যুগে যুগে দেবদাস
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিন দেশে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবদাস’ নিয়ে ১১টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। মূল বিষয়বস্তুর ঠিক রেখে তিন দেশের পরিচালকই ‘দেবদাস’কে নতুন রঙে এঁকেছেন। এ কাজে কেউ কেউ সফলও হয়েছেন ‘দেবদাস’। তবে সবার সফলতার ‘দেবদাস’এর চেয়ে একটু উজ্জ্বল যেন চাষী নজরুল ইসলামের। বরেণ্য এই নির্মাতা দ্বিতীয়বারের মতো ‘দেবদাস’ নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। যুগে যুগে দেবদাসের নির্মাণ নিয়ে লিখেছেন রকিব হোসেন
সাহিত্যের আবেদন কালজয়ী। সময়ের কোন সুতোয়ই তা বাঁধা যায় না। আমাদের বাংলা সাহিত্যের মাঝে মানুষ বরাবরই খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্ন, সম্ভাবনা, ভাললাগাময় নানা আবেগ ও অনুভূতির জীবনছবি। সাহিত্যের রঙ আমাদের জীবনের প্রতিটি ভাঁজে মিশে আছে। বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি খ্যাতিমান কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্রচট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ দুই বাংলার অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের কষ্ট ছোঁয়া আকুতিকে প্রকাশ করেছে ভিন্নভাবে। বাংলা সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ প্রেমের উপন্যাস হিসেবে ‘দেবদাস’ এখনো সবার কাছে সমান আবেদন নিয়ে হাজির হয়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দেবদাসের অপ্রত্যাশিত প্রায়াণই বোধকরি ‘দেবদাস’ উপন্যাসকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। দেবদাসের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ভালোবাসা, এ উপন্যাস পড়ার সময় প্রতিটি মানুষের দেবদাস, চন্দ্রমুখী ও পার্বতী হয়ে ওঠার ভাললাগা এবং বিরহ বেদনাকে উপজীব্য করে যুগ যুগ ধরে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। তবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দুই বাংলার জনপ্রিয় বাংলা লেখক হলেও তার ‘দেবদাস’ নিয়ে প্রথম ছবি নির্মিত হয় ১৯২৮ সালে। এটা ছিল তামিল ভাষায়, ছবিটি পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। ১৯৩৫ সালে অভিনেতা প্রযোজক পরিচালক প্রমথেশ বড় য়া দেবদাস নির্মাণ করেন। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি এ ছবিতে ‘দেবদাস’ এর ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। এর পর পর দু’বছর প্রমথেশ বড় য়া আবার দেবদাস নিয়ে চলচ্চিত্রে নির্মাণ করেন। ১৯৩৬ সালে নির্মিত ‘দেবদাস’ এর ‘দেবদাস’ এর ভূমিকা অভিনয় করে কে এল সায়গল এতই সফলতা পেয়েছিলেন যে পরবর্তী সময়ে দেবদাস নামের নদীতে ডুবে যায় তার আসল নামের তরী। ১৯৫৩ সালে তেলেগু ভাষায় দেবদাস নির্মাণ করেন ভেদান্তম রাগাভাইশ। তেলেগু ছবির দর্শকরা ওই ছবির নাম দেবদাসের পরিবর্তে ‘দেবদাস্যু’ উচ্চারণ করেন। মূলত দেবদাস স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে ১৯৫৫ সালে। সেসময় ভারতের আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে দেবদাস। ওই বছর হিন্দী ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ভারতের সব বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এ ছবিটি পরিচালনা করেন বিমল রায়। এতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেন তৎকালীন হিন্দী সিনেমার বরপুত্র দিলীপ কুমার এবং পার্বতী চরিত্রে রূপদান করেন বাংলা চলচ্চিত্রের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেন। বৈজয়ন্তীমালা অভিনয় করেন চন্দ্রমুখী চরিত্রে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানে ‘দেবদাস’ ছবি নির্মিত হয়। এটি পরিচালনা করে সরফরাজ। ১৯৭৯ সালে আবার কলকাতায় ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন দীলিপ রায়। তখন উত্তম-সুচিত্রা ক্যারিয়ার শেষের দিকে ছিল বলে লাইমলাইটে থাকা সৌমিত্রকে দেবদাস, সুমিত্রা মুখার্জিকে পার্বতী, সুপ্রিয়া চৌধুরীকে চন্দ্রমুখী এবং উত্তম কুমারকে চুনিলাল চরিত্রে কাস্ট করা হয়। দীলিপ কুমার অভিনীত হিন্দী দেবদাসের দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর এ ছবিটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। ওই বছরই বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ প্রযোজকের ‘দেবদাস’ নির্মাণের উদ্যোগে শামিল হন ‘ওরা এগার জন’ ছবি খ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। কিছুটা কাঠখড় পুড়িয়ে চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৮২ সালে তার ‘দেবদাস’ নির্মাণ শেষ করেন। এ ছবিতে দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেন চির সবুজ নায়ক বুলবুল আহমেদ, চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় আনোয়ারা এবং চুনিলালের সাজে নায়করাজ রাজ্জাক। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দেবদাস’ মুক্তির পরই দুই বাংলায় আমাদের ‘দেবদাস’ নিয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীসহ সিনেমা বোদ্ধামহলে প্রশংসার ঝড় বয়ে যায়। ২০০২ সালে শক্তি সামন্তের পরিচালনায় কলকাতায় নির্মিত ‘দেবদাস’ তেমন আলোচনায় আসতে পারেনি। তবে একই বছর হিন্দী ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’ নিয়ে এক মহাষজ্ঞ শুরু হয়। এবার শত কোটি টাকা ব্যয়ে শাহরুখ, ঐশ্বরিয়া রায় এবং মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন সঞ্জয় লীলা বানসালী। বড় বড় তারকা ও বিশাল বাজেটের এই ‘দেবদাস’ দেখে দর্শকদের প্রত্যশার খানিকটা অপূর্ণই রয়ে গেছে।
দেবদাস এখন
বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র সমালোচকদের অনেকেই চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’ প্রকৃত দেবদাসের চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৮২ সালে তাদের কেউ কেউ তখন বলেছেন, চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত দেবদাস-এ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের যে সততা বজায় রাখা হয়েছে তা আর কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। সাফল্যের এই মালা পরেই চাষী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয়বারের মতো দেবদাস নির্মাণ করছেন। প্রমথেশ বড় য়ার পর তিনি দ্বিতীয় পরিচালক যিনি দ্বিতীয়বারের মতো ‘দেবদাস’ নির্মাণ করছেন। এ ছবিতে দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করবেন সময়ের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান, পার্বতী চরিত্রে দেখা যাবে অপু বিশ্বাসকে। মৌসুমী করবেন চন্দ্রমুখীর চরিত্রে। ছোটপর্দার শক্তিমান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম অভিনয় করবেন চুনিলালের ভূমিকায়। দ্বিতীয়বারের মতো দেবদাস নির্মাণ প্রসঙ্গে চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু কিছু গল্প থাকে যার আবেদন চিরকালীন। ‘দেবদাস’ তেমনই, এটি কখনোই পুরনো হবে না। সব সময়ের জন্যই এটি প্রাসঙ্গিক। আমি মূল কাহিনীর প্রতি সৎ থেকে ‘দেবদাস’কে আধুনিক রঙে রাঙাব। যদিও এর আগে আমি ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেছি, বলা যায় এখন নিজের সাথে নিজেরই প্রতিযোগিতা হবে। আমি চেষ্টা করব আগের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে।’ ‘দেবদাস’ চরিত্রের অভিনেতা শাকিব খান বলেন, ‘মহরতের দিন আমাদের ‘দেবদাস’ বুলবুল আহমেদ আমাকে মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছেন। আমি আশাবাদী যে ‘দেবদাস’ হতে পারব। এ চরিত্রে আমাকে নির্বাচনের জন্য আমি ইমপ্রেস টেলিফিল্মস লিমিটেড ও পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের কাছে কৃতজ্ঞ।’ এরপর চন্দ্রমুখী মৌসুমী বলেন, ‘দেবদাসের চন্দ্রমুখী আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। এ ছবিতে কাজ করতে যাচ্ছি ভাবতেই ভাল লাগছে। এ ছবির আয়োজনে অনেক মেধার সমন্বয় রয়েছে বলে আমি আশা করি নতুন ‘দেবদাস’ও আলোড়ন তুলবে।’ মৌসুমী এর আগে একাধিক সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও অপু বিশ্বাস এ ধারার কাজে নতুন। পার্বতী চরিত্রে কাজ করা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পার্বতী আমার স্বপ্নের চরিত্র। এ চরিত্রে কাজ করতে পারাটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আমার চেষ্টা থাকবে সত্যিকারের পার্বতী হতে। চুনিলাল চরিত্রে কাজ করা নিয়ে শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘মূলধারার চলচ্চিত্রে কাজ করার ইচ্ছেটা অনেক দিনের। ‘দেবদাস’-এর মাধ্যমে আমার ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি সবার আশীর্বাদ চাই সত্যিই যেন ভাল করতে পারি।’
ছবি সৌজন্যে আনন্দ আলো