বাস থেকে নেমে শফিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো…এমন ভিড়!! মানুষগুলো এক্কেবারে ঘাড়ের ওপরে শ্বাস ফেলছিলো। অনেক দিন, প্রায় বছর দুয়েক পরে ও বটতলাপুরে এলো। দাদু থাকেন এখানে। বাবা শহরে পাড়ি জমালেও দাদু সেই পুরোনো ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছেন। মানুষটার মনের জোর অনেক। আটাত্তুর বছর বয়সে একা একা এই অজপাড়া গাঁয়ে পড়ে থাকা...সাথে শুধু রমিজ কাকা। ঘরদোর-রান্নাবান্না, দাদুর দেখভাল সব রমিজ কাকাই সামাল দেন।
অনেকদিন থেকেই শফিক আসবে আসবে করছিলো। অফিস থেকে ছুটি পাওয়াই ভার!! শেষমেশ রবিবার ছুটি পাওয়া গেলো। শুক্রশনি মিলিয়ে দাদুর কাছে তিনদিন থাকবে। অফিস থেকে আজ একটু আগেই বেরিয়ে বাসে উঠেছে। রাত নয়টার মধ্যেই বটতলাপুরে পৌঁছে যাওয়ার কথা…আর এখন বাজে রাত পোনে বারোটা!! রাস্তায় এমন ট্রাফিক জ্যাম। সপ্তাহান্তে ছুটি পেতেই সবাই নিজ নিজ বটতলাপুরে ছুটেছে নিশ্চয়ই।
নামিয়ে দিয়েই তড়িঘড়ি করে বাসটা চলে গেলো…একগাদা ধুলো আর কালচে ধোয়া!! “শালা!! হারামী…” গায়ের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিড় বিড় করে বাসের উদ্দেশ্যে আরো কিছু অশ্রাব্য খিস্তি আওড়ালো শফিক। গ্রামের নাম যে বটতলার নামে সেখানেই বাসস্ট্যান্ড। আশেপাশে দু’একটা চায়ের দোকান, ভাতের দোকান থাকলেও সেগুলো এতো রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। বটের ঝুড়ি বেয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে…চারপাশ একদম সুনসান!! শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক…বাসের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই চারপাশের নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে চেপে বসলো। আচমকা এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। শফিক ফুল শার্টের গোটানো হাতা টেনে কব্জি ঢাকলো। কি আশ্চর্য!! শীত শীত লাগছে…এই সময়ে ঢাকায় শীতের ছিটেফোঁটাও নেই।
কাঁধের ব্যাকপ্যাকের স্ট্র্যাপটা ঠিক করে নিয়ে শফিক হতাশ চোখে আশেপাশে তাকালো। রিক্সাতো দূরের কথা, জনমানিষ্যির কোন চিহ্ন নেই। দাদুকে সারপ্রাইজ দেবে বলে জানায়নি। নাহলে দাদু রিক্সা বা অন্য কোন যানবাহনের ব্যবস্থা করে রাখতেন। বাসা অবশ্য বাস স্ট্যান্ড থেকে বেশী দূরে নয়। বটতলা আর দাদুর বাসার মাঝে এলাকার কবরস্থান। কবরস্থানের পাশের রাস্তা দিয়ে রিক্সাতে যেতে মাত্র কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় লাগে।
“যাকগে…হেটেই চলে যেতে পারবো…” এই নির্জনে নিজের কথা শুনে নিজেই চমকে উঠলো শফিক। একটু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে হাঁটা শুরু করলো ও। কয়েক পা হেঁটেই শফিক থমকে দাঁড়ালো “আজব!! এই কথাটা আমার আগে কেন মনে হয়নি…” কবরস্থানের মাঝ বরাবর পায়ে হাঁটা সরু পথটা ধরলে প্রায় পনেরো মিনিট বেঁচে যায়।
“কিন্তু ওখানে যদি ভূতপ্রেত থাকে…” ভাবনাটা মাথায় আসতেই ফিক করে হেসে ফেললো শফিক। মনিরের কথা মনে পড়লো…বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওর রুমমেট ছিলো। এমন সব গাঁজাখুরি ভুত-প্রেত-আত্মার গল্প করতো…বেচারা কিন্তু আসলেই বিশ্বাস করতো আর ওরা সব বন্ধুরা গল্প শুনে কি হাসাহাসি!!
