ছোট বেলার ঈদের আন্দের সঙ্গে কোন বেলার আনন্দেরই তুলনা চলে না। তখন ঈদ শুরু হতো বলতে গেলে সাত দিন আগে থেকে, সেই কেনা-কাটার সময় থেকে।
তখন মফস্বলে থাকতাম। এই রকম জাকজমকের দোকানপাট তখন ছিল না। টাঙ্গাইল শহরে ভাল কেনাকাটার জন্য ভাল জায়গা ছিল নিউ মার্কেট। একেবারেই ছোট্ট পরিসরের ছিল এই মার্কেট কিন্তু ভাল ভাল হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। মেইন রোডে উঁচু সেতুটির পাশেই ছিল এই মার্কেট, এখন জীর্ণশীর্ণ। কেউ চিনতেই পারবে না, বিশ্বাসও করবে না। জামাকাপড় সাধারণত ওখান থেকেই কেনা হতো। ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আদলে তৈরি মার্কেটটির বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও নতুন জামাকাপড় আর প্রসাধনীর গন্ধ নাকে লাগতো। একটি ঈদে বাড়ীর সব ভাই বোনদের জন্যই কেনাকাটা হতো। ছোট সময় শার্ট আর হাফ প্যান্ট রেডিমেড কেনা হতো। একটু বড় হলে শার্টের কাপড় কিনে দর্জির কাছে বানাতে দিতে হতো। অন্য ভাইদের কথা মনে নেই, কিন্তু আমার দুয়েকটি ঘটনা মনে আছে। কি কারনে জানি না আমি আব্বার খুব আদরের ছেলে ছিলাম। হয়তো ছেলেদের মধ্যে ছোট, তা-ই শুনেছি কিন্তু এর যৌক্তিকতা আজও বুঝি না। আমার নাকি গভীর রাতে বিস্কুটের ক্ষুধা লাগতো। যে কারনে বাসায় সবসময় বিস্কুট কেনা থাকতো। কোনও কারনে না থাকলে বা ভুলে গেলে আব্বা নাকি ঐ গভীর রাতে পাশের রাস্তার দোকানদারকে ডেকে তুলে বিস্কুট নিয়ে আসতেন আমাকে ঠাণ্ডা করার জন্য। নইলে সারা রাত বেহালা বাজতো। এতেই বুঝা যায় তিনি আমার প্রতি কতটা সহনশীল ছিলেন। যাই হোক, আমার প্রতি এই আধিখ্যেতা আমার অগ্রাধিকার বাড়িয়ে দিয়েছিল সবকিছুতে। আব্বার কাছে তার অন্য দুই ছেলে কাছে ভিড়বার সাহস বা আবদার না করতে পারলেও আমার ছিল সবকিছুতেই সাবলীল অধিকার। আব্বার সঙ্গে রাগও করতে পারতাম। আব্বা আমার সেই রাগ সহজেই হজম করে নিতেন, কারন ঐ রকম রাগ তার বাবা অর্থাৎ আমার পিতামহই শুধু করতে পারতেন। এই গুনের জন্যও নাকি আমি আব্বার প্রিয় ছিলাম। অন্য দুই ভাইয়ের জামাকাপড় কেনা হয়ে যেতো যেমন তেমন ভাবে কিন্তু আমার হতো আমার পছন্দের, সেটা একটু বড় হলে। শার্টের জন্য কাপড় কিনতাম সবচেয়ে দামীটা। নিউ মার্কেটে এক দোকান ছিল যেখান থেকে বাঁধা কাপড় কেনা হতো। বলতে কি আব্বা কখনোই ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতেন না। নির্দিষ্ট দোকান বাঁধা ছিল। ঐ দোকান থেকে সবচেয়ে দামী শার্টের কাপড় কিনলাম। তখন তার দাম ছিল সাড়ে ছয় টাকা গজ। তখন পাঁচ টাকা গজের কাপড় কিনলেই হয়ে যেতো। কিন্তু ঐ চেক্টা আমার চোখে ধরে গেছে। দোকানী চাচা ইতস্ততঃ করলেন, কিন্তু আমি নাছোড়। কারন আমি জানি আব্বা কিছুই বলবেন না। বলেনও নি। তার পরের বছর তেমনি দামী শার্টের কাপড় কিনলাম। সেই দোকান থেকেই, শুধু অন্য চেক্। খুব পছন্দ আমার। ঈদের দু’দিন পর কালিহাতী গেলাম আমার এক দুসম্পর্কের মামা বাড়ী বেড়াতে। কাছেই, মাত্র ২০ কিলমিটার টাংগাইল শহর থেকে। বিকেলে আমরা আর মামাতো ভাইবোনেরা মিলে চিবুড়ি খেলছি। এক সময় আমি দোউড়াচ্ছি আর পিছনে আমার মামাতো বোন বীণা ছুটছে। ধরতে না পেরে সে আমার শার্ট ধেরে হেঁচকা টান দিল। আমি গেলাম পড়ে আর শার্ট গেল ফড়াৎ করে ছিড়ে। রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি এসে গেল। সেই যে বীণার সঙ্গে কথা বন্ধ করলাম আর জীবনে কথা বলিনি। শার্টটা মাত্র দু’দিন পড়েছিলাম।
ঈদের সময় জুতা কেনা হলে বাক্স সমেত আলমারির উপর উঠিয়ে রাখা হতো। তখন বাটা ছাড়া জুতা কেনা হতো না। ঈদের দিন না আসা পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে উঠেই নতুন জুতার গন্ধ শুঁকতাম। গন্ধ নয়, ওটা ছিল খুশবু। কি যে মন মাতানো গন্ধ! আজকাল জুতার গন্ধ খুঁজেই পাই না। নাকি বয়সের সঙ্গে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভোঁতা হয়ে গেছে! ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসেই জুতা আর প্যান্টশার্ট পড়ে নিতাম। তারপর ঘুরে বেড়ানো, লজেন্স আইস্ক্রিম কিনে খাওয়া, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া। বেলা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা বাড়তে থাকে। একসময় নতুন জুতা খুলে পায়ে মলমের পট্টি লাগিয়ে লক্ষী ছেলের মত ঘরে বসে থাক। অর্থাৎ পায়ে নতুন জুতার ফোস্কা পড়ে গেছে। এরপর ঐ জুতা আর সাতদিন পড়া যেতো না। সন্ধ্যা হলেই মনটা খারাপ হয়ে যেতো ঈদ শেষ হয়ে গেল বলে।
তখন ‘দুলাল বস্ত্রালয়’ ছিল নামকরা শাড়ীকাপড়ের দোকান। আম্মা কদাচিত দোকানে যেয়ে কাপড় কিনতেন। ওটাও বাঁধাধরা দোকান ছিল। ঈদের কয়েকদিন আগে দোকানের কর্মচারী এক সাদা কাপড়ের গাট্টি নিয়ে বাসায় হাজির হতো। আম্মা সেই ১০/১৫টা কাপড় থেকে পছন্দ মতো দুয়েকটি কাপড় রেখে দিতেন।
ঈদের দিন আমাদের বাড়ির রান্না হতো সবার আগে। আব্বার বন্ধুরা খেতে আসতেন দুপুরে। হিন্দু বন্ধুরাও থাকতেন। তাঁরা মুলতঃ আম্মার হাতের পোলাউ আর কোরমা খেতে আসতেন। বলতেও শুনেছি এমন রান্নাটি হয় না।
তখন ঈদের চাঁদ দেখে ঈদ উদযাপন হতো। রোজার শেষে আমাদের বাসার সামনের ফাঁকা মাঠের কোণের তালগাছটার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম এবং এক সময় চিকন চাঁদটা ঠিকই দেখতে পেতাম। মাঝে মাঝে এত্তো চিকন থাকতো যে প্রায় দেখাই যেতো না। যে দেখতে পেতো সে আরেকজনকে দেখানোর জন্য মাথা ধরে আঙ্গুলের নিশানা করে কতরকমভাবে যে দেখাতে চাইতো। না দেখতে পেরে কানা অপবাদ জুটতো। চাঁদ দেখার পর চোখের সামনে রঙিন জামা-জুতা ভেসে উঠতো।
এখন ঈদ এলে আর নতুন জামাকাপড় কেনার কথা মনে হয় না, শুধু মনে হয় কাকে কত ভাল কাপড় দেবো খুশি করার জন্য। আজ যারা শিশু কিশোর তাঁরা কি ঈদের দিন আমার মতই তেমনি খুশি হয় যেমনি আমি খুশি হতাম?