মৃতবাড়ি এবং আইসক্রিম ফ্যাক্টরি
*
তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো কাষ্ঠনির্মিত চৌকোনো শয্যায়। জীবন এবং সময়কে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেখানে। তাকে ঘিরে ছিলো শোকসন্তপ্ত, উৎসুক