এই সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম…ফুটবলের নির্বাসন, ফুটবলের সমাধি।
বাংলাদেশের ফুটবল দেখা বাদ দিয়েছি অনেক আগেই। এর মান যে পর্যায়ে এসেছে তাতে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। তবু এতদিন একটা আশা ছিল যে একদিন হয়তো এ দেশের ফুটবল আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিভিন্ন রকম কর্মসুচি, বিশেষ করে জনাব সালাহউদ্দিন যখন ফেডারেশনের দায়িত্ব নিলেন, তখন থেকে মনে হচ্ছিল যে ফুটবল বেঁচে যাবে এবং তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। কিন্তু কিছুই হয় নি। বরং যাদের কাছে বাংলাদেশ কখনো পরাজিত হতো না, তাদের কাছেই ইদানিং হারতে শুরু করেছিল এবং শেষমেশ ভুটানের কাছে ৩-১ গোলে হেরে সব আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট থেকে ৩ বছরের জন্য নির্বাসন পেয়েছে। সত্যিই কি প্রাপ্তি! ফুটবল নিয়ে আমার লেখার কোন ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু এই ফুটবল এক সময় আমার রুধিরে বিরাজমান ছিল। আমার বয়সের যারা আছে, তাঁরা জানে, স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফুটবল কেমন দাপুটে খেলা ছিল! এই ফুটবল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল বাদবিতণ্ডা হয়েছে, কথা বলাবলি বন্ধ হয়েছে, বন্ধুত্বের মশলা কয়েকদিনের জন্য আকাশে উড়ে গেছে। যার সঙ্গে দিনে দুই বার দেখা হয়, সন্ধ্যায় নিয়ম করে আড্ডা চলে, সেই বন্ধুর সঙ্গে তিন দিন কথা বন্ধ! এসবই হয়েছে কেবল আবাহনী আর মোহামেডানকে ঘিরে।
যদি বলতে হয় তবে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল ছিল ফুটবলের স্বর্ণকাল। কি ছিল না তখন এ দেশের ফুটবলে! আগা খান গোল্ড কাপ, এশিয়া কাপ, এশিয়া যুব কাপ, এই সব টুর্নামেন্ট যখন চলতো তখন সারা দেশে ফুটবল প্রেমীদের মাঝে উৎসব বয়ে যেতো। বলতে গেলে সারা বাংলাদেশের মানুষই প্রতিদিন খেলার ফলাফল জানার জন্য উদগ্রীব থাকতো। সন্ধ্যার পর ঘরে ঘরে, দোকানে, রেস্টুরেন্টে রেডিওতে খেলার ধারাবিবরণী শোনার জন্য ভিড় লেগে যেতো। যাদের ঘরে টেলিভিশন ছিল আমরা হানা দিতাম তাদের বাড়িতে। আমাদের পাশের বাড়ীতে রসিক ইসা মামার বাসায় ছিল টেলিভিশন। আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হলে কিংবা যে কোন টুর্নামেন্টের খেলা হলে আমরা আগেই বলে রাখতাম ‘আসছি’। তার ঘর ভরে যেতো পাড়ার ছোটবড় ফুটবল প্রেমীদের দ্বারা।
মনে আছে, এশিয় যুব ফুটবলের কথা! ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, এই সব শক্তিশালী দলের সঙ্গে বাংলাদেশের তুমুল আক্রমণাত্মক খেলা। একবার মঈন নামের নতুন গোলরক্ষক যে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল খেলেছিল, তা দেখার মত। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুহুর্মুহু আক্রমণ তিনি একাই ঠেকিয়েছিলেন। ঐ টুর্নামেন্টে তাকে পরাস্ত করা ছিল দুরূহ ব্যাপার। এমন একটি খেলার পরদিন সব খবরের কাগজে তার দুই হাত উঠানো ছবি দিয়ে হেডিং লিখেছিল “হাত তো নয়, যেন চুম্বক”। এই ছবিটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে। এরপর গোলরক্ষক হিসেবে নাম করেছিল লাল মোহাম্মদ। সেই গোলরক্ষক মঈন পরে আবাহনীতে খেলেছিল অনেকদিন। পচাত্তর পরবর্তী এক দশক ঢাকা লীগের ফুটবলে ছিল বলতে গেলে শুধু আবাহনী আর মোহামেডানের আধিপত্য। এর বাইরে ছিল পুরানো ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, ওয়ারি, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, রহমতগঞ্জ। তবে শিরোপার লড়াই সীমাবদ্ধ থাকতো আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স ইউনিয়ন-রহমতগঞ্জের। রহমতগঞ্জকে সবাই বলতো ‘ডাইল পট্টি’। কেন বলতো জানিনা। মোহামেডানের সমর্থকেরা আবাহনীকে নিয়ে একবার রব উঠিয়েছিল “ওয়ারি আইলো”! তার কারনও ছিল। ১৯৭৯ তে প্রথম লেগে এবং ফিরতি লেগে দু’বারই আবাহনী অখ্যাত ওয়ারির কাছে হেরে গিয়েছিল। এরপর বলতে গেলে ওদের জন্য ওয়ারী একটা ভীতির নাম ছিল। আমি ছিলাম আবাহনীর কট্টর সমর্থক। বলতে দ্বিধা নেই স্বাধীনতার পর এই আবাহনীই আধুনিক ছন্দময় ফুটবলের গোড়াপত্তন করেছিল। শর্ট পাসে দ্রুত লয়ের খেলার রূপকার তারাই ছিল। বাংলাদেশে আবাহনীই প্রথম হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল (১৯৭৭/৭৮/৭৯)। আবাহনীর সালাহউদ্দিন, চুন্নু, হেলাল, আনোয়ার, নান্নু, টুটুল, বাবুল, এরা ছিল তারকা খেলোয়াড়। সালাহউদ্দিন, চুন্নু ছিল অপ্রতিরোধ্য। ডিফেন্সে নান্নু, টুটুল ছিল দুর্দমনীয়। ওদিকে এনায়েত, বাদল, সালাম, কায়সার হামিদ, গাফফার, সান্টু- এরা ছিল মোহামেডানের তারকা খেলোয়ার। তখন সান্টু ছিল বাংলাদেশের সেরা গোলরক্ষক। লেফট উইং-এ আবাহনীর চুন্নুর অপ্রতিরোধ্য গতিতে সাইড লাইন ধরে বল নিয়ে দৌড়ে যাওয়া ছিলো দেখার মতো। সালাহউদ্দিন তো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার এবং তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র পেশাদার খেলোয়াড়, যিনি হংকং-এর পেশাদার লীগে তিন বছর খেলেছিলেন। মোহামেডানের আসলামের হেড ছিল লক্ষভেদী। তখনকার খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাযা ছিল সুদৃঢ়। সেই সময় যখন আবাহনী বা মোহামেডানের খেলা হতো ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন মাঝে মাঝে গগনবিদারী চিৎকারে বিজয় নগর, পল্টন অথবা তার আশপাশ এলাকা যেন কেঁপে উঠতো। আবাহনী-মোহামেডানের যে কোন খেলাতেই স্টেডিয়ামে তিল ধারনের জায়গা থাকতো না। আর অন্যান্য যে কোন খেলাতেও অন্ততঃ দর্শক খুঁজে পাওয়া যেতো। মানুষ খেলা দেখতে যেতো। আমরা যারা মফস্বল শহরে থাকতাম, প্রিয় দলের খেলার ফলাফল জানার জন্য রাতে রেডিওর খবর শোনার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। সব খেলাই তো আর রেডিওতে প্রচার হতো না। কি কারনে অনেক সময় খেলার ফলাফল রেডিওতে জানাতো না। পরদিন সকাল সকাল সংবাদপত্রের দোকানে যেয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কখন ঢাকা থেকে সংবাদপত্র আসবে আর আমরা খেলার খবর জানতে পারবো।
সেই ফুটবল দেখতে কাকপক্ষীও এখন আর মাঠে যায় না! আবাহনী বা মোহামেডানের খেলাতেও এখন আর দর্শক খুঁজে পাওয়া যায় না! পুরো স্টেডিয়াম খা খা করে। ভাবা যায়? এখন আর কেউ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে না সেদিনগুলোর মতো ফলাফল জানার জন্য।
ফুটবলের সেই সোনালী সময়ে ঢাকা লীগের ফুটবল নিয়ে দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে অনেক। আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় ঢাকা স্টেডিয়ামে মারামারি হয়েছে অনেক। বিভিন্ন সময়ে প্রাণও গেছে সমর্থক অথবা নিরীহ দর্শকের। এরকম হয়েছে শুধুমাত্র আবেগ আর উন্মাদনার কারনে। আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে ফুটবল যদি টিকলই না তাহলে এই প্রান দেওয়ার অর্থ কি? সেই হতভাগ্য বাবা-মা, ভাইবোনদের কে জবাব দেবে?
আশির দশকের শুরুর দিকে শোনা যাচ্ছিল এবং লেখালেখিও হচ্ছিল যে ফুটবল এ দেশে টিকবে না। ক্রিকেটই একদিন জায়গা করে নেবে। তখন বিশ্বাস করতে চাই নি। কারন তখনও ক্রিকেট তেমন কিছুই করতে পারছিল না। আমার মনে আছে, ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে ইংল্যান্ড থেকে MCC, ভারত থেকে Decan Blues, এরা খেলতে আসতো আমাদের BCCB (তখন ছিল Bangladesh Cricket Control Board) একাদশের সঙ্গে। অবশ্যই সেগুলো ছিল unofficial tour এবং ৩ দিনের ম্যাচ হতো। বাংলাদেশ কখনো এক শ’র কোঠায় যেতে পারতো না, ৫০/৬০ রানে এ ইনিংস শেষ হয়ে যেতো এবং ৩ দিনের ম্যাচটিও ড্র করার ক্ষমতা ছিল না। মনে আছে ক্রিকেটের এই অবস্থায় একবার MCC-এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইনিংসের দিন খবরের কাগজে কার্টুন ছাপিয়েছিল…BCCB-এর দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশের এক ব্যাটসম্যানকে চ্যাংদোলা করে মাঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর খেলোয়াড়টি বলছে…”অহনো কইতাছি, ছাইড়া দেন”। সেই ক্রিকেট সত্যি এলো এবং টিকে গেল! কিন্তু ফুটবল হারিয়ে গেল। এটাও বলা হতো যে physical fitness নেই। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং অনুমাননির্ভর কথা। চীনা-জাপানী-থাইদের ফিজিক্যাল ফিটনেস কি আছে! অন্ততঃ গঠনশৈলীর দিক থেকে! কিন্তু ওরা তো চুটিয়ে ফুটবল খেলছে ! এই রকম কথা পাকিস্তানীরাও বলতো আমাদের ক্রিকেট নিয়ে। বলতো আমাদের physical fitness নেই, যে কারনে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমে কোন বাঙ্গালীর জায়গা ছিল না। একমাত্র রকিবুল হাসানকে নিয়েছিল সাইড লাইনে বসিয়ে রাখার জন্য। অথচ সেই বাঙ্গালীরাই এখন দাপিয়ে ক্রিকেট খেলছে। আসলে ফুটবলে যা ছিল না সেটা হলো commitment. জাতীয় দলের খেলা হলে তাদের তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যেতো না, যতটা পাওয়া যেতো দলীয় খেলায়। বর্তমানের কোন খেলোয়াড়কে বাহ্যত দেখে বুঝা যায় না এরা খেলোয়াড়। কোন শারীরিক ভাষাও নেই। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে বলেও মনে হয় না। তাছাড়া সস্তায় এত এত বিদেশী (আফ্রিকান) খেলোয়াড় এনে দেশের খেলার কোন উন্নতি করা যায় না।
ক্রিকেট হয় তো বেঁচে যাবে, কারন এখানে দলীয় উন্মাদনা নেই। তবে উন্মাদনা না থাকাই ভাল। এটা আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। আর আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে ভুল করার সম্ভাবনা বেশী থাকে। আমরা মাঝে মাঝে করছিও। বিশেষ করে দর্শক, সমর্থক এবং মিডিয়া। তার কারন আমরা ক্রিকেট যত না বুঝি তার চেয়ে ধারন করি বেশী। আর এজন্যই আমরা আবেগতাড়িত হয়ে ICC-এর সভাপতির পদ বিসর্জন দেই পদত্যাগ করে, বাঁশ জাতীয় বস্তু নিয়ে মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন চালু করি, ছক্কা মেরে জিতে দেখিয়ে দেবো বলে সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে ম্যাচটাকেই বিসর্জন দিয়ে চলে আসি, দুএকজন খেলোয়াড়ের উপর নিশেধাজ্ঞার কথা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দেই। এরকম অনেক কিছু আছে যা ক্রিকেটের হিসেবে পড়ে না।
লেখার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ফুটবলের প্রতি অনুরাগ নিয়ে, স্মৃতির দ্বারা তাড়িত হয়ে লিখতে হলো। এটা বুঝতে পারছি ভাল খেলোয়ার হলেই যে ভাল কর্মকর্তা হওয়া যাবে, তা সম্ভবতঃ ঠিক নয়। কাজী সালাহউদ্দিন যে ভাবে মাঠ কাঁপিয়েছেন সেভাবে ফেডারেশন কাঁপাতে পারছেন না। আমি তার জায়গায় হলে পদত্যাগ করতাম। সবকিছুকেই আমরা ব্যর্থতা বলবো কেন, অপারগতাও তো হতে পারে! আপনি ফুটবলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন বলছেন, কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে আপনি এই ক্ষেত্রে অপারগ। আপনার প্রচেষ্টা দেখেছি, কিন্তু আখেরে কিছুই হয় নি। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও গলদ রয়ে গেছে, আসল রোগটাই হয়তো নির্ণয় করা হয় নি।
ছবিঃ ১৯৮২ সালের আবাহনী-মোহামেডান এবং দর্শক গ্যালারী।