ভাইয়া, আমি কি এখানটায় একটু বসতে পারি ?
ঘার ফিরিয়ে পাশে তাকিয়ে সুন্দর মত একটা মেয়েকে দেখতে পায় মারুফ। কিছুটা বিরক্ত হয় সে । পার্কে এত জায়গা থাকতে মেয়েটার কেন এখানেই এসে বসতে হবে? পার্কের এই কোনার দিকে কোন মেয়ের একা আসার কথা না । হয়তো কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। হতে পারে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে এসেছে, এই খানেই তাদের দেখা করার কথা হয়তো , প্রেমিক ভাইজানের আসতে দেরি হচ্ছে বলে হয়তো এখানে। তাই বলে এখানে এই নদীর পারেই বসতে হবে ? আশ্চর্য!
আচ্ছা ঠিক আছে বসুন, সমস্যা নেই পার্কটা তো সবার জন্যই ।
ভেবেছিল পার্কের এই পাশটায় একটু বসে দু চারটা সিগারেট ফুকে মনটা একটু হালকা করবে সে। এই দিকে মানুষ জনের যাতায়াত একটু কম। মানুষ জনের হাউ কাউ একদম ভালো লাগছে না তার।
তার মনটা আজ ভিষন খারাপ। নীলা তার সাথে এমন করবে সে কখনো স্বপ্নেও ভাবে নি। কি নির্ধিদায় বলে দিল ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, ওর পক্ষে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। অথচ এতদিন কত স্বপ্নের জাল বুনেছিল তারা দুজন মিলে। কত কিছুই না ভাবতো তারা। কিভাবে সংসার সাজাবে , বাসাটা কেমন হবে, বাসার ডেকরেশান কি হবে তাই নিয়ে কত ছেলে মানুষি কথাই না বলতো নীলা। এমন কি তাদের ছেলে মেয়ের নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছিল তারা। গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মারুফের বুকের ভেতর থেকে । মারুফ ভাবতে পারে না, কি করে নীলা রাজি হলো বিয়েতে। ওর কথা একবারও ভাবলো না ? নীলাকে ছাড়া কিভাবে বেচে থাকবে সে ? সব কিছু অর্থহীন মনে হয় মারুফের কাছে। নিজেকে প্রতারিত প্রেমিক মনে হয় মারুফের । মনে আছে নীলা প্রায়ই বলতো ''আমাকে ভুলে যাবে না তো ? তোমাকে ছাড়া কিন্ত আমি বাচবো না '' মারুফ নীলার হাতটা শক্ত করে ধরতো তখন, বলতো, পাগলী কোথাকার আমি তোমাকে ভুলে যাবো কেন ? নিজেকে কি কখনো ভোলা যায় ? এক দিন মারুফের সাথে দেখা না হলে কথা না বললে অস্থির হয়ে যেত নীলা । অথচ কদিন ধরে দেখা করা দুরে থাক সে কোন কল করে না, মারুফ কল করলেও ভালো করে কথা বলে না। আজ তো সরাসরি বলেই দিল তাদের পথ এখন থেকে আলাদা। কি করবে এখন মারুফ ? তার মাথার ভেতরটা ফাকা মনে হচ্ছে, বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ বহু কষ্টে সামলাচ্ছে সে । এই জায়গাটা তাদের কতই না প্রিয় ছিল, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পার্ককে ঘিরে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানো ছিল তাদের সব থেকে প্রিয় একটা কাজ , নীলা নৌকায় চড়লেই তার পা পানিতে নামিয়ে দিত , কি যে খুশি হত সে, কত ছেলে মানুষী করতো ! কি করে ভুলবে মারুফ , সে সব ? অথচ নীলার একটুও গলা কাপলো না তার বিয়ের কথাটা বলতে । আর কটা দিনই তো ছিল, রেজাল্ট টা হয়ে গেলে মারুফ ও নিশ্চই কিছু একটা করতো। আর কটা দিন কি ধৈর্য ধরতে পারতো না সে ?
ভাইয়া আপনার মনটা খুব বেশি খারাপ তাইনা ?
প্রশ্ন শুনে চমকে তাকায় মারুফ। মেয়েটা তার পাশেই কিছুটা দুরে বসে আছে । ভুলেই গিয়েছিল মারুফ। অবাক হয়ে যায় মারুফ ,মেয়েটা তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে ।
জ্বি ? আমাকে বলছেন ?
হ্যা ভাইয়া আপনার মনটা মনে হয় খুব বেশি খারাপ তাইনা ?
কি বলবে ভেবে পায়না মারুফ। কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগে সে । তার মন খারাপ তাতে এই মেয়েটার কি ? আশ্চর্য তো !
আচ্ছা আপনি কি কারো জন্যে অপেক্ষা করছেন এখানে ?
