১. গ্যাব্রোভোবাসীরা যখন মাছ খায়, তখন মাছের কাটাগুলোকে না ফেলে জমা করে রাখে, যাতে পরর্বীতে সেগুলোকে দাতেঁর খিলাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

২. সূর্য ডোবার পরপরই তারা ঘুমাতে যায়, এবং ঘড়ির চাকা যাতে তাড়াতাড়ি না ক্ষয়ে যায় এজন্য রাতের বেলায় তারা ঘড়ি বন্ধ করে রাখে।

৩. তারা দেশলাইয়ের একটি কাঠিকে চিরে দুই ভাগ করে নিয়ে সিগারেট জ্বালায় যাতে এক কাঠিতে দু’বার আগুন জ্বালানো যায়।

৪. তারা বাজার থেকে জিনিস কেনার সময় তা সেদিনকার খবরের কাগজের সঙ্গে মুড়িয়ে পেতে চায়, যেন খবর পড়ার জন্য ঐদিনের খবরের কাগজটি আর কিনতে না হয়।

৫. বেচাকেনার জন্য তারা গ্যাব্রোভো থেকে রাজধানী সোফিয়ায় এলে ঝর্ণার উষ্ণ পানি খেয়ে সকালবেলার চা খরচটা বাঁচিয়ে দেয়।

মনে আছে ক্লাস সিক্সের মুহম্মদ এনামুল হকের সেই চমৎকার প্রবন্ধটার কথা, “গ্যাব্রোভোবাসীর রস-রসিকতা”? সেটা পড়েই প্রথম গ্যাব্রোভো সম্বন্ধে জেনেছিলাম, ছোটবেলার বিরক্তিকর বাংলা বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় লেখা ছিল বোধহয় ওটাই। অনেকদিন পর সেদিন গ্যাব্রোভো নিয়ে একটা জার্নাল হাতে পেলাম... পড়ে এতো মজা পেলাম তো বলার মতো নয়। তাই ছোটবেলার সেই মজার তথ্যগুলোর সাথে আরও কিছু যোগ করে সবার সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
৬. তারা তাদের গাধাগুলোকে সবুজ কাঁচের চশমা পরায়, যাতে গাধারা খড়কে ঘাস ভেবে ভুল করে খড়ই খায়।

৭. তারা সবচেয়ে বেশি ঘামায় অত্যন্ত উত্তপ্ত কামারশালায় এবং বাজারে; প্রথমটি তাপের জন্যে হলেও দ্বিতীয়টি জিনিসপত্র নিয়ে দরদাম করার জন্যে।

৮. তারা চুলের কলপ হিসেবে হাঁড়ির কালি এবং তেল হিসেবে সূর্যমুখীর তেলের বোতলের ঢাকনা ব্যবহার করে। তাই তাদের এক বোতল তেল কখনোই ফুরায় না!

৯. গ্যাব্রোভোবাসীরা বই পড়ার সময় অনবরত বাতি জ্বালাতে এবং নেভাতে থাকে! কারণ তারা নিশ্চিত করতে চায়, পাতা উল্টানোর সময় যাতে এক বিন্দু শক্তিও অপচয় না হয়।

১০. তারা বিয়ার রাখার জন্যে বড় ড্রাম ব্যবহার করলেও পরিবেশন করার জন্যে ব্যবহার করে ডিমের খোলস। অর্থাৎ তারা নিশ্চিত হতে চায় যে পাছে নেশা ধরে আরও বেশি পান করে ফেলে কিনা!

