রাত দুইটা সাতচল্লিশ মিনিট।
মোবাইলটা বের করে নিয়ে আরেকবার গান ছাড়ি। হেডফোনের জ্যাক পুশ করেই ভলিউম টা সর্বোচ্চ লেভেলে নিয়ে যাই। মালিবাগ রেলগেট ধরে সোজা যাই রামপুরার দিকে। গন্তব্য জানা নেই। হয়তো বা আফতাবনগর গিয়ে থেমে যাবো, নইলে হাতির ঝিল।বুক পকেটে রাখা সিগারেটটাতে অগ্নিসংযোগ করিয়েই হাটা শুরু করি।
টিভি সেন্টারের সামনে যেতেই রামপুরা পুলিশ বক্স থেকে একজন পুলিশ বেরিয়ে আসলো।
- এ্যাই ছোকরা এই
-আমাকে বলছেন?
-এখানে আর কোন কাক পক্ষী আছে?
-পুলিশ আছে।
-মশকরা করা হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছো?
-কখনো লোকাল বাসে উঠেছেন?
-আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি।
-আমিও আপনাকে প্রশ্ন করেছি। কখনো লোকাল বাসে উঠেছেন?
-হ্যা উঠেছি।
-মহিলা সীট,পকেট সাবধান,একশো ও পঞ্চাশ টাকার ভাঙতি নাই, অপরিচিতজনকে আপনি বলুন এসব লেখা গুলো দেখেছেন?
পুলিশটা থতমত খেয়ে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে আমি তাকে কি বোঝাতে চাচ্ছি। নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলে,
-কোথায় যাচ্ছেন এত রাতে?
-জানিনা
-সন্দেহজনক
-আপনিও সন্দেহজনক
-মানে? কি বলতে চান?
-আমিও এত রাতে বাসার বাইরে,আপনিও বাসার বাইরে।
-এটা আমার ডিউটি।
-এতরাতে বাইরে থাকাটা আমারো ডিউটি।
-আমি পুলিশ
-আমি মানুষ
-আপনি কি চুরি -ছিনতাই করেন নাকি?
-করিনি তবে করবো।
-আজব পাবলিক তো ভাই। চৌদ্দ শিকে পুরে দিবো নাকি?
-কেউ কি অভিযোগ করেছে?
-আমি বাদী হবো।
-বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন এবং আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন। আমি যদি অভিযোগ করি একশো ছাপ্পান্ন ধারানুযায়ী আপনার ছয় মাসের জেল এবং নগদ অর্থ জরিমানা করা হবে।
পুলিশটা খুক খুক করে কাশি দিলো। হাই তুলে বলে,"আইনের ছাত্র নাকি? "আমি চুপ করে থাকি। পুলিশকে গুড নাইট বলে হাটা শুরু করি। পুলিশ আবার ডাকছে। আমার মেজাজ উনপঞ্চাশে চড়ে গেলো। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে আবার হাটা শুরু করি।
পিঠে তীব্র একটা ব্যাথা অনুভুত হলো। পিছন ফিরে তাকাতেই ঐ পুলিশের আগুন চোখ। গাজার ডিলার বলে গালাগাল দিতে লাগলো আমাকে। হাতের লাঠিটা দিয়ে আমাকে আরেকবার আঘাত করতে চাইলো সে। কি মনে করে করলো না। আমি একটুও বিচলিত হইনি। আমি বরঞ্চ খুশি হয়েছি। আজকের শিকারটা এখানেই পেয়ে গেলাম। গত তিন বছর ঠিক এই দিনে আমি শিকার খুজি।
মানুষ লাগবে। মৃত মানুষ! মৃত মানুষের সাথে কথা বলার মজাই আলাদা। প্রথম কথা বলেছিলাম আমার খালাতো ভাই এর সাথে। ফোনে গেমস দেয়নি বলে আমি ওকে মেরেছিলাম। সেদিন তাকে মারার পর তার ফোনে অনেক গেমস খেলেছি। আমি বেশ উপভোগ করেছি ব্যাপার টা। একটি বারের জন্য ও সে আর না করেনি। আমার খুব ইচ্ছা করে এ পৃথিবীতে স্বাধীন ভাবে চলতে। যারা আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে আমি তাদের নাম দিয়েছি 'পৃম্ফি' এটা কোন অভিধানে পাওয়া যাবে না। এটা আমার দেয়া নাম। "মার্ডার পৃম্ফি ১","২","৩" এভাবে আমি শেষ করেছি তিন জনকে। হটাৎ এ প্রবণতা কেন আসলো আমি জানিনা।
আমি ভেবেছিলাম আজ বুঝি নিধিকে খুন করবো আমি! সেই উদ্দেশ্যেই বের হওয়া। নিধিকে খুন করার মোক্ষম সময় ফজরের আজানের সময়। তখন তার বাসার সবাই নামাজ পড়বে। তার ব্যালকনির গ্রীল দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারতাম পর জগতে। কয়েকদিন থেকেই নিধি আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছিল। ভালোবাসে ভালো কথা! তাই বলে আমার স্বাধীনতা নাই? যাই হউক,তাকে খুন করাটা আমার কাছে এখন ৪র্থ বিষয়ের মতোই অপ্রয়োজনীয়। তার খুনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন এই সার্জেন্টকে খুন করা।
কিন্তু সার্জেন্ট তো আমাকে সুযোগই দিচ্ছে না।কাকে যেন ফোন করে আমার ব্যাপারে বললো-
-স্যার মাল পাইছি
ওপাশে কিছু একটা বললো।
-স্যার আপনি কোথায়?
ওপাশের উত্তর শুনলাম না আমি।
-ও আচ্ছা স্যার তাহলে তো ঘন্টা খানেক লাগবে ।
আমি এ কথা শুনে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এক ঘন্টায় একটা খুন করা কোন অসম্ভব ব্যাপার না। সার্জেন্ট আমাকে এক হাতে হাত কড়া পরিয়ে আরেক হাতে সিগারেট ধরালেন। আমার মাথা কাজ করছে না। এই মুহুর্তে আমার একটা সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু হাতের কাছে নাই। বাধ্য হয়েই সিগারেট চাইলাম সার্জেন্টের কাছে।
-গোল্ডলিফ না পালমাল?
-গোল্ডলিফ ।
-দুইটা টান দেয়া যাবে?
-বেয়াদ্দপ ছোকরা। গাজার ডিলার। পুলিশের কাছে সিগারেট খুজিস! সাহস তো কম না!
-আপনি খেতে পারলে আমি কেন খেতে পারবো না?
-দাড়া তোকে চৌদ্দ শিকে পুরে দিচ্ছি।
সার্জেন্টের কথাটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো না। মাথার উপর পনের ইঞ্চি একটা ফ্যান ঘুরছে। একটা তার ঝুলে আছে। বাংলাদেশ! এত্ত ভালো ডেকোরেশান!
সার্জেন্টের চোখ লাল হয়ে আছে। ঘুম ঘুম চোখ। চেয়ারে পা দুলিয়ে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুম আনার চেষ্টা করছিলো। বাংলাদেশের পুলিশদের যা হয় আর কি!
সার্জেন্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডেকে শান্তির ঘুমে চলে গেলো। আমার হাতে হাত কড়া লাগানো।সার্জেন্ট ক্রমেই গভীর ঘুমে অতল হয়ে যাচ্ছে। পূলীশ বক্সের ভেতরে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ডিজিটাল ঘড়িটার সময় অনুযায়ী অফিসার আসতে আর সাতচল্লিশ মিনিট বাকি ।
আমি খুব বেশি চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছি। কি করা যায় ভাবছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল হাত কড়াটা ভেঙ্গে ফেলি । কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সার্জেন্টের ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার সব কিছু অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটা উপায় মাথায় আসলো। সার্জেন্টের জায়গামত কষে একটা লাত্থি মেরেই তাকে আহত করা যেত। কিন্তু এতে তার মরার সম্ভাবনা কতটুকু? জানা ছিল না আমার।
ঊনচল্লিশ মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড বাকি আর। এখন আমার কাছে প্রতিটি মিলি সেকেন্ড,মাইক্রো সেকেন্ডের ও খুব দাম আছে। প্রতিটি সেকেন্ড আমার নিউরন খরচ করবে। যদি দুইটা হাত খোলা থাকতো তাহলে মাত্র পাচ মিনিটের মধ্যেই আমার চথুর্থ খুনটা হয়ে যেতো। কিন্তু সেটা অসম্ভব।
এসব চিন্তা করতে করতে আমার সময় কমে আসে। আর পচিশ মিনিটের মতো আছে। আমিও উপায়ন্তর কিছুই খুজে পাচ্ছি না আর।
ভাগ্য বোধ হয় সুপ্রসন্ন! ঘুমন্ত সার্জেন্ট ব্যাটা চেয়ারে ভর করেই ঘুমোচ্ছে। মনে হচ্ছে নিজের গলাটা বিলিয়ে দিয়েছে আমাকে যেন আমি কেটে টুকরো টুকরো করে দিই। টনসিল গলিয়ে শরবত খাই!
আমি আস্তে করে উঠি। দুই পা ধীরে ধীরে এগিয়ে নিই। সার্জেন্টের একশো আশি ডিগ্রী বিপরীতে গিয়ে দাড়াই। সে তখনো নাক ডাকছিল। খেয়াল করলাম হাত কড়াটা মোটামুটি প্রশস্ত। দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাত কড়ার মাঝের চেইনটা সার্জেন্টের গলার উপর আলতো করে ছুয়ে দিই। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে টানি আমি। ইস্পাতের আঘাতে সার্জেন্টের ঘুম ভেঙ্গে যায়। গোঙ্গাচ্ছে খুব! কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছে না।
জিহ্বা প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন। মাথায় চিন্তা আসলো ওকে এভাবে মেরে দিয়ে পালানোটা খুব একটা সুবিধার হবে না। আর এত রাতে ঢাকা ছাড়াও সম্ভব না। আরো এই অবস্থায়!
সার্জেন্টকে বললাম,"তুই কি বাঁচতে চাস?" সার্জেন্ট মাথা নেড়ে হ্যা সুচক উত্তর দিলো। আমি বললাম, তাহলে আমার হ্যান্ড কাপ খুলে দে। আমিও বাচি, তুই ও বাচলি।
কাপা শরীর নিয়ে সার্জেন্ট পকেট থেকে চাবি বের করে হ্যান্ডিক্যাপ টা খুলে দেয়া মাত্রই আমি আর অপেক্ষা করলাম না। হ্যান্ডকাপ দিয়েই কষে তার ঘাড়ে আঘাত করি। জায়গাতেই জ্ঞান হারায় সে।
মাথায় উপর ঘোরা পনের ইঞ্চি ফ্যানটার দিকে তাকাই আমি। ঝুলে থাকা তারটার দিকে হাত বাড়াই সার্কিট বন্ধ করে দিয়েই। স্বহস্তে তার খুলে নিই।
হাতে সময় আট মিনিট।
হ্যান্ড কাপটা সার্জেন্টের হাতের পাশে রেখে দিই। ফ্যানের ছেড়া তারটা নিখুত ভাবে লাগাই ইস্পাতের তৈরী হ্যান্ড কাপের সাথে। রূম থেকে বের হয়ে আসি আমি। পাশের গাছের ডাল ছিড়ে জানালা দিয়েই সার্কিট অন করে দিই আমি।
মুহুর্তেই! মুহুর্তেই আশপাশ আলোহীন হয়ে গেলো। ট্রান্সফরমার টা ঠাস করে আওয়াজ দিয়েই অকেজো হয়ে গেলো। সার্জেন্ট ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান পেয়ে সারাজীবনের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
হাতে সময় পাচ মিনিট।
এখন আমার সময় চথুর্থ মৃত ব্যাক্তির সাথে কথা বলা। আমি বলা শুরু করি।
-আমি সারারাত বাইরে ঘুরবো। সমস্যা?
মৃত ব্যাক্তিটা বলে,"না"
আমি আবার বলি,"আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার সাহস পেলি কোথায়?"
মৃত ব্যাক্তিটা বলে,"দুঃখিত"
আমি বলি,"আমি গাজার ডিলার?"
মৃত ব্যাক্তিটা বলে,"ভূল হয়েছে "
এভাবে সাড়ে চার মিনিট কথা বলি জানালা দিয়েই। কানে শো শো আওয়াজ করছে। আর ত্রিশ সেকেন্ড আছে। আমি পালাতে হবে।
রামপুরা পুলিশ বক্স থেকে রাস্তার ওপারে গিয়ে ব্রীজের পাশ দিয়েই নেমে এলাম। হাতির ঝিল তিন নাম্বার ব্রীজে যখন,তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাইকে সতর্ক করা হলো মাইক দিয়ে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ হয়েছে। সবাইকে মেইন সুইচ অফ করতে বলা হল।
আমি আবার হাটা শুরু করি। রাতের হাতির ঝিল দেখতে দেখতে আমি কাওরান বাজার রেলগেট পৌছে যাই। শরীর আর চলছে না। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ খুন করা সহজ কথা না!
কাওরান বাজার রেলগেট এসেই বসে পড়লাম। কাল সকালে এখান থেকে পরটা খেয়েই বাসায় ফিরবো। মহানগর এক্সপ্রেসের হুইসেলে ঘুম ভাঙবে আমার কাল।
সকাল আটটা পঁয়তাল্লিশ।
ঘুম থেকে উঠেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। টেবিলে থাকা পত্রিকা টাতে চোখ বুলালাম আমি। প্রথম পৃষ্ঠাতেই আছে,"রাজধানীতে আবারো পুলিশের মৃত্যু। গতকাল রামপুরা পুলিশ বক্সে.... বিস্তারিত পৃষ্ঠা তিন, কলাম চার"।
আমি আর পাতা উল্টালাম না। এর বিস্তারিত আমি জানি। আর কেউ না। সাংবাদিকরা নিজেদের সুবিধার্থে ভুলভাল কিছু একটা লিখে দিবে আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করবে। এই আর কি!
আমি মুচকি হাসি। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীকে ডেকে বলি,"মামা দুইটা রুটি আর পায়া দাও তো..."