না ।
মারুফ এবার সত্যি খুব অবাক হয় । মেয়েটাকে দেখে খারাপ কিছু মনে হচ্ছে না তার, ভদ্র মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। মেয়েটা দেখতেও খুব নজরকারা সুন্দর যাকে বলে, সে রকম । নীলাও অনেক সুন্দর ছিল । কথায় বলে মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দিত হয়ো না। মনে মনে ভাবে মারুফ।
মেয়েটা হঠাৎ এই প্রশ্ন করলো কেন? কারো জন্য অপেক্ষা না করলে এখানে বসে আছে কেন সে ? যাই হোক সেটা তার ইচ্ছা।
এই জায়গাটা অনেক সুন্দর তাইনা ভাইয়া ?
জ্বি .. ভালো করে তাকায় মারুফ । মেয়েটা কি তার পূর্ব পরিচিত ? মনে তো হচ্ছে না , আগে কোথাও দেখেছে বলেও তো মনে পড়ছে না।
হয়তো একাই এসেছে পার্কে কথা বলার মানুষ খুজে পাচ্ছে না বলে যেচে কথা বলছে । কিন্তু মারুফের এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখের উপর বলে দিতে পারছে না মারুফ ।
ভাইয়া আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন ?
করুন মুখের দিকে চেয়ে মনের কথাটা বলতে পারছে না সে , মুখে বললো না না বিরক্ত হবো কেন ?
ভাইয়া জায়গা টা অনেক সুন্দর এখানে বসলে সবার মন ভালো হওয়ার কথা কিন্তু আপনার মন খুব খারাপ।
আরে বড় জ্বালা হল তো , মেয়েটা অ্যাস্টোলোজার নাকি ?
হ্যা আমার মন কিছুটা খারাপই। নিরাসক্ত কন্ঠে কথাটা বলেই নদীর দিকে তাকায় মারুফ ।
মানুষ নদীর মত না ।
আরে এ দেখি দার্শনিক কথাও বলে আবার ! মারুফ কিছুটা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটার দিকে।
মানুষের মন পরীদের মতো কোমল না। মানুষ মানুষের সাথে প্রতারনা করে,মিথ্যা বলে, সামান্য স্বার্থে ছেড়ে চলে যায়। অবশ্য জীবন কারো জন্যেই থেমে থাকে না জীবনটা কিন্তু নদীর মতই বয়ে চলে । তবে আপনি খুব ভালো মানুষ আপনার মন অনেক কোমল পরিদের মতো।
মারুফ এবার পুরাই অবাক ! বলে কি মেয়েটা? মেয়েটা কি অন্য কিছু মিন করছে নাকি ..? মারুফের কেমন জানি মনে হচ্ছে সব ।
আচ্ছা আপনি কে বলুন তো ?
আমি পরী, মেয়েটা জবাব দেয়।
ও আচ্ছা আপনার নাম পরী। আপনি কি করেন , কোথায় থাকেন ?
আরেক দিন বলবো আপনার বন্ধুরা এদিকেই আসছে । মারুফ পিছন ফিরে তাকায় শিমুল, অপু আর সৈকত এদিকেই আসছে ওকে দেখে ওরা চেচিয়ে ওঠে দোস্ত তুমি এইখানে ? আমরা তোমারে সারা পার্ক ধইরা খুজতাছি। একলা একলা কি করো এইখানে বসে ? নদীর ঢেউ গোনো ? তোমার পাখি কই ?
মারুফ কিছুটা হতাশ হয়, এসে পড়েছে সব হৈ হৈ পার্টির সদস্যরা ।
এইতো বসে আছি পরী আপুর সাথে গল্প করছি । তোদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ইনি হচ্ছেন. ..
আরে উনি কোথায় গেলেন ?
উনি আবার কে ? শিমুল জিজ্ঞেস করে ।
এখানেই তো ছিলেন এই তো পাশেই বসা ছিলেন। কিছু না বলে গেলেন কোথায় ? এক মুহুর্তের মধ্যে ? আশে পাশে যতদুর চোখ যায় কাউকেই তো দেখছি না ?
কি কও দোস্ত আমরা তো কাউরেই যাইতে দেখলাম না ?
কি বলিস ? আমার পাশেইতো বসা ছিলেন কেন তোরা দেখিস নি ?
কই নাতো। তোমার মাথা কি পুরাই গেলগা নাকি ?
নীলা কই নীলারে তো দেখতাছিনা ? একা একা তো তোমারে কোনদিন পার্কে দেখি নাই জোড়া ছাড়াতো তোমরা বাইর হও না । আইজ একলা একলা যে ?
মারুফের মুখটা বিমর্ষ হয়ে যায়। দোস্ত নীলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ।ওর সাথে আমকে আর কখনো দেখবি না দোস্ত ।
কও কি ? তোমাদের প্রেম ও টিকলো না ? অবাক হয় অপু। আমি আগেই কইছিলাম মেয়ে মানুষের মন কচুপাতার পানি । দুঃখ জনক দোস্ত । তোমারে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নাই। তোমার মন খুব খারাপ বুঝতে পারতাছি। চলো দোস্ত বাসায় যাইগা।
হ্যা চল। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না, উনি গেলেন কোথায় ?
আরে ধুর ! হেলুসিনেশন হইছে তোমার। অতি কষ্টে এমন হইতে পারে ।
কি জানি হতেও পারে। কিন্তু শিমুলরা যে আসছিল তাতো পরীই আগে বলে দিয়েছিলেন । কিছুই মেলাতে পারছে না মারুফ ।
এতো রাতে কে কল করলো আবার? শিমুল কিছুটা বিরক্ত হয়ে মোবাইল টা হাতে নেয়। মারুফের কল এতো রাতে ! কি ব্যাপার ? হ্যালো দোস্ত কি ব্যাপার ?
অপর প্রান্ত থেকে মারুফের কন্ঠ শোনা যায়। হ্যালো দোস্ত শিমুল। সরি দোস্ত এত রাতে কল করার জন্য। দোস্ত একটা বিষয় তোমার কাছে জানার জন্য কল করলাম।
কি বিষয় ? কও ..
মানে ইয়ে , তুমি একদিন বলছিলা না তোমার এক চাচা আছে যারে পরীতে ধরছে .....
হ্যা লাবলু চাচা। তো কি হইছে ?
আচ্ছা উনাকে কি ভাবে পরীতে ধরলো একটু বলবা ? সেই দিনতো পুরাটা বলনি ।
আরে কিসের পরীতে ধরবো হয়তো কোন মেয়ের লগে প্রেম কইরা ধরা খাইছে হের পর আর বিয়া করে না বিয়ার কথা কইলেই কয় তার নাকি বিয়া হইয়া গেছে এক পরীর লগে । আরে সব ভুয়া। সব বিয়া না করার ফন্দি। কিন্তু তুমি পরী ফরী নিয়া পড়লা কেন ? ও বুঝছি ঐ পার্কের ব্যাপার টা না ? আরে দোস্ত তুমি হইলা এই যুগের পোলা এই সব পরী ফরী নিয়া মাথা ঘামানো তোমার মানায় না। ঘুমাও দোস্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কাইল নীলার লগে কথা কমুনে। প্রয়োজনে ওদের বাসায় যামু নো চিন্তা এখন ঘুমাও। আগামীকাল কলেজে দেখা হইবো।
নীলা আর ফিরে আসবে না দোস্ত ওর সাথে কথা বলার দরকার নেই। ওকে রাখি দোস্ত , বাই। মারুফ ফোন রেখে দেয়।
এরপর সব কিছুই চলছে স্বাভাবিক ভাবেই। নীলার বিয়ে হয়ে গেছে এক ডাক্তার ছেলের সাথে। স্বামী সংসার নিয়ে সে সুখেই আছে। কোথাও কোন ঝামেলা নেই শুধু মাঝে মাঝে শিমুল খুব অবাক হয় প্রতি দিন বিকালে যখন মারুফ পার্কে গিয়ে সেই যায়গাটায় বসে থাকে যেখানে মারুফের সাথে পরীর দেখা হয়েছিল । মারুফকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে প্রতিদিন ওখানে গিয়ে কি করিস ?
মারুফ উ্ত্তর দিয়ে ছিল পরীর সাথে দেখা করি।
শিমুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল দেখা করিস মানে ?
মারুফের খুব স্বাভাবিক উত্তর, হ্যা দেখা করি ও খুব ভালো মেয়ে ।
শিমুল চোখ কপালে তুলে বলেছিল বলিস কি, খুব ভালো মেয়ে ? আবার প্রেম টেম করে ফেলিস নি তো ?
মারুফ কিছু না বলে খালি মিটি মিটি হাসে। শিমুলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। শিমুল মারুফের হাত খপ করে ধরে বলে, দোস্ত আমার সাথে চল আমি তোরে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়া যামু ,সব ঠিক হয়ে যাবে।
মারুফও অবাক হয়। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কেন ? আমার তো কিছুই হয়নি তুই কি ভাবছিস আমি পাগল হয়ে গেছি ?
শিমুল কিছু বলতে পারে না, করুন চোখে বন্ধুর মুখের দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে শুধু।
মারুফ এমনিতে সব কিছুতেই স্বাভাবিক খালি প্রায়ই বিকাল বেলা পার্কের সেই জায়গাটায় গিয়ে বসে থাকে আর অদৃশ্য কার সাথে যেন কথা বলে।
আপনারা যদি কেউ ময়মনসিংহ যান আর বিকালে পার্কে যান তাহলে হয়তো দেখতে পাবেন পার্কের একে বারে পশ্চিম সাইটে জয়নুল গেলারির পিছনে যে বটগাছটা আছে তার পাশেই নদীর পারে বসে একটা ছেলে অদৃশ্য কার সাথে যেন গল্প করছে, কখনো হাসছে, আবার মনে হবে কারো সাথে যেন খুন সুটি করছে । তবে একটা অনুরোধ ওদের কে কেউ ডিস্টার্ব করবেন না। প্লিজ ..
......................
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৩৭