তবে তাদের কিপ্টেমির সবচেয়ে বড় লক্ষণ বোধহয় লেজকাটা বেড়াল! আপনি গ্যাব্রোভোতে গেলে অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন, কোন বেড়ালেরই লেজ নেই! এ নিয়ে চমৎকার একটি কাহিনীও প্রচলিত আছে। এটা সরাসরি এনামুল হকের প্রবন্ধটা থেকেই দিচ্ছি-
“গ্যাব্রোভো শহরে শীতের দিনে বাজার থেকে কয়লা কিনে এনে ফায়ারপ্লেসে তা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখতে হয়। এতে খরচের পরিমান খুব কম হয় না। একদিন এক গ্যাব্রোভোবাসী ভাবল, তার এ খরচ কমাতে হবে। কী করে তা করা যায়, তাই উদ্ভাবন করল সে।
তার একটা একটা আদুরে বিড়াল ছিল। এর লেজটা ছিল বেশ মোটা এবং অনেক লম্বা। বেড়ালটিকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখাতো। আর বাড়ির সবাই আদর যত্ন করত।
শীত আসার আগেই লোকটি একদিন তার আদুলে বেড়ালের লেজ কেটে দিল। সবাই চেঁচিয়ে উঠল : সর্বনাশ এ কি করলে? লোকটি বলল, উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই, বিড়ালটিকে আমারা আদর-যত্ন করব ঠিকই। তবে, আসছে শীতে দরজা খুলে তাকে বাইরে নিতে আর আনতে ঘরের যেটুকু তাপ নষ্ট হতো তার অর্ধেক তাপ এখন থেকে বেঁচে যাবে। এরপর থেকেই লেজকাটা বেড়াল, গ্যাব্রোভোতে মিতব্যায়িতা অর্থাৎ কাপর্ণ্যেনের প্রতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে”।
আজো তাই আপনি গ্যাব্রোভো শহরে ঢুকতে গেলে শুরুতেই দেখবেন এক লেজকাটা বিড়ালের ছবি।
মিউজিয়ামে সেই লেজকাটা বেড়াল
বিশ্বজুড়ে হাস্যরসের রাজধানী হিসেবে পরিচিত বুলগেরিয়ার এ শহরটি। এ শহরের অধিবাসীরা হাসিঠাট্টায় এতো পারদর্শী যে, জীবনের যেকোন দিক তারা হাসিঠাট্টার মাধ্যমে খুব দ্রুত মেনে নিতে পারে। কিপটা হিসেবেও তাদের খ্যাতি কম না... কিন্তু এই ‘কিপটামি’ ব্যাপারটা তাদের কৌতুকময় জীবনের সাথে এতো চমৎকার মানিয়ে গেছে যে এটা ছাড়া তাদের অসম্পূর্ণই বলা চলে! এবং গ্যাব্রোভোবাসীরা বিশ্বে তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থানের জন্যে বরাবরই গর্বিত বোধ করে, এই ঐতিহ্যকে ধারণ প্রত্যেকে তাদের নিজের কর্তব্য বলে মনে করে। নিজেদের এ অতুলনীয় সম্পদের রক্ষনাবেক্ষনের জন্যে ১৯৭২ সালে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বের একমাত্র ‘হাউজ অফ হিউমার অ্যান্ড স্যাটায়ার’। পার্ক অফ লাফটার, বেলস, গার্ডেন অফ ইডেন, গ্যাব্রোভো ক্যাটস, গ্যাব্রোভো কার্নিক্যাল ইত্যাদি দারুণ জিনিস দিয়ে পরিপূর্ণ মিউজিয়ামটি। এ মিউজিয়াম সম্বন্ধে একটা কথা প্রচলিত আছে... যে এখানে একবার যাবে, সে অন্তত এক বছরের হাসির রসদ সাথে করে নিয়ে আসবে এবং তার সম্পত্তিও আগে চেয়ে বেড়ে যাবে। কারণ সে তখন গ্যাব্রোভোবাসীদের মতোই মিতব্যায়ী হওয়া শুরু করবে! এছাড়া ‘ব্লাগোলাজ’ নামক আন্তর্জাতিক কৌতুক প্রতিযোগিতা প্রতি বেজোড় বছরে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখানে যারা অংশগ্রহণ করে, তাদের শপথ করতে হয় যে পৃথিবী থেকে কোনমূল্যেই হাসি হারিয়ে যেতে দেবেন না।
মিউজিয়ামের অন্যতম আকর্ষণ "বেলস"। অনেক মানুষ মিলে একসাথে ঘন্টাগুলো বাজায়, তখন এক অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি হয়। গ্যাব্রোভোবাসীরা এই ঘন্টার আওয়াজ দিয়ে সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে
গ্যাব্রোভো শহরের শুরুটা অবশ্য এতো সুখকর ছিল না। এটি অনেক প্রাচীন শহর হলেও মূলত চৌদ্দ শতকের দিকে লোহার কাজে দক্ষতার জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। র্যাচো নামক এক কামার এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে হর্ণবীম গাছের পাশে তার কামারশালা বসিয়েছিল, হর্ণবীমের বুলগেরিয়ান নাম গ্যাবর। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা তার কাছে বিভিন্ন কাজ করাতে আসত। তাদের মুখে মুখে ‘গ্যাবর’ থেকে ‘গ্যাব্রোভো’ হয়েছে বলে মনে করা হয়। র্যাচো কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন মজার মজার গল্প করত ক্রেতাদের সাথে, তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হত। তবে র্যাচো ছিল খুবই কৃপণ। সে কামারের কাজ করে অনেক টাকা কামালেও এতো টাকা কি করত কেউ জানে না! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, মৃত্যুর আগে সে শেষ বলেছিল কিছু সুতা আর ভাঙা কাঠের কথা। সেগুলো এতোই ফেলনা যে সে কোন কাজেই লাগাতে পারেনি, তাই যাতে তার মৃতদেহের কফিন আর চাদর এই সুতা আর কাঠ থেকে বানানো হয়!! আরও বলে গিয়েছিল তাকে যাতে খাড়া করে কবর দেয়া হয়, এতে অনেকখানি জায়গা বাঁচবে!
এরপর থেকে গ্যাব্রোভো আর থেকে থাকেনি। লোহা, তাঁত সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করার পাশাপাশি তাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছিল র্যাচোর কার্পণ্য আর হাস্যরস মেশানো অদ্ভুত স্বভাব। আঠারো শতকে এসে সেটা এতোই তীব্র আকার ধারণ করে যে সারা বিশ্বের নজর আস্তে আস্তে গ্যাব্রোভোর দিকে পড়ে। অনেক ব্যবসায়ী গ্যাব্রোভোতে ব্যবসা করতে আসতেন শুধু এই কারণে যে তাদের কাছ থেকে যাতে মিতব্যয়ীতা শিখতে পারেন! পাশাপাশি সেখানকার লোকদের চতুর ব্যবসা কৌশল সম্বন্ধেও তারা জ্ঞানলাভ করতেন। শোনা যায়, হাসিমুখ ছাড়া নাকি গ্যাব্রোভোর অধিবাসীরা ব্যবসা করতেন না, এবং ক্রেতাদের মুখেও একইভাবে হাসি দেখতে চাইতেন!
এছাড়াও গ্যাব্রোভো আরও বিভিন্ন মজার ঘটনা শোনা যায়। যেমন-
--> এক গ্যাব্রোভোবাসী গেরস্ত পার্টিতে বিভিন্ন জনকে দাওয়াত করেছেন, কিন্তু দেখা গেল লোক হিসেবে তার ঘরে পাঁচটা চেয়ার কম আছে। তখন তিনি প্রতিবেশী অতিথিকে বললেন, “তোমার ঘরে কি পাঁচটা অতিরিক্ত চেয়ার আছে?” প্রতিবেশী বলল, “হ্যাঁ, আছে”। তখন গেরস্ত বলল, “বেশ তো। এই পাঁচজন তাহলে তোমার ঘরেই খাচ্ছে”।


--> গ্যাব্রোভোবাসীরা রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করে না! কেন জানেন? তারা নিশ্চিত নয় ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে ভেতরের বাতিটি সত্যি নিভে কিনা!!


--> একবার এক গ্যাব্রোভোবাসীর বাড়িতে বিদেশী মেহমান এল। গেরস্ত তো খুবই চিন্তায়, কি না কি খেতে দেয়! চিন্তায় সে শয্যা নিল, মেয়েকে দায়িত্ব দিল অতিথিকে দেখাশোনার। মেয়েও তো কম না। ঘরে কিছু কমলা ছিল, সে অতিথির সামনে এসে হাত দিয়ে কমলার সাইজ বোঝাতে লাগল, খাবে কিনা হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল। অতিথি এমনিতেই এদেশে নতুন, কিছুই বুঝল না। ভয়ে সে পালাল। এরপর গেরস্ত তার মেয়েকে ডেকে খুশি হয়ে বললেন, “কিরে, তাড়ালি কিভাবে?” মেয়েটা বুঝিয়ে দিল কিভাবে সে হাতের ইশারায় কমলার সাইজ বুঝিয়েছে, এবং অতিথি না বুঝে ভয়ে পালিয়েছে। কিন্তু শুনেই ঠাস করে একটা চড়ল মারলেন তাকে গেরস্ত। “তুমি আমাকে মারলে কেন বাবা?” মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল। “বোকা মেয়ে,” দাঁত কিড়মিড় করে বললেন ভদ্রলোক, “অত বড় করে দেখাতে গেলি কেন?? আরও ছোট করে দেখাতে পারলি না???”


