somewhere in... blog

মুক্তি

০৬ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। গত কয়েকদিনের তুলনায় হাকিম চত্বরের এদিকটা আজ অনেকটাই প্রাণচঞ্চল । ঈদের ছুটি শেষে হলের ছাত্র-ছাত্রীরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। যারা হলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশেই থাকে তাদের কাছে আড্ডা দেয়ার জন্য সন্ধ্যার পর এই জায়গাটি খুব উপভোগ্য। তাদের অনেককেই আজ পুরাতন আড্ডার স্টাইলে নতুন করে আলাপ চালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যেই দুইজন তরুণ ছাত্রকে নিজেদের মধ্যে কোনো একটি গুরুতর বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। অবশ্য একটু পরেই এদের মধ্যে একজনকে আবার খুব হাসতে দেখা গেলো। হাসি মাত্রই সংক্রামক তাই অন্যজনের মুখেও তার প্রভাব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও প্রথম জনের আওয়াজ করে হাসিতে অন্যটিকে স্মিত সম্মতি জানাতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা কলাভবনের দিকে হাটতে শুরু করলো।

হাটতে হাটতে একজন বললো, "নীরব চলো নীলক্ষেতের দিকে যাওয়া যাক ওদিকটায় ভালো চা পাওয়া যায়। আর তাছাড়া কিছু পুরাতন উপন্যাসের বইও কেনা যাবে।"

নীরব বলল, "মারুফ ভাই দেরী হইলে হলের খাবার পাবনা ডাকসুও কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ডাকসু যেহেতু কাছেই আছে আমরা বরং এখানেই খেয়ে যাই?"

মারুফ না করলোনা। ডাকসুর ক্যান্টিনেই ওরা রাতের খাবার শেষ করলো। দুপুরের আগে আসলে ডাকসুর এই ক্যান্টিনে এক টাকা দামের রঙ চা আর সাথে সমুচা, সিঙ্গারা পাওয়া যায় । এক টাকার এই রঙ চা আবার মারুফের খুব প্রিয়। আর এখানকার খিচুড়ির তো তুলনাই হয়না। মাত্র বিশ টাকা দিয়ে এতো ভালো খিচুড়ি বাংলাদেশের কোথাও পাওয়া যায় কিনা এই নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মাংসের পিস গুলো অবশ্য অনেক ছোট। কিন্তু এই দামে যে মাংস দিয়ে খিচুড়ি পাওয়া যায় এটাই বা কম কিসের! খিচুড়ি পাওয়া গেলনা। ওদের কে ভাত-ডাল দিয়েই রাতের খাওয়া শেষে করতে হলো।

ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার পথে নীরব বললো, "ভাই! আমাদের ডাকসুর সংগ্রহশালা খুব সুন্দর। ওখানে বদ্ধ ভূমির একটা ছবির নিচে ক্যাপশন আছে " One of the millions of nameless faceless death, likewise many dead bodies were thrown into the river. The river embraced them, now it is up to us to embrace and put them in history"

মারুফ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে নীরব নামের তার এই ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। নীরব তার ডিপার্টমেন্টেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ থাকার পর সে নীরবের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, বাহ! নীরব তুমি এই বিশাল লাইনটা মুখস্থ বলে ফেলল। সত্যিই অসাধারণ! কিন্তু এই লাইনগুলোর অর্থ কী আমরা কখনো বুঝতে পেরেছি? আমরাতো এই লাইনগুলো মুখস্থ করে মনে রাখার চেষ্টা করার চাইতে বরং ডাকসু সংগ্রহশালায় পাঠিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি। আমাদের শিক্ষকরা কী কক্ষনো আমাদেরকে এই লাইনগুলো গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছে ? আর তাইতো আমাদের সব যায়গায় স্বাধীনতার এতো বছর পরেও কেবলই পরাধীনতা। এইসব কথা বলতে বলতে ওরা এরিমধ্যে অপরাজেয় বাংলার সামনে চলে এসেছে। অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর, শিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার মতন এরকম অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। ৭১ এর স্বাধীনতার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো সব মুক্তিকামী মানুষের চেতনার মূলবিন্দু। ভাস্কর্যগুলো তারই প্রমাণ। স্বাধীনতার পর থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা এইসব ভাস্কর্য ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করেছে। ভাস্কর্য মানে তাদের কাছে মূর্তি পূজার শমীল । অপরাজেয় বাংলার এদিকটাই ইদানীং আলোর ব্যবস্থা থাকায় খুব ভালো হয়েছে। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নীরব ক্লান্ত স্বরে বললো, মারুফ ভাই! চলেন না এখানে কোথাও একটু বসি খাওয়া-দাওয়ার পর খুব ক্লান্ত লাগছে।

