(আমার) কল্পলোকে বহুস্থান আছে যেখানে
বনস্পতির দল নিরুত্তর অস্ফুটস্বরে কথা বলে
চলে, সেখানে দু'কূল ফুলে ফুলে আবৃত
স্ফটিকস্বচ্ছ সঙ্গীতমুখর নদীনালা সাগরের বুকে
লীন হতে বহে যায়। দূরে, সেখান থেকে বহু
দূরে এমন একটি ভয়ঙ্কর, অলৌকিক স্থান আছে
যেখানে বনস্পতিসব তাদের নিষ্প্রভ অলৌকিক হাত
আকাশের দিকে মেলে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে
নৈঃশব্দ্য আর তমোরাশি মানুষের অন্তরাত্মাকে
বিষাদময়তা আর মৃত্যুর তীব্র আলোকে উদ্ভাসিত
করে।
এই ভয়ঙ্কর রাজ্যটি আমার পরিচিত। একদিন রাত্রে
দুঃখভারাক্লান্ত, সুরাপানে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আমি
টলতে টলতে পথ হাঁটছিলাম - ঠিক যেন প্রাচীন
কালের কোনো জাহাজ নাবিকদের গানের সুরে
ভেসে চলেছে। আমারই গান, নীচুস্বরে
গাইছিলাম। কোনো এক বন্য আদিম মানুষের গান,
লুথেরানদের গানের মত বেদনার্ত, অরণ্য
পর্বতের পুঞ্জীভূত প্রবল দুঃখ বিষণ্ণতা-নিঃসৃত
প্রশান্তি সঙ্গীত।
রাত্রি আগত, কিসের এক তীব্র ভয় অনুভব করলাম।
সেই কেল্লার সামনে পৌঁছে, একটি পরিত্যক্ত
ঘরে প্রবেশ করলাম। ডানাভাঙা একটি বাজপাখি ঘরের
মেঝেতে কষ্টকরে চলাফেরা করছে।
জানালায় দৃশ্যমান চাঁদের অলৌকিক আলোয় সামনের
রুক্ষ নগ্ন প্রান্তর ছিল ভরে। পরিখার বদ্ধ জলে মৃদু
কম্পন। ওপরে আকাশের গায়ে উজ্জ্বল কালপুরুষ
রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বহু দূরে কোনো
এক অগ্নিকুণ্ডের শিখা বাতাসে লক্লক্ করতে দেখা
যাচ্ছিল।
আমার ঘাসের বিছানাটি প্রশস্ত বৈঠকখানার মেঝেতে
নামিয়ে রাখলাম। ঘরটি পরিত্যক্ত, মধ্যে ছোট একটি
অগ্নিকুণ্ডে কয়েকটি প্রজ্বলিত মশাল, যার
আলোকে ঘরটি আলোকিত। ঘরের এক
দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা প্রকাণ্ড একটি
ঘড়ি - দীর্ঘ এবং অপ্রশস্ত। কফিনের আকারের
কাঠের কালো ঘড়ি থেকে বার হচ্ছিল ধাতব টিক্ টিক্
শব্দ।
"ওহ! কি শান্তি!" মনে মনে বললাম, "মানুষের ঘৃণ্য
কোলাহল আর শুনতে হবে না, কখনো শুনতে
হবে না।"
আর সেই বিষণ্ণ ঘড়িটি উদাসমনে তার ধাতব টিক্ টিক্
শব্দে দুঃখের প্রহর গুণে চলেছিল। আমার
অন্তরাত্মা দিনের নির্মল স্বচ্ছতা থেকে রাত্রির
ভয়কে আরো বেশি উপভোগ করছিল।
ওহ! নিজের মধ্যে খুঁজে পেলাম গভীর প্রশান্তি।
অটুট এ প্রশান্তি। সমস্ত জীবন ওখানে একাকী
কাটিয়ে দিতে পারতাম। একাকী - সূর্য মোহমুক্ত
হয়ে, এ জীবনকে হেমন্তের পৃথিবীর
প্রশান্তিতে পূর্ণ করে আপন বেদনাময় স্মৃতি
রোমন্থন করে কাটিয়ে দিতাম।
আর সেই বিষাদগ্রস্ত ঘড়িটি উদাসমনে তার ধাতব
টিক্টিক্ শব্দে দুঃখের প্রহর গুনে চলল।
নিঃস্তব্ধ রাত্রে আমার সঙ্গ ছিল কোনো এক
ভেকের বিষাদময় গান।
আমি সেই রাতজাগা গায়কের উদ্দেশ্যে বললাম,
"তুমিও দিন যাপন করছো চরম নিঃসঙ্গতায়। কেবল
তোমার আপন হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি ছাড়া তোমার
ঘরে কেউ নেই যে তোমার ডাকে সাড়া দেয়।
আর সেই বিষাদগ্রস্ত ঘড়িটি উদাসমনে তার ধাতব
টিক্টিক্ শব্দে দুঃখের প্রহর গুণে চলেছিল।
একদিন রাত্রে, নিঃস্তব্ধ রাত্রে অজানা কিছুর ভয়
আমার মনকে আচ্ছন্ন করল, বিক্ষুব্ধ চিত্ত-সাগরের
বুকে কোনো এক স্বপ্নছায়ার মত অস্পষ্ট।
জানালায় এসে দাঁড়ালাম। দূরে কৃষ্ণকায় আকাশের
বুকে নক্ষত্ররা নিঃসঙ্গ অস্তিত্বের বিশালতায়
জ্বলজ্বল করছে। সেই তমসাবৃত রাজ্যে নেই
জীবনের কোনো স্পন্দন।
আর সেই বিষাদক্লিষ্ট ঘড়িটি উদাসমনে ধাতব টিক্টিক্
শব্দে দুঃখের প্রহর গুনে চলেছিল।
কান পেতে রইলাম, কিছুই শোনা গেল না।
দিগ্দিগন্তে ব্যাপ্ত নৈঃশব্দ্য! ভীত সন্ত্রস্ত,
বিকারগ্রস্থ আমি প্রার্থনা করলাম সেই মহীরুহদের
প্রতি যারা এতক্ষণ অস্ফুটস্বরে কথা বলছিল, তারা
যেন আমায় সঙ্গ দেয় সেই গুঞ্জন তুলে।
বাতাসের কাছে প্রার্থনা করলাম যেন পাতায় পাতায়
মর্মর ধ্বনি তোলে, বৃষ্টি যেন শুষ্ক পাতায়
বর্ষণের শব্দ তোলে। চেতন-অচেতন
সকলের কাছে অনুনয় করলাম আমায় তারা যেন
পরিত্যাগ না করে। আর সেই নিশিচাঁদ তার কাছেও
প্রার্থনা করলাম সে যেন তার কৃষ্ণকায় ঘোমটা
ছিঁড়ে ফেলে মৃত্যু-ভয় বিভ্রান্ত আমার
চোখদুটিকে তার নির্মল রূপালি দৃষ্টিতে স্পর্শ
করে।
বনস্পতিদল, সেই নিশিচাঁদ, বর্ষণধারা, পবনহিল্লোল -
সবাই নিশ্চুপ।
আর সেই বিষাদগ্রস্ত ঘড়িটি যে এতক্ষণ উদাসভাবে
দুঃখের প্রহর গুণে চলেছিল, সে কখন চিরকালের
মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:১৩