপোর্টাররা শিরোনাম লেখে ‘প্রেমে ব্যর্থ হয়ে......।‘ এদের সরাসরি দুর্বৃত্ত এবং সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া উচিত, অন্য কোনও বিশেষণ নয়। কিছুদিন আগে সিলেটে খাদিজাকে যেমন নৃশংস ভাবে কুপিয়ে মৃতপ্রায় করেছিল, একটা সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। ভাবা যায় যাকে ভালবাসছে তাকেই এমন ভয়ংকর ভাবে কোপাচ্ছে! প্রায় প্রতিদিন এসব দেখতে পারছি।
কিছুদিন আগে দেখলাম ইন্দোনেশিয়ায় ধর্ষকদের রুখতে আইন করছে যে, ধর্ষক প্রমানিত হলে তাকে শাস্তি হিসেবে ইঞ্জেকশান দিয়ে নপুংশক করা হবে। এর চেয়ে ভাল আইডিয়া তো আর হয় না। সারা জীবনের জন্য শখ মিটে যাবে। আমাদের দেশেও ধর্ষক এবং এই রকম হত্যাকারীদেরও অন্য শাস্তির পাশাপাশি নপুংশক করার ব্যবস্থা করা উচিত, অতিসত্বর।
বলতে দ্বিধা নেই, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার এই সব অপরাধের প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু আধুনিক প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলার উপায় নেই, তাই দেশে কিছু কঠিন আইন তৈরি করতে হবে যত শীঘ্র সম্ভব এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তিটা যেহেতু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতদের এবং কুপ্রবৃত্তদের কাছে সহজলভ্য হয়ে গেছে, সেহেতু নতুন আইনের প্রয়োজন খুব বেশী করে দেখা দিয়েছে। অন্ততঃ এই সমাজের আব্রুকে বাঁচানোর জন্য।
আমি অভিশাপ দেই তাদের যারা প্রেম বা ভালবাসার নামে সর্বনাশ ডেকে আনে। আমি অভিশাপ দেই সেই সব পুরুষদের যারা নারীদের নিরন্তর দেখতে ভুল করে।