আজকের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের অধিবাসীরা বহু প্রাচীন কালেই একটি বর্ণসংকর জাতে পরিণত হয়। বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোক বিভিন্ন দিক হতে বিভিন্ন সময়ে এসে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে এবং কালক্রমে পরস্পরের মধ্যে রক্তের মিশ্রণ ঘটে। এমন কি যেটাকে হিন্দু-বৌদ্ধ আমল বলা হয়, তখনও এ দেশে খাঁটি আর্য রক্ত ছিল না। শুধু যে রক্তের মিশ্রণ ঘটেছিল তাই নয়; এনিমিজম, ম্যাগানিজম, বৌদ্ধমত প্রভৃতির মিশ্রণে একটি সমন্বিত লোকধর্মও তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্য যে, সেই প্রাচীন কালেই বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ একটি বর্ণসংকর জাতে পরিণত এবং একটি সমন্বিত লোকাচারমূলক ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেও আজকের দিনে আমরা জাতি বলতে যা বুঝি তেমন কোনো চেতনা বাংলাসহ ভারতবর্ষের কোনো অঞ্চলে ছিল না। সেকালে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত। ভাড়াটে সৈন্যরা যুদ্ধ করতো। মাঝখানে পড়ে উলুখড়ের প্রাণ যেত। বৈদেশিক আক্রমনকেও ওভাবেই দেখা হতো। গ্রীক, শক, হুন, মোগল প্রভৃতি বিজয়ীরা ' এই ভারতবর্ষের মহামানবের সাগরতীরে এসে এক দেহে লীন ' হয়ে গেলো। কিন্তু যা সম্পূর্ণরূপে লীন হলো না, সেটি হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা। প্রাচীন দেশজ শব্দের সংমিশ্রণে নতুন নতুন সহজবোধ্য ভাষা গড়ে উঠলো। বাংলা ভাষা তার একটি।
কিন্তু বাংলা ভাষা খুব একটা প্রাচীন নয়। তার প্রমাণ লিখিত দলিল এখনো চর্যাপদ। চর্যাগান রচয়িতাদের কাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী ধরা হয়-ইতিহাসের কাল বিচারে এটা খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। তার আগেও এ দেশে মানুষের বসতি ছিল। তারা কী ভাষায় কথা বলতো জানা নেই। লিখিত ভাষা না থাকলেও ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম কথ্য ভাষা ছিল। হয়ত বিভিন্ন কৌম নিজ নিজ ভাষায় কথা বলতো। এসব কৌমের মধ্যে কখন পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় তার সঠিক সময়কাল সম্পর্কে অজানা। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে পণ্য বিনিময়ে আবশ্যকতা অনুভূত হয়ে থাকবে। রাজা শশাঙ্কের সময়ে মুদ্রা প্রচলিত থাকায় প্রমাণিত হচ্ছে যে, চর্যাপদ রচনার বহুকাল পূর্বেও এ দেশে অল্পবিস্তর ব্যবসা-বানিজ্য হতো। সুতরাং বিভিন্ন কৌমের ভাষার সংমিশ্রণে একটি সর্বজনবোধ্য ভাষার উদ্ভব হয়ে থাকবে। উত্তর ভারতীয় আর্যগণ তাদের ভাষা নিয়ে এ দেশে প্রবেশ করে। শেষোক্তদের ভাষার সঙ্গে প্রথমোক্ত সাধারণের ভাষার সংমিশ্রণের ফলে চর্যাপদের ভাষার উদ্ভব কি না সে বিষয়ে ভাষাতত্ত্ববিদগণের সুস্পষ্ট রায় নেই। বর্তমান কালে প্রচলিত বাংলা ভাষার মধ্যেও এমন বহু শব্দ রয়েছে যেগুলো এ দেশের আদিবাসীদের কথ্য ভাষা হতে এসেছে। লক্ষনীয় যে, সংস্কৃত ভাষাতেও বহু অনার্য শব্দ রয়েছে। গ্রহণ-বর্জন যে কোনো উন্নত ভাষার ধর্ম। জাতি গঠনে অনেক উপাদান কাজ করে। তার মধ্যে প্রধান উপাদান ভাষা। বিশালায়তন ভূভাগের লোকজন যখনই একই ভাষায় ভাব-বিনিময় করে তখন তাদের ঐক্য-চেতনার উদ্ভব হতে বাধ্য। দ্বিতীয় উপাদান অভিন্ন পণ্য উৎপাদন পদ্ধতি।
এই দুইয়ের সংমিশ্রণে যে অধিকাঠামো তৈরী হয়, তার নাম সামাজিক এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতা, তার মান যাই হোক। বর্তমান কালে ধর্ম শব্দটিকে আমরা যে অর্থে ব্যবহার করি সেটা আদিম মানব সমাজের নৈসর্গিক জগৎ সম্পর্কিত নানা রকম চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার ক্রমোন্নত রূপ এবং সেভাবেই ধর্ম সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে এসেছে। ধ্বনির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত লিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে ভাষার জন্ম। এক কৌমের সঙ্গে আরেক কৌমের সংমিশ্রণের ফলে মুখে মুখে কথিত বহু ভাষা বা বুলি লোপ পেয়েছে। এমন কি লিপির সহায়তায় লিখিত কোনো কোনো ভাষাও এখন বিলুপ্ত। মহেঞ্জাদারোতে প্রাপ্ত লিপি এর অন্যতম দৃষ্টান্ত।