অপরাজেয় বাংলার খুব কাছেই ওরা বসেছে। ওরা দেখলো একজন মোটামুটি মধ্যবয়স্ক মতন লোক তার সন্তানকে অপরাজেয় বাংলা দিকে উদ্দেশ্য করে বলছে, "দেখ বাবা এই হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা। বাঙলা মায়ের দামাল ছেলে- মেয়েরা।" মারুফ আর নীরবকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পেয়ে লোকটি হাসতে হাসতে বললো, "আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ইকবাল হলে থাকতাম। আমার ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। আমার ট্রেনিং ছিলো কিন্তু আমি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে সংবাদ পাঠাতাম। আমার পেশাও অবশ্য এখন সাংবাদিকতা। ছেলেকে ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয় দেখাতে নিয়ে আসছি। ওদের মধ্যে চেতনার দরকার আছে। চেতনার উন্নয়ন হচ্ছেনা একদম। ও একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।" মারুফ কে উদ্দেশ্য করে লোকটি বললো, "আচ্ছে! একটা প্রশ্ন করি? আপনাদের কি মনে হয় উন্নয়ন আগে নাকি গণতন্ত্র আগে?"

ওরা দুজনই প্রায় একসাথে বললো, "উন্নয়ন আগে"মনোবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে ওরা আরো বললো যে সবার আগে আসলে দরকার চেতনার উন্নয়ন, মানসিকতার উন্নয়ন, আচরণের উন্নয়ন।

কিছুক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে লোকটি আবার বললো, আপনারা তো ৭১ দেখেন নি। আমি দেখেছি। বলতে পারেন, মুক্তি আগে নাকি স্বাধীনতা আগে? হ্যা! আমি জানি আপনারা বলতে পারবেন না। অবশ্য আপনাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। আপনারা তো সাতই মার্চের ভাষণ শুনেন নাই। যারা শুনেছে তারাও অনেকেই এর মর্ম বুঝেনাই।আমার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। নেতার কথা ভুললে কী হবে? আমরা কিন্তু সহজেই সব কিছু ভুলে যাই। সবার আগে যেটা ভুলি সেটা চেতনা।

তিনি বললেন "মুক্তি না আসলে কী স্বাধীনতা আসবে বলেন?"

মারুফ আর নীরব অনেক বার ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছে। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রাত বারোটা থেকে একনাগাড়ে চলতে থাকলে মারুফের মা খুব বিরক্ত হয়ে সরকারকে গালাগাল করেন। প্রথম প্রথম শুনতে ভালো লাগলেও পরে মারুফের নিজেরো খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু আজ বুঝলো এতবার শুনেও সে বুঝতে পারেনি যে আসলে মুক্তি আগে তারপর স্বাধীনতা।

শেষের দিকে লোকটা বললো "যাই! আবার দেখা হবে। ভালো লাগে, ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ে। ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়লে বুঝি ঐ জীবনটাই সবচাইতে সুন্দর ছিলো। অবশ্য আপনাদের দেখলে খারাপও লাগে, এখন তো ছাত্রসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখানে দাড়ায়ে দাড়ায়ে মানুষে প্রস্রাব করে। চেতনার উপর প্রস্রাব করে। নিমক-হারামের দল।"

এইসব কথায় মারুফ কখনোই হতাশ হয়না। ও আওয়াজ করে হাসতে হাসতে বললো," যাই বলেন না কেনো, আমরা জানি মানুষ মুক্ত হবেই। মানুষ স্বাধীন।" আর নীরব! সে লোকটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতে থাকলো ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিএনপি নিয়ে সামান্য ভাবনা! :(

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:১৯

(লেখাটা বড় হলেও পড়ে দেখার আমন্ত্রন জানাই) বিএনপি নিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে আমার নিজের মায়া হয় (যদিও লিখছি সাহস করে কারন বিএনপি উগ্র দল নয় বা আমাকে মেরে ফেলবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতাঃ মা মাটি দেশ

লিখেছেন ইসিয়াক, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

যে মাটির বুকে রক্তের হোলি খেলিস সেতো তোদের মা!
কাজ ফুরালেই পাঁজিরে তুই  সেকথা জানতাম না। 

মঙ্গলের দূত সে যুগে যুগে অমঙ্গলের ক্ষেত্রে  যম।
পালাতে পারবি না সময় হলে ফুরাবে তোর দম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি সন্তুষ্ট না

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০২




নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জানার জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সংগে বৈঠক করে বলেছে ডিসেম্বর নির্বাচনের কাট অফ সময়। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ না দেওয়ায় অসন্তুষ্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাটবাজার এবং অনলাইনে কেনাকাটা.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০৪

হাটবাজার এবং অনলাইনে কেনাকাটা.....

প্রত্যাহিক বাজার করার একটা আলাদা স্বস্তি আছে। আমরা যারা হাতে ধরে বেছে বেছে শাকসবজী, মাছ গোসত এবং অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য কিনি তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিরপেক্ষতা চাই, তবে রিমোট কন্ট্রোলটা আমাদের হাতে থাক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০২



যখন কেউ রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, "আমরা নির্বাচনে অংশ নিবো , তবে নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ছাড়া নয়," তখন বুঝতে হবে—ব্যাপারটা ঠিক ভোট নয়, বিষয়টা আম্পায়ার। আম্পায়ার যদি আগেই খেলার স্কোর জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×