আমাদের পাড়ার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। দোকানী খুব ভালো মানুষ; দোকানে আসা ক্রেতারাও সমাজের বিভিন্ন জাতি-পেশা-ধর্ম-বর্ণের প্রতিনিধিত্ব করেন। চায়ের দোকানে সময়ে-অসময়ে কাজের-অকাজের আড্ডা হয়; এর কথার বিপরীতে ও একটা কথা বলে, তার প্রতিযুক্তিতে অন্য কেউ বলে আরেকটা কথা। এভাবে চায়ের দোকানে আড্ডা চলতে থাকে।
এই আড্ডার নিয়মিত চরিত্র শমশের গাজী! তার নিজস্ব একটা ছোটখাটো দল আছে -- সেই দল খুব একটা ভারী না হলেও সদস্যরা দলনেতার প্রতি শতভাগ নিবেদিত।
সেদিন যেমন আমাদের গ্রামের দর্জী সালাম তরফরদারের গল্পের আড্ডায় বসে শমশের গাজী বললোঃ
এটা কোন গল্প হলো? সামন্তবাদী এমন গল্প আমি প্রতি রাতে দুই হালি প্রসব করি।
গাজীর কথাটা মাটিতে পরতে বাকী তার আগেই তার এক মোসাহেব পাড়ার নাপিত আক্কাস বললোঃ
গরুজী যেহেতু বলেছেন তিনি অবশ্যই এমন গল্প দু‘ চার হালি প্রসব করতে পারেন। উনি সর্বদাই গল্পের প্রসব বেদনায় কাতর থাকেন।
নাপিত আক্কাস আমাদের পাড়ায় জোকার হিসেবে পরিচিত। সে যেহেতু নাপিত তাই তার মতে সবাইকে দাড়ি গোফ কামিয়ে ক্লিন শেভ থাকতে হবে; শুধু ক্লিন শেভ থাকলেই নাকি মানুষের ব্যক্তিত্ব থাকে, মানুষকে ক্লাসি লাগে। তার পকেট ভর্তি ক্লিন শেভ করা মানুষের ছবি থাকে আর সে কারণে অকারণে সেই ছবি মানুষকে দেখিয়ে বেড়াবে। তার মতে ক্লিন শেভ করা মানুষের সাথে পরিচয় থাকা, তাদের ছবি অন্যদের দেখিয়ে বেড়ানোটা এক ধরণের এচিভমেন্ট, এতে নিজের সামাজিক অবস্থান উচুতে ওঠে। অন্যরা ভাবে আহারে ঐ নাপিতের এমন ক্লিন শেভ লোকের সাথে পরিচয় আর আমার খুর আর কসকো সাবান কেনার টেকাটুকা নাই।
একদিন চায়ের দোকানে সবাই আড্ডা দিচ্ছে ডিমের দাম বেড়ে গিয়েছে এ বিষয়ে। শমশের গাজী যথারীতি নাক গলালো সেই আলোচনায়ঃ
“ডিমের দাম বেশি তো কি হইছে? আমি নিজের ডিম নিজেই পেরে ওমলেট বানায়ে খাই।“
আড্ডায় উপস্থিত বেশিরভাগ লোক এ কথা শুনে এর দিকে ওর দিকে তাকাচ্ছে যখন তখন নাপিত আক্কাস বলে বসলোঃ
“হ্যা, গরুকে আমি নিজ চোখে ডিম পারতে দেখেছি। কি সোন্দর সেই ডিম, খেতেও কি অপূর্ব স্বাদ। এই ডিম যারা খায়নি তারা ক্লিন শেভের বিপক্ষ শক্তি।“
নাপিত সাহেবের কথা শেষ হতে না হতে আড্ডায় হাজির হলো আমাদের গ্রামের সুপরিচিত সিঁদেল চোর বক্কর খাঁ। ব্ক্কর হচ্ছে শমশের গাজীর সবচেয়ে পুরোনো ও নিবেদিত প্রান চ্যালা। পাড়ায় গল্প প্রচলিত যে বক্কর আশায় আছে কোন একদিন শমশের গাজী তাকে শহরে নিয়ে যাবে।
যাহোক, বক্কর এসেই বললো ডিমের দাম বাড়ার মূল কারণ ধার্মীক লোকজন। লোকজন ধর্ম কর্ম বাদ দিলেই ডিমের দাম আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর তার গরুকে কষ্ট করে ডিম পারতে হবেনা। সে আরো বললো দেশটা চোর চোট্টায় ভরে গেছে। লোকজন দূর্নীতি করে অন্যের ঘরে সিঁদ কেটে ডিম নিয়ে যাচ্ছে।
বক্করের এই কথায় শমশের খুশি হয়ে বললোঃ
“বক্কর ঠিক বলেছে। ডিম পারা লোকজনকে সৎ হতে হয়, ব্যক্তিত্ববান হতে হয়।“
বক্কর গাজীর কথার বিপরীতে বললোঃ
“আমার কথায় সায় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!”
আমাদের সেদিনের আড্ডা প্রায় ভেঙে গেলো। আমরা যে যার বাসায় ফিরে গেলাম। আক্কাস নাপিত লোকের দাড়ি গোঁফ কামাতে চলে গেল। বক্কর চোরা গেল তার নেক্সট এসাইনমেন্টে। শমশের গাজী চায়ের দোকানেই বসে রইলো...
ছবিঃ আমার তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:০১