বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস, ডাক্তারদের ৫০০-১০০০/= টাকা সম্মানী নেওয়া উচিত না।
তাদের মতে, ১০০ টাকা সম্মানী নিলেই অনেক।
কারণ হিসেবে তারা মনে করেনঃ
১। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে।
২। রোগী অনেক বেশি।
৩। সে তুলনায় ডাক্তার অনেক কম।
৪। ১০০ টাকা সম্মানী নিয়ে রোগী প্রতি ১৫ মিনিট সময় দিয়ে ঘন্টায় ৪ টা, ৮ ঘন্টায় ৩২ টা রোগী দেখে, দিনে ৩২০০ টাকা উপার্জন করা যায়। এতে মাসে শুক্রবার বাদে ২৬ দিনে (২৬x৩২০০) = ৮৩,২০০/= টাকা উপার্জন করা যায়। এই টাকা দিয়ে মাসের খরচ চলে যায়।
উপরের ৪টা কথার প্রতিটাই ১০০% সত্য, অস্বীকার করার উপায় নাই।
তাহলে তো আসলেই বাংলাদেশের কোন ডাক্তারের ৫০০-১০০০/= টাকা সম্মানী নেবার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
কিন্তু এত খুশি হবার কোন কারণ নাই। কারণ, যুক্তি আছে!
এই যে ৫০০, ১০০০ সংখ্যাগুলো দেখলেন, এগুলো বাংলাদেশের মাত্র কতজন ডাক্তারের নামের সঙ্গে আছে, তা জানেন কি?
ডাক্তারদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিচারে পার্থক্য আছে।
একজন এমবিবিএস বা বিডিএস ডাক্তারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার চেয়ে অবশ্যই একজন এফসিপিএস, এমডি বা এমএস সহ আরও বড় সার্টিফিকেটওয়ালা ডাক্তারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বেশি।
তাই, সবাই একই অংকের সম্মানী নিবেন, এটা ভাবা ঠিক না।
একই মুরগীর ঠ্যাং পাড়ার রেস্তোরাতে পাবেন ৩০ টাকায়। আর ঢাকার ৫ তারকা হোটেলে পাবেন ১৫০ টাকায়। কারণ, পাড়ার মুরগীর ঠ্যাং রান্না করতে যে মশলা দরকার হয়েছে, ঢাকার হোটেলের মুরগীর ঠ্যাঙে তার চেয়ে বেশি দরকার হয়েছে।
ঠিক একইরকমভাবে, আপনার পাড়ায় বসা সদ্য এমবিবিএস পাশ ডাক্তারকে আপনি ১০০ টাকাতেই দেখাতে পারবেন। কিন্তু কোন প্রফেসর লেভেলের ডাক্তারকে দেখাতে আপনার ৫০০-১০০০/= টাকা খরচ করতেই হবে। কারণ, তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এর মূল্য তিনি চাইতেই পারেন।
একজন উকিল একটা মামলা জেতানোর জন্য বা একজন পুলিশ আপনার অন্যায়কে হালাল করার জন্য বা অন্য কোন সরকারী অফিসের কর্মকর্তা একটা ফাইলে সাক্ষর করার জন্য কতরকমভাবে আপনার পকেট কাটছে, তা নিশ্চয়ই কারোর অজানা নয়।
গরীব বলে কি কেউ তাদের কাছে পার পায়? এ পর্যন্ত আমি এমন ঘটনা জানতে পারি নাই।
অথচ একজন ডাক্তার, যে ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র ছিল, দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের মেধায় ও পরিশ্রমে পড়ার যোগ্যতা রেখেছিল, আপনার ইচ্ছাতেই আপনি তার কাছে যাওয়ার পরে নিজের মহামূল্যবান শরীরের মেরামতে বেশি টাকা দিতে কার্পণ্য করছেন।