চর্যাপদ রচনাকাল পরবর্তী কমপক্ষে আড়াই'শ বছরকাল বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রটি প্রায় অনাবাদি ছিল। আমাদের জানামতে ঐ সময়ের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য বাংলা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এর কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, ব্যাপক অশিক্ষা, দেশীয় ভাষার প্রতি ব্রাক্ষণদের বিরূপতা প্রভৃতির যে কোনো একটি অথবা সব কয়টি হতে পারে। এই কমবেশি আড়াই'শ বছরকাল মধ্যে সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইরান, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় নানা মতবাদ আত্মীয়করণান্তে আগত ইসলাম ধর্মও এ সময়ের মধ্যেই বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের সর্বত্র কমবেশি প্রবেশ করে। উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্বিতীয় বার বাংলা ভাষার চর্চা শুরু হয়। চর্যাপদ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের মধ্যে রামাই পন্ডিতের শূন্যপুরাণ এবং কৃত্তিবাস ওঝা অনূদিত রামায়ণ উল্লেখযোগ্য। শূন্যপুরাণের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। উক্ত গ্রন্থের শ্রীনিরঞ্জনের রুষ্মা বা কালিমা জালালিতে সাধারণ মানুষের উপর ব্রাক্ষণদের নিপীড়নের বর্ণনার সঙ্গে মুসলিম আগমনের বিষয়টিও উল্লেখ আছে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে উক্ত অংশটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকের রচনা। 'হাতে নিয়ে চির কামঠা পায় দিয়া মজা / গৌরে বলান গিয়া ধর্ম রাজা' এবং নিরঞ্জন স্বর্গ হতে অবতীর্ণ হয়ে 'মুখেতে বলেন দম্মাদার' প্রভৃতি অংশ লক্ষ্য করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, শূন্যপুরাণের এই দ্বিতীয় অংশ ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দের পরে কোনো সময়ের রচনা।
অপরদিকে গৌড়ের মুসলিম সুলতানের আনুকূল্যেই কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণ অনুবাদ করেন। এ রচনাও পঞ্চদশ শতাব্দীর। চন্ডীদাসসহ সেকালের প্রায় সব বিখ্যাত কবিই গৌড়ের স্বাধীন সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৩ - ১৫৩৮) রাজত্বকালে উল্লেখযোগ্য রচনা বাংলার প্রথম বিদ্যাসুন্দর কাহিনী, মনসামঙ্গল এবং ব্রজবুলিতে রচিত পদাবলী। শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাবও ঘটে এ সময়ে (১৪৮৫ - ১৫৩৩) প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীরও এ সময়ের লেখক। এ সময়ের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইবনে বতুতার সফরকালে (১৩৪৫ - ১৩৪৬) 'বাঙ্গালাহ' বলতে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গকে বোঝাতো। তাঁর বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, সে সময়ে দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের বাঙালি বলা হতো। সোনারগাঁও সুলতান ফখরুদ্দীনের রাজধানী ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালে (১৩৪২ - ১৩৫৮) বাঙ্গালা ও বাঙালি নাম উত্তর পশ্চিম বঙ্গে বিস্তৃতি লাভ করে। লক্ষণাবতী ও বাঙ্গালা একত্র হয়ে যায়। সুলতান এই যুক্ত অঞ্চলকে 'বাঙ্গালা' এবং তার অধিবাসীদের বাঙালি নাম দেন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নিজে 'শাহ-ই-বাঙ্গালা' ও 'শাহ-ই-বাঙালি' উপাধি ধারণ করেন। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল অব্দ, ত্রব্দ, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড়, লক্ষণাবতী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, পট্টিকেরা প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালেই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল বাঙ্গালাসহ (পরবর্তী কালে বঙ্গদেশ) এবং তার অধিবাসীরা বাঙালি নামে পরিচিত লাভ করে। লক্ষনীয় যে, বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বাঙ্গালাহ ও তার অধিবাসীদের বাঙালি নামের উদ্ভব প্রায় একই সময়ের ঘটনা। সেকালে ভারতবর্ষে কেন পৃথিবীর প্রায় কোথাও ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ নামের কোনো বিমূর্ত বস্তু ছিল না। রাজ্য ছিল, সাম্রাজ্য ছিল, সম্রাটের নামমাত্র অধীন সামন্ত নৃপতিরা ছিলেন কিন্তু মাতৃভূমিকেন্দ্রিক ব্যাপক আনুগত্য ছিল না। রাজা মহারাজারা সিংহাসনে আরোহণ করেই ভাড়াটে সেনানাহিনী নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হতেন। দিগ্বিজয় করতে গিয়ে অনেকে মাতৃভূমি হারাতেন। দৃষ্টান্ত বাবর।
নামের সঙ্গে পিতার নাম যুক্ত হওয়ার পর ব্যক্তি মানুষের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণিত হয়। ভাষাগত ঐক্য স্থাপিত এবং আবাসভূমি চিহ্নিত হওয়ার পূর্বে জাতিগত স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এদিক থেকে বিচার করলে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বর্তমান নাম এবং তার অধিবাসীদের স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচিতির জনক সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। কিন্তু নাম দেওয়া মাত্র স্বাতন্ত্র্য স্থাপিত হয় না। স্বাতন্ত্র্যের কিছু অসাধারণত্ব যুক্ত হওয়ার পর সমাজে ব্যক্তির প্রকৃত স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অসাধারণত্ব হচ্ছে ব্যক্তির কাজকর্ম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তির কাজকর্ম তাঁদেরকে সমাজে স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু স্বতন্ত্র জাতিগত প্রতিষ্ঠা এক দুই পুরুষে হয় না। এক দুই জনের অসাধারণত্ব তার জন্য যথেষ্ট নয়। অধিবাসীদের পুরুষানুক্রমে কৃত কাজকর্ম যখন বৈশিষ্ট্যের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ওঠে তখনই স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলে অভিন্ন উপাদান-মাধ্যম ও পদ্ধতি এবং জীবনযাপন-প্রণালী কাজ করে। এই অবকাঠামো হতে গড়ে ওঠে সমন্বিত লোকসংস্কৃতি। সমাজের সকল স্তর ও শ্রেণীর সংস্কৃতি কোনো দেশেই সম্পূর্ণরূপে এক হয় না। আবার নগর সংস্কৃতি এবং পল্লীগ্রামের সংস্কৃতির মধ্যেও পার্থক্য আছে। কিন্তু এই পার্থক্য ও শ্রেণীভেদ সত্ত্বেও প্রায় প্রতিদিন প্রতিটি স্তর ও শ্রেণীর লোক লেনদেনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়ার সকল শ্রেণীর মধ্যে ফল্গুধারা-সদৃশ একটি ঐক্য সৃষ্টি হয়। সাহিত্য, সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, সামাজিক উৎসব প্রভৃতির মধ্যে আমরা সেই ঐক্য দেখতে পাই। বিশ্বনন্দিত সাহিত্যস্রষ্টারা শুধু স্বশ্রেণীর জন্য রচনা করেন না; তাঁদের রচিত কাব্য, নাটক ও গল্প উপন্যাসে সকল শ্রেণীর মানুষকে যেন আমরা কাতারবন্দী হয়ে দন্ডায়মান দেখতে পাই।
যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জি থেকে রেফারেন্স নেয়া হয়েছে:
* বাঙালির ইতিহাস: ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়
* বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ডক্টর আবদুর রহিম
* বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য: ডক্টর আহমদ শরীফ
* মুসলিম বাংলা সাহিত্য: ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
* বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন: শ্রী অতুল সুর
* বাংলা সাহিত্যের কথা: ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
* সাংস্কৃতিকী: ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫০