আজ সকালে (১৭/০৪/২০১৬) খবরের কাগজ খুলে দেখলাম এক মহিলাকে এক বীরপুরুষ বেদম পিটিয়ে জখম করেছে। পেটানোর ছবিও ছাপা হয়েছে। গতকালকের খবরে ছিল এক বাড়িওয়ালী তার ভাড়াটিয়ার তিন বছরের ছেলেকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলেছে।
কিছুদিন আগে তনুকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো। তারও আগে সিলেটে রাজনকে সারাদিনভর পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা হলো। আরও অনেক…শিশু অপহরণ, অতঃপর হত্যা। লিখে শেষ করা যাবে না। এরা কারা? কোথায় চলেছি আমরা? বহু বছর আগে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে কবি সামসুর রহমান লিখেছিলেন…’এক উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। সেই উদ্ভট উটের পিঠ থেকে কি আমরা এই স্বদেশকে নামাতে পেরেছি? কত সহজ হয়ে গেছে এই সব হত্যা-ধর্ষণ-অপহরণ, যেন মধ্যযুগের প্রত্যাবর্তন।
সেই বাড়িওয়ালী, তাকে কি আমরা একজন নারী বলতে পারি? সেকি কারো মা হতে পারে, না কারো স্ত্রী? যে পরুষ পিটিয়ে আহত করেছে নারীকে, সে কি পুরুষ। সে তো নপুংশক! আর সেই মহিলা থানায় ডায়রি করতে গেলে পুলিশ মহাশয় তার কাছ থেকে দু’দফায় চার হাজার টাকা আদায় করে নিয়েছে। তিনি কে?
এই সমাজেই পুরুষবেশী দানব আর নারিবেশী দানবী রয়ে গেছে। আর এদের দল ক্রমেই ভারি হচ্ছে।
কি নিষ্ঠুরতা চারিদিকে! আমরা কেউ বুঝতে পারছি না আমরা কোথায় চলেছি। আমি খুব ভাবি…এমন একটা নিষ্ঠুর এবং পশ্চাদপদ সমাজে বাস করে আমরা কি করে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের কথা বলে নানারকম উৎসব পালন করি! একটা সমাজে যখন প্রতিদিন এমন খবর দেখতে হয়, পড়তে হয় এবং তার কোন প্রতিকার হয় না, তখন ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে আমরা আদৌ সংস্কৃত সম্পন্ন কি না, সমৃদ্ধ কি না আমাদের ঐতিহ্য ধারনে।
আমরা সম্ভবতঃ কেবল উৎসব প্রেমিক। উৎসব এলে আমরা খুব মুখর হয়ে উঠি। এমন একটি নিষ্ঠুর হৃদয়হীন সমাজে কোন উৎসবের প্রয়োজন নেই।
কোথাও আমরা এক চরম ভুল করে ফেলেছি, যার মুল্য আজ আমাদের দিতে হচ্ছে অত্যন্ত চরমভাবে এবং সম্ভবতঃ আমরা চলেছি এক করুণ সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে। আমরা হত্যাকে হত্যা মনে করি না, রক্তকে রক্ত মনে করিনা। একটা শিশুর মুখের দিকে কোনদিন ভাল করে তাকিয়ে দেখি বলে মনে হয় না। একজন নারীকে কেবলই মনে করি ভোগের সামগ্রী, বানিজ্যিক পণ্য! কখনও ভেবে দেখিনা তার জঠরেই বৃদ্ধি পায় আদরে যত্নে প্রতিটি মানুষ নয়টি মাস। সেই নারীর বেদনাক্লিষ্ট প্রসবের কারনে তবেই না আমাদের প্রতিবছরের জন্মদিন উদযাপন।
আমার ঘরের শিশুর কিছুই হয় নি বলেই অন্য শিশুর মৃত্যু আমাদের ছুঁয়ে যায় না। আমরা কি ঐ শিশুকে দেখতে পাই, ঐ নারী ঐ মা’কে দেখতে পাই, আমাদের অন্তরের চোখ দিয়ে! কি স্বার্থপর আমরা! এই সব মানুষরূপী পশু আমাদের সমাজে বেঁচে থাকে কি করে, নির্বিবাদে ঘুরে বেড়ায়! আমরা নির্বাক, শুধু দেখেই চলেছি। আমরা সবাই খুব চরমভাবে ‘আমি’ হয়ে গেছি। আমরা কি আমাদের আত্মাকে মেরে ফেলছি প্রতিদিন! আমরা যেন কিসের পেছনে দৌড়াচ্ছি প্রতিদিন সময়কে মেরে ফেলে, নেশাগ্রস্তের মতো।
শুধুই আর্থিক উন্নয়ন দিয়ে কি হবে, যদি পাশাপাশি সামাজিক আচার আচরণে কোন উন্নতি না হয়। আর তাই যদি না হয়, তাহলে হয়তো ঐ কথাটাই সত্য হবে…অর্থই অনর্থের মূল।
একটা সভ্য-স্বাধীন-সংস্কৃতি সম্পন্ন জাতি কখনোই অন্ধকারের রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারে না।