কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তালা চাবি’র বিষয় একটু কম বুঝতেন। তালা-চাবি, আলমারী, সিন্দুক এসব ব্যাপার গিন্নি আর সরকার বাবুই দেখাশুনা করতেন। জমিদার হলেও কবি মানুষ, তালা-চাবি বুঝে কি কাজ! কিন্তু তিনিই হঠাৎ করে তালা-চাবি নিয়ে একটা গান লিখে ফেললেন। ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে..... না পেয়ে তোমার দেখা একা একা দিন যে আমার কাটে নারে....। গানটার মধ্যে একটু গোলমেলে ব্যাপার আছে। বিশ্বকবি বলে কথা, ভুল হলেও সই। চাবি ভেঙ্গে ফেললে তালা কিভাবে...? গানটি যথারীতি মার্কেটে খুব হিট করল।
এইসময় কোলকাতার এক পোদ্দারের মেয়েকে ডাকাতরা কিডন্যাপ করল। পোদ্দারকন্যার নাম মালতি। ডাকাতারা মালতিকে নিয়ে দুরের এক জঙ্গলে নিজেদের ডেরায় আটকে রাখল। তারা দুজন ভয়ংকর দর্শণ জাঁদরেল ডাকাতকে পাহাড়ায় বসিয়ে পোদ্দারের কাছে মুক্তিপন দাবী করতে গেল। ডেরাটি ছিল মোটা কাঠের তৈরি একটা ঘর। পোদ্দারকন্যা প্রথমে দুই পাহাড়াদার ডাকাতে কাকুতি মিনতি করতে লাগল ছেড়ে দেয়ার জন্য। তারা কি ছেড়ে দেয়ার জন্য তাকে ধরে এনেছে! তারপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগল। এবং অবশেষে গান গাইতে লাগল- ভেঙ্গে মোর ঘড়ের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে? ডাকাতদের কোন ভাবান্তর হল না, তারা বসে বসে গান শুনতে লাগল। ঠিক তখনই ওই ডেরার অদুরে বুনোপথ দিয়ে যাচ্ছিল আর এক পোদ্দারপূত্র। এই রকম পরিস্থিতিতে অর্থাৎ কোন রাজকন্যা যদি বন্দি থাকে তবে কাছাকাছি কোন রাজপূত্র শিকার করতে বা বনে ঘুরতে বা কোন কারন ছাড়াই আশেপাশে বিচরন করাই নিয়ম। পোদ্দারপূত্র বঙ্কু বিহারী’র কানে পোদ্দারকন্যার গানের আকুতি গিয়ে পৌছুল। সে তৎক্ষণাৎ ছুটে এল ডাকাতদের ডেরায়। সে ডাকাতদের মালতিকে ছেড়ে দিতে বলল। ডাকাতরা তাকে মারতে উদ্যত হল। বীর পুরুষ বঙ্কু বিহারী তাদের কুপোকাত করে মাটিতে শুইয়ে দিল। দুজনের শরীরে খুজে সে চাবিটা নিয়ে নিল। তারপর মালতির গানের নির্দেশনা অনুযায়ী চাবি তলোয়ার আঘাতে ভেঙ্গে ফেলল। তারপর ভাঙ্গা অংশ সে তালায় ঢুকাল। কিন্তু চাবি ঘুরাবে কি করে। ভাঙ্গা অংশ সবটাই ভেতরে ঢুকে বসে আছে। ঘটনা বুঝতে পেরে বঙ্কু বেকুব হয়ে গেল। আর ভেতর থেকে মালতি শুধাল, ”ওহে, রাজকুমার তালা খুলিতেছ না কেন? আমাকে তাড়াতাড়ি বাহির কর, ডাকাতরা চলিয়া আসিতে পারে।’ বঙ্কু উত্তর করল, ’সুন্দরী আমি রাজকুমার নই, পোদ্দারকুমার। তালা খুলিতে পারিতেছি না। তোমার কথামত চাবি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছি। এবং ভাঙ্গা অংশ পুরাটাই তালার ভেতরে।’
’ওকি! তুমি একি করিয়াছ? আমাকে উদ্ধার করিবার শেষ উপায়টুকো তুমি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ! আমি তো গান গাইতেছিলাম।’ বঙ্কু তরবারি দিয়ে কুপিয়ে তালা ভাংতে ব্যার্থ হল। মালতি খবর দিল যে ভেতরে একখানা মুগুর আছে। কিন্তু মুগুরটি কিভাবে বের করবে? বঙ্কু ডেরা ঘরটির চারদিক পর্যবেক্ষণ করে একটু আশা দেখল। সে কাঠের বেড়া বেয়ে উপড়ে উঠে ফোকরটাকে বড় করে সে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে বঙ্কু ঢুকার পর একটি রোমান্টিক দৃশ্যেও অবতারনা হল। আমরা তালা চাবির কারবারি, আমাদের তা দেখে কাজ নেই। মুগুরটি নিয়ে বঙ্কু একই পথে বেরিয়ে এল। তার পর সেটা দিয়ে আঘাত করে তালা ভেঙ্গে মালতিকে বের করল।
এই তালা চাবি সংক্রান্ত ঘটনায় বঙ্কু আর মালতির দুই ক্ষুব্ধ পিতা রবিবাবুর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। আর কয়েক দিন পর ওকিলগণ একটি বিয়ের দাওয়াত পেল।
এভাবে তালা-চাবি সংক্রান্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই লাগল। তারপর একদিন কোলকাতার সব তালা চাবি মেরামতকারী এক সাথে দল বেধে জোরাসাকোঁর দিকে গেল। ব্যাপারটা কি?! জানা গেল তারা কবিগুরুকে সংবর্ধণা দিতে যাচ্ছে। কারনটা কি? জানা গেল, জমিদার বাবুর একটি গান লেখার পর তাদের ব্যবসা দিন দিন উত্তর দক্ষিণ উন্নতি করছে। অনেকেই তালা খুলার আগেই চাবি ভেঙ্গে ফেলছে। আর ডাক পড়ছে তাদের। তাই তারা কবিকে বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে।
এর কয়েক দিন পর আর একটা মিছিল গেল জোড়াসাকোঁর দিকে। এবার আবার কারা সংবর্ধণা দিতে যাচ্ছে! না, কোন সংবর্ধণা নয়। এরা শহড়ের ছাতা মেরারমতকারী। তারা কবির কাছে একটা দাবী নিয়ে যাচ্ছে। কবি তালা-চাবি মেরামতকারীদেও জন্য গান লিখলেন। কিন্তু তারা কি দোষ করেছে? তাদের জন্যও গান লিখতে হবে, যাতে তাদের ব্যবসারও উন্নতি হয়। কিন্তু তারা ফিরে এল ভগ্ন হৃদয়ে, ভারাক্রান্ত মনে। কবি জানিয়ে দিয়েছেন তাদের জন্য কোন গান লিখতে পারবেন না। এভাবে চললে শহড়ের সব ধরনের ব্যবসায়ীরা তদের জন্য গান লেখার দাবী করবে। তখন ফরমায়েশী গান লিখতে লিখতে জীবন হবে সারা। তাদের ফিরিয়ে দেবার পর কবি নিজেই একটা কক্ষে ঢুকে তালা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ইহা একটি রম্য রচনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ১০:৫০