বড় রাস্তা ছেড়ে শফিক করবস্থানের মেঠো পথ ধরলো। ভুত-প্রেতে ওর মোটেও বিশ্বাস নেই...কিন্তু আলকাতরা অন্ধকারের সাথে গাঢ় নির্জনতা আর শীত শীত হাওয়া মিশে কেমন যেন একটা অতিপ্রাকৃত পরিবেশ!! শফিকের গা ছম ছম করছে। প্রায় দশ গজ এগিয়ে একবার ভাবলো “বড় রাস্তায় ফিরে যাবো নাকি?? ধূর...যত্তোসব আজেবাজে কথা ভাবছি...ভুত বলে কিচ্ছু নেই...”
শফিক গুনগুণ করে গান শুরু করলো “বন্ধু তুই লোকাল বাস...” ঠিক ভয় লাগছিলো না। আর ভুত-প্রেত নয়, ভুত-প্রেতের চিন্তা মাথা থেকে দূর করার জন্যেই গান গাওয়া। চারপাশে এখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও নেই। ও নিজের পায়ের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলো...এখানে ওখানে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপরে পা পড়তেই মচমচিয়ে উঠছিলো।
হঠাতই শফিক গান থামিয়ে দিলো “কেউ কি আমার পেছন পেছন আসছে? নূপুর পরা পা...টুং টাং...টুং টাং!!”
হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। শফিক পেছন ফিরে দেখলো “কই কেউ নেই তো...” পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোনের টর্চলাইট জ্বালালো। ডানে বামে সামনে পেছনে ফোনের আলো ফেলে দেখলো। আলোর ত্রিভুজ ফানেলে কিচ্ছু নেই, কেউ নেই...শুধুই নিখাদ অন্ধকার!! আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফেলে শফিক আবারো হাঁটতে শুরু করলো...এবার একটু দ্রুত লয়ে।
আবারো সেই শব্দ...নুপুরের টুং টাং...শফিক থামলো, সাথে সাথে শব্দটাও থেমে গেলো। ওর বুক প্রচন্ড ধড়ফড় করছে...তারপরেও ধীরে ধীরে পেছন ঘুরে দেখলো। কেউ নেই। ”ওই যে দুরে...ওইখানে কি নড়ছে...” শফিকের হৃৎপিণ্ড এক লাফে গলার কাছে চলে এসেছে। মোবাইলের আলো ফেলতেই “নাহ!! ছেড়া শাদা একটা পলিথিনের টুকরো দূরে গাছের ডালে আটকে আছে...বাতাসে অল্প অল্প উড়ছে...”
শফিক জোরে ঢোঁক গিললো...জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠান্ডা ঠোঁট ভিজিয়েই জোর কদমে, প্রায় দৌড়ের ভঙ্গীতেই করবস্থানের শেষ বরাবর হাঁটা শুরু করলো। এখন ও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে...টুং টাং টুং টাং...শব্দটাও জোরেসোরে হাটছে..একদম ঠিক ওর পেছনে।
এখন আর শফিকের পেছন ফিরে তাকানোর সাহস নেই...ও দৌড়াতে শুরু করলো।
জিনিষটা যাই হোক...সেটাও দৌড়াচ্ছে এখন...একদম শফিকের পেছনে...খুব কাছাকাছি...টুং টাং...টুং টাং...টুং টাং...
শফিক হাঁপাচ্ছিলো...কিন্তু ও থামেনি...আর ওর পেছনের নূপুর পড়া পায়েরাও...ছন্দে ছন্দে সেই শব্দ ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছিলো।
টুং টাং...টুং টাং...টুং টাং... টুং টাং...টুং টাং..