--> একবার এক ছুটির দিনে গ্যাব্রোভোবাসী গেরস্ত স্যুপের সাথে ডিম খেতে চাইল। “কতোটুকু ডিম দেব?” জিজ্ঞেস করল তার স্ত্রী। “হুম... আজকে তো ছুটির দিন, অর্ধেকটাই না হয় দাও!” গেরস্তের উত্তর। ছুটির দিন ছাড়া তাহলে কতোটুকু ডিম দেয়া হতো, বুঝতেই পারছেন! :-& :-& :-& :-&
-->বাড়িতে বড় অতিথি এলে গ্যাব্রোভোবাসীরা ভদ্রতার খাতিরে চায়ের সাথে রীতি অনুযায়ী মাখনও পরিবেশন করে ঠিকই, কিন্তু মাখন কাটার ছুরিটা তাপ দিয়ে গনগনে করে রাখে। এর ফলে অতিথি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাখন কেটে খেতে পারে না! তবে শোনা যায়, একবার লোভে পড়ে এক অতিথি নাকি গোটা মাখনই মুখে পুরে ফেলেছিলেন। এর প্রতিদান হিসেবে ঐ গেরস্তরাও তাদের বাড়িতে দলবেঁধে বেড়াতে যান, এবং পরিবেশন করা মাখন পুরোপুরি গিলে প্রতিশোধ নেন!


এছাড়া বেড়ালের লেজ-কাটা, র্যাচোর ঘটনা তো উপরে বললামই। ধারণা করা হয়ে থাকে, ক্ল্যাসিক ধাঁচের জনপ্রিয় কৌতুকগুলোর বড় অংশের জন্ম গ্যাব্রোভো থেকে। তাই সেখানকার হাসির মিউজিয়ামে গেলে পরিচিত অনেক কৌতুককেই বিভিন্ন মজার মজার মাধ্যমে দেখতে পাবেন।
তবে বলা বাহুল্য, গ্যাব্রোভোবাসীদের বোকা মনে করা কিন্তু খুবই ভুল। তারা অন্তত বুদ্ধিমান, এবং এই বুদ্ধির জোরেই তারা নিজেদের আজকে পরিণত করেছে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী জাতিতে। নিজেদের হাসিঠাট্টায় পরিণত করার মাধ্যমে তারা মানুষকে যেমন আনন্দ দেয়, নিজেদেরাও তেমন আনন্দিত হয়। এরই মধ্যে পৃথিবীর Most Greenest City হিসেবে গ্যাব্রোভো খ্যাতি পেয়েছে, এবং পৃথিবীর অন্যতম বসবাস উপযোগী স্থান হিসেবে একে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিদিনের জটিল জীবন থেকে সহজ-সরল, নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুদিন হাসিঠাট্টার মধ্যে কিছুদিন কাটিয়ে অনেকেই ফিরে যান নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। বলকান পর্বতমালার পাদদেশ আর ইয়ান্ত্রা নদীর তীরে অবস্থিত গ্যাব্রোভো কিন্তু সৌন্দর্য্যের দিক দিয়েও কম যায় না! অনেকেই একে পৃথিবীর অন্যতম “নিশ্চিন্ত” শহর বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
বিশ্বখ্যাত গ্যাব্রোভো কার্নিভালঃ
আফসোস... এমন কোন একটা শহরে জীবনটা কাটায় দিতে মন চায়!!



আগের কিছু পোস্টঃ
ফেমিনিন সাইকোলজিঃ রহস্যময় জগতে একটি সাইকোঅ্যানালাইসিসের প্রচেষ্টা
মধ্যরাতের মিষ্টি হাসি!! (রম্য, রোমান্টিক, হরর কিচ্ছা, বলতে পারেন যা ইচ্ছা!!)
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালডো, কিংবা একজন অতিমানবঃ "টেস্টেড টু দ্য লিমিট!!"