আর এর বসন্তের ফাকতালে কিছু কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ার চেষ্টা করল। কোথাও কোথাও গনজাগরণের ঠুলি পড়িয়ে বিশ্ববাসীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বন্দোবস্ত হল।

আর লিবিয়ায় বসন্ত এলো না শীত এলো সেই উত্তরের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আরবের অন্যান্য দেশের গণঅভ্যূত্থানের সাথে লিবিয়ার ঘটনায় স্পষ্টত কিছু পার্থক্য রয়েছে। তিউনিসিয়া, মিশর, ইয়েমেনে গণরোষ থেকে জন্মনেয়া গণঅভ্যূত্থানে পতন হয়েছে সরকারের, আন্দোলনটা দেশের ভেতর থেকে জনগনের ভেতর থেকে। কিন্তু লিবিয়ার আন্দোলনকারীরা ঠিক সাধারণ জনগন নয়, বরং জনগনের মাঝ থেকে সৃষ্টি হওয়া একটি গোষ্ঠী, আর সেখানে ‘বসন্তে’র আগমনের বিষয়ে পশ্চিমা দেবদূতরা নিশ্চিত ছিলেন না। যেখানে মিসর, সৌদি আরবে পরিবর্তনে তারা আগ্রহী নন সেখানে লিবিয়ায় গাদ্দাফীর পতনে তাদের আগ্রহ কখনোই লুক্কায়িত নয়। তারা লিবিয়ার সমৃদ্ধির পেছনে গদ্দাফীর অবদান সম্পর্কে জানতেন, তাই অভ্যন্তরীর আন্দোলনের সাফল্যের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তাই তারা সেখানে অস্ত্রক্ষেপ না করার ঝুকি নেন নি। আর দ্বিতীয় পার্থক্যটা এখানেই, লিবিয়ার জনগন মনে হয় মিসর, ইয়েমেন বা তিউনিসিয়ার মতো সরকার পতনের ব্যাপারে সৎভাবে উৎসাহী ছিল না, তাই সেখানে ‘গণঅভ্যূত্থান’কে বাইরে থেকে ফোর্স করতে হয়েছে। অর্থাৎ গাদ্দাফির পতনটা ঠিক গণজাগরণে নয়।
যে আঠারোটি আরব দেশে 'বসন্ত' বাতাস বয়ে গেছে তার মধ্যে শুধু লিবিয়াকেই গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
মাহমুদ মামদানি নামের জনৈক বিশ্লেষক আল জাজিরার ওয়েবসাইটে যথার্থই বলেছিলেন, “তিউনিসিয়ার বেন আলী ও মিশরের হোসনি মোবারকের পতনে আমরা অভ্যন্তরীণ সামাজিক শক্তির বিষয়ে সজাগ হয়েছিলাম। কিন্তু গাদ্দাফির মৃত্যূ সেই হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এখন অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে বহিঃশক্তিকে যোগ করতে হচ্ছে।“
স্প্যানিশরা যখন মধ্য আমেরিকা দখলের জন্য এজটেক আদিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করতে উদ্যত হল, তখন হত্যকান্ডের গুনগত মান বৃদ্ধির নিমিত্তে আদিবাসীদের মানুষখেকো অপবাদ দেয়া হল। তাদের নামে রোমহর্ষক সব গল্প প্রচার করে হত্যাকান্ডকে বৈধ করার প্রচেষ্টায় সাফল্য এলো। এমনি ভাবে গাদ্দাফির ব্যাপারেও অনেক আগে থেকে নানান রকম গল্পগাথা প্রচলিত হয়ে আসছে। আর স্বৈরশাসক ট্যাগ লাগাতেও খুব বেগ পেতে হয় নি। তাকে বলা হয়ে থাকে খেয়ালী শাসক, আর কিছু উদ্ভট কর্মকান্ডের মাধ্যমে কখনো বিশ্ববাসীর আগ্রহ কখনো বিরক্তি অর্জন করেছিলেন। সেই সব কাজ বা কথা একজন শাসকের সাথে না মানালেও তার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।
আপনি বেলজিয়াম বা জার্মানীকে যেভাবে শাসন করবেন সেভাবে লিবিয়াকে শাসন করতে চান তা নিতান্তই আত্মঘাতী হবে। সেখানে উদারনীতিতে দেশ পারিচালনায় সাফল্য আসলেও লিবিয়ার মতো দেশ যেখানে শতাধিক উপজাতি আর গোত্র যারা যেকোনো সময় এক জাতি আর এক জাতির সাথে যুদ্ধ করতে একমত, ফিৎনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে রাজি সেখানে তাদেরকে এক সীমান্তে বেধে রাখাই অসম্ভব হবে। তাই সেখানে গাদ্দাফিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেত হয়েছে।
কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের ফল কী এসেছে? ফলাফলটা পৃথিবীর সবচে’ পশ্চাদপদ মহাদেশে একটি সমৃদ্ধ দেশ, যে দেশটি বিশ্বের গুটিকতক দেশের একটি যার বাজেটে উদ্বৃত্ত থাকে, দেশটির কোন আন্তর্জাতিক ঋণ নেই, সাক্ষরতায় আফৃকার অন্যতম শীর্ষ দেশ, উন্নত আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিকদের সুদমুক্ত ঋণ প্রাপ্তির সুবিধা।
এই যখন গাদ্দাফি তার বিপরীতে এখন নতুন শাসকদের প্রথম চ্যালেন্জ অখন্ডতা ধরে রাখা, তার পরের প্রশ্ন জনগনকে এইসব নাগরিক সুবিধা দিতে পারবে কিনা জনগনের (এখানে জনগন বলতে অন্য কিছু বোঝায়) সরকার। যে চ্যালেন্জ গাদ্দাফি অনেক আগেই জয় করে ফেলেছিলেন। এই ‘বসন্তে’ লিবিয় জনগনকে কম্বল খুজতে হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।