দৌড়াতে দৌড়াতে ও বুঝতেও পারেনি কখন ও দাদুর বাসার দরজায় পৌঁছে গেছে। ওই অশরীরী শব্দ দরজা পর্যন্ত ওর পেছনে পেছনে এসেছে।
দরজায় জোরে জোরে কয়েকটা ধাক্কা দিয়েই শফিক অজ্ঞান হয়ে গেলো।
পরের দিন সকালে চোখ মেলে প্রথমে শফিক বুঝতেই পারেনি ও কোথায়। টিনের ছাদের দিকে চোখ পড়তেই সব মনে পড়লো, গত রাত্রের বিভীষিকার কথাও। জ্ঞান হারাতেই ভয়টা থেমে গিয়েছিলো...মনে পড়তেই এখন ভয় আবারো ওকে গ্রাস করলো...ঠিক সিনেমা দেখার সময়ে রিমোট দিয়ে পজ করার মতো। ভয়ে একটু কেঁপে উঠতেই পাশে থেকে দাদুর স্নেহমাখা কন্ঠস্বর “কি রে বুড়ো? কেমন আছিস?” এই মানুষটা শফিককে আদর করে ‘বুড়ো’ ডাকে।
- ঠিক আছি...কিন্তু প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে...উহহ!!
- থাক থাক!! উঠে বাসার দরকার নেই...মাথা ব্যাথাতো হবেই...তোর যে আকাশ পাতাল জ্বর!! ভোরবেলায় আজিজ ডাক্তার এসে দেখে গেছে। এখন শুধু ওষুধ খাওয়া আর বিশ্রাম। আগে বল কাল কি হয়েছিলো? অতো রাত্রে দরজা খুলে দেখি তুই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস...যা ভয় পেয়েছিলাম!! তুই যে আসবি সেটা আমাকে জানাসনি কেন বলতো?
শফিকের কাছে সব শোনার পরে দাদু খুব বিরক্ত “ভুত-প্রেত বলে কিছু নেই...তবে এতো রাতে অন্ধকারে অল্পতেই মন দুর্বল হয়ে যায়। নাহ!! আমাকে জানানো উচিত ছিলো যে তুই আসছিস...তাহলেই আর এইসব কান্ড হতো না। যাই হোক...এখন একটু কিছু মুখে দিয়ে ওষুধ খেয়ে নে...তারপর ঘুম!!”
দাদু চোখের আড়াল হতেই গরম দুধের গ্লাস রাখতে এসে রমিজ কাকা ফিসফিস করে বললো “কাল রাতের কথা শুইনলাম...এই গেরামের লোকমান কে তো চেনোই!! ওই বটগাছে লোকমানের পেত্থম বউটা মাস ছয়েক আগে ঝুলে গেছিলো...”
- ঝুলে গিয়েছিলো মানে কি?
- মানে আবার কি? আত্ম হইত্যা...ওই যে কি জানি বলে ইংরেজিতে শুইশাইড...যাগ গে সেই হতচ্ছাড়ী মাইয়া বিজলী রাতে বিরেতে বটতলা আর কবরস্থানের আশেপাশে ঘুইরে বেড়ায়...একা পাইলেই দৌড়ানি দেয়...একবারতো একজনরে দৌড়াইতে দৌড়াইতে সেই খালে নিয়া ফেলছে...
বলতে বলতে রমিজ কাকার চোখ আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসে “ছোটসাব...তোমার ওই রাস্তা দিয়া আসা একদমই ঠিক হয় নাই...চিন্তার কিছু নাই অবশ্য!! জানে বাইচা আছো এইটাই বড় বেপার...আমি কাইলই তোমারে মসজিদের ইমাম সাবের থেইকা তাবিজ আইনা দিমু...তাবিজটা হাতে বানলে ওই পেত্নী আর কিছু করতে পারবে না...”
বৃহস্পতিবার এসেছে। আজ রবিবার। ফিরতেই হবে, কাল অফিস আছে। তাছাড়া শরীরটা ঠিক হয়ে গেছে। ভয় চলে যাওয়ার সাথে সাথে জ্বরটাও নেমে গেছে। “ভয়ে তাহলে আসলেই জ্বর আসে...” ভাবতে ভাবতে আনমনে হাসলো শফিক। ইমাম সাহেবের কাছে থেকে তাবিজ এনে বাম হাতের কব্জিতে বেঁধে দিয়েছে রমিজ কাকা। দাদু বকতে গিয়েও সামলে নিয়েছেন “ভূত বলে কিছু নেই। তবে তুই যা ভয় পেয়েছিলি...এটা সাথে থাকলে যদি তোর ভয় কমে তবে পরে নে...কিন্তু মনে রাখিস ভুত-প্রেতের কোন অস্তিত্ব নেই...”