যে কাজ যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার মূল্যও তত বেশি। আপনার ঘড়ি বা মোবাইল নষ্ট হলে তা সারিয়ে দেবার বিনিময়ে মেকানিককে ৩০০-৫০০ টাকা দিতে আপনার যে কষ্ট হয়, আপনার শরীর নষ্ট হলে তা সারিয়ে দেবার বিনিময়ে ডাক্তারকে ৫০০-১০০০ টাকা দিতে আপনার যদি একই পরিমাণ কষ্ট হয়, বা তার চেয়ে বেশিই কষ্ট হয়, তবে বোঝা উচিত, আপনি নিজের শরীরের চেয়ে ওই ঘড়ি আর মোবাইলকে বেশি ভালোবাসেন।
আর যদি তা না বাসেন, তবে ডাক্তারের ৫০০ টাকা আপনাকে এত কষ্ট দিবে না, যতটা দিবে মেকানিক এর ৩০০ টাকা।
আপনি দেখছেন, ক্লাসের পেছনে বসা ছাত্ররা আজ দুর্নীতি করে টাকা কামিয়ে কয়েক বছর পরে বাড়ি গাড়ি করে ফেলছে। আর আপনি সারাজীবন পড়াশোনা করে, জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে বড় ডাক্তার হবার বাসনায় ডিগ্রির প্রয়োজনে বিনা পয়সায় দিন-রাত মিলিয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে ৪৮ ঘন্টা ডিউটি করে প্রফেসর হবার পরেও আপনার মতে হালাল উপায়ে টাকা উপার্জন করার মাধ্যমে মাস শেষে ৮৩,২০০/= টাকা উপার্জন করছেন।
এবার আপনিই বলুন, আপনি ডাক্তার হলে সহ্য করতে পারতেন?
বাংলাদেশে রোগী অনেক বেশি। এটা যেমন ঠিক, তেমনি অধিকাংশ রোগী এমবিবিএস ডাক্তারদের কাছে আসে না – এটাও ঠিক।
৫০ ভাগ যায় গ্রাম্য কোয়াক বা ঔষধের দোকানির কাছে, যার নাই কোন এমবিবিএস সার্টিফিকেট। অতীতে কোন বড় ডাক্তারের চেম্বারে ১ বছর কাজ করে নিজেই ডাক্তার পরিচয়ে রোগী দেখে।
বাকী ৫০ ভাগের মধ্যে কিছু যায় কবিরাজ ফকির দরবেশের কাছে, পানি পড়া খেতে।
কিছু যায় হোমিও পুরিয়া খেতে, যে হোমিওপ্যাথি বিদ্যার মূলনীতিতেই গণ্ডগোল।
আর কিছু নিজেই ওস্তাদি করে ব্যাথার ঔষধ (লাল বড়ি) গেলে মুড়ি মুড়কির মত। ফলাফল, দুদিন বাদে আলসার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে আসল ডাক্তারের চেম্বারে।
আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন, মোটামুটি ২০ ভাগ মানুষ রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই একজন এমবিবিএস বা বিডিএস ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
এখন আপনিই বলুন, ডাক্তার কম, রোগী বেশি, তাই ডাক্তাররা কম টাকা নিলেই পারে – নীতি বাস্তবে সম্ভব কি না।
তাহলে কি গরীবরা বিনা চিকিৎসায় মরবে?
কে বলেছে, গরীবরা বিনা চিকিৎসায় মরছে।
গরীবরা বিনা চিকিৎসায় মরলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কোনদিন ১০ কোটির বেশিই হত না। এই দেশে রোগবালাই এত বেশি, আর মানুষ নিজের শরীর সম্পর্কে এত অজ্ঞ যে প্রতিনিয়ত নিজের শরীরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে, জেনে বা না জেনে।
দেশের ৯৫% পুরুষ ধূমপান করে। ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ প্রোটিন কম খেয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভাত খায়। বাল্যবিবাহ, কম বয়সে বাচ্চা নেওয়া, ২ এর অধিক বাচ্চা নেওয়া ইত্যাদি শত শত কারণে এদেশে রোগবালাই বেশি।
তবুও মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে।
কোথায় পাচ্ছে জানেন?
আপনি হয়ত জানেনই না। সরকারী হাসপাতালে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে বিশেষজ্ঞ চিকিতসককে দেখানো যায়। ১৫ টাকা দিয়ে ফর্ম কিনে ভর্তি থাকা যায় রোগ ভালো না হওয়া পর্যন্ত। সাথে ৩ বেলা খাওয়াও পাওয়া যায়।
ইন্টার্ন, এইচ এম ও (অনারারি মেডিকেল অফিসার), আই এম ও, সি এ – এই পদবীর ছোট ডাক্তারদের হাসপাতালের গলদঘর্ম কর্মকাণ্ড দেখেছেন কেউ?
এসব তো চোখে পড়বে না। পড়লে ডাক্তারদের দোষ দেবার কোন ছুতা পাবেন কিভাবে?
চোখে পড়বে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন প্রফেসর লেভেল এর ডাক্তারদের ৫০০ টাকা।
কে বলেছে আপনাকে তাদের কাছে যেতে? আপনি যাবেন না। না গেলে কেউ তো জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। আপনি তবুও যাবেন।
কারণ, আপনার একটা সামাজিক মর্যাদা আছে না? স্কয়ার হাসপাতালে ফোঁড়া না কাটালে আপনার জাত নষ্ট হয়ে যাবে যে!
আর বাসায় এসে হাজার হাজার টাকা বিল দেবার দুঃখ না ভুলতে পেরে ডাক্তারদের নিয়ে ফেসবুকে না লিখলে তো জাতে ওঠা যাবে না।
যে সিজারিয়ান সেকশান (খাটি বাংলায় সিজার!) করতে ঢাকার বড় বড় হাসপাতালগুলো এই বিল ওই বিল মিলিয়ে রাখে লক্ষাধিক টাকা, সেই সব বিলের সেবার ন্যূনতম মান ধরে রেখেই সরকারী হাসপাতালে একই অপারেশানে খরচ হয় মাত্র ৫ হাজার টাকা, তাও ঔষধ-পথ্য বাবদ।
কেন যান ৫০০-১০০০ টাকা দিতে? আপনি না গেলে তো তারা রোগী পাবে না। তারা তো না খেয়ে মরবে। তাদের পাতে মারার সুযোগ আপনিই নষ্ট করছেন।
আজ থেকে মানসিকতা বদলান। সামান্য সর্দিজ্বরে আপনার পাশের এমবিবিএস ডাক্তার যে চিকিৎসা দিবে, একজন প্রফেসর তার চেয়ে খুব বেশি ভালো চিকিৎসা দিবে না।
কোন এমবিবিএস ডাক্তার যদি মনে করেন, আপনার আরো ভালো ডাক্তার প্রয়োজন, তবে তিনিই আপনাকে তা বলবেন। এইটুকু মানবিকতা সবারই আছে। আমরা বাঙালি না? ভুলে যান কেন?
আর যদি এতকিছু জানার পরেও এক লাফে তালগাছে ওঠার মত ডাইরেক্ট প্রফেসরকে সর্দিজ্বরের চিকিৎসা দিতে বলেন, তবে তিনি ১ মিনিটে ১০০০ টাকা নিলেও আপনার কোন অধিকার নাই, এর বিরুদ্ধে কিছু বলার।
কারণ, আপনি নিজের ইচ্ছায় তার কাছে টাকা দিতে গিয়েছেন। এই ১০০০ টাকা কিন্তু ১ মিনিটের মূল্য না। এই ১০০০ টাকা তার প্রতি আপনার বিশ্বাসের মূল্য, যা অর্জন করতে সেই প্রফেসরকে ৪০-৫০ বছর ঘাম ঝরাতে হয়েছে।
আর যদি রেফারড হয়ে যেতে হয়, তবে মনে রাখবেন, আপনার অসুখটা অনেক জটিল। তাই, এর কারণে টাকা খরচ হতেই পারে।
এই কাগুজে টাকা বাঁচাতে গিয়ে বিধাতার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার শরীরটাকে উৎসর্গ করবেন না দয়া করে।
লেখাঃ ডাঃ সুজন পাল।
পূর্বে প্রকাশিতঃ ফেসবুক ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:০৬