“মাস ছয়েকের মধ্যেই আরেকবার সময় করে দেখতে আসবো কথা দিচ্ছি...ভুত-প্রেতও আমাকে ঠেকাতে পারবে না...মন খারাপ কোর না ওল্ডম্যান...” দাদুর জল আসি-আসি চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো শফিক।
দুপুর বেলা। রিক্সা মোড় ঘুরতেই ঝমঝমে রোদে কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে ধুকপুক করে উঠলো শফিকের। সেই রাতের ভয়টা আবারো ফিরে আসছে। ও চোখ সরিয়ে সামনের রাস্তা, লোকজন, বাজারের দিকে মন দিলো।
- সাহেব...আপনারে নাকি বটতলার বিজলী পেত্নীতে ধরসিলো?
- ঠিক ধরতে পারে নাই...তবে পেছন পেছন বাসা পর্যন্ত গিয়েছিলো।
- আপনের ভাইগ্য ভালো...ওই ছেমড়ি যার ওপরে নজর দেয় তারে সহজে ছাড়ে না...আপনে কিন্তু ওই তাবিজ খবরদার খুইলেন না...খুইললেই সর্বনাশ!!
“হুম্মম...খুলবো না...মনে থাকবে...” রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বটতলায় নেমে পড়লো শফিক। পিঠের ওপরে ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে ও বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগুলো। বাস আসতে এখনো মিনিট কুড়ি বাকী।
টুং টাং...টুং টাং...
সেই শব্দে শফিকের হৃৎপিণ্ড মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। ও ঘুরে দাঁড়ালো...কেউ নেই। দিনের আলোতে করবস্থান ও আশপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চারপাশে লোকজন, চায়ের দোকান সরগরম, ভাত-ডালের দোকানে কোলাহল...সবকিছু স্বাভাবিক। কিছু নেই, কেউ নেই...নিশ্চয়ই শোনার ভুল। ও আবারো হাঁটা শুরু করলো।
টুং টাং...টুং টাং...
“ওহ মাই গড!! শব্দটা আবারো ফিরে এসেছে...এখন কি করি??” শফিক ফ্যাকাশে মুখে কব্জিতে বাঁধা তাবিজটা মুঠো করে ধরে। বিড়বিড় করে প্রাণপণে দোয়া পড়তে পড়তে ও বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসলো। পিঠ থেকে নামিয়ে ব্যাকপ্যাক খুললো। “পানির বোতলটা গেলো কই??” ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেছে।
পানির বোতলের জন্য ব্যাগের ভেতরটা হাতড়াতেই স্টেইনলেস ষ্টীলের ঝকঝকে টিফিনবাক্সটা উঠে এলো। বেঞ্চের ওপরে টিফিনবাক্সটা রাখতে যেতেই আবারো...
টুং টাং...টুং টাং...
টিফিনবাক্স খুলতেই ভেতরে চামুচ। শফিক হাতে চামুচটা দেখে আর হাসি থামাতে পারলো না “তোর জন্য আমার সেই রাতে প্রায় হার্ট এটাক হয়ে যাচ্ছিলো...ফাজিল চামুচ...” চামুচ হাতে ওর এমন উচ্ছসিত হাসি আর কথা বলা দেখে বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে মানুষজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। বটতলাপুরের মানুষগুলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো “আহারে!! ছেলেটা পাগল হয়ে গেলো...বিজলী পেত্নী যারে ধরে তার আর রেহাই নাই...”
একটু পরে বাস আসতেই শফিক জানালার পাশে সিট পেয়ে গেলো। আজ বাসে ভীড় কম। বাস যখন বটতলাপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে শফিক আবারো একটু হাসলো “এমন বোকা আমি...বরাবরই ওই শব্দটা চামুচের ছিলো...আর আমি রাতদুপুরে চামুচের শব্দকে ভূত ভেবে কি ভয়ই না পেয়েছি!!”
“পরের বার তোরে ছাইড়া দিমু না...সামনের বার ঠিক তোরে খালে নিয়া ফেলমু...হি হি হি” ভরদুপুরে হঠাতই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস...
টুং টাং...টুং টাং...
বটগাছের ছায়াময় অন্ধকারে ডালে বসে বিজলী পা দুলিয়ে হাসতেই নুপুর বেজে উঠলো...
© শিখা রহমান
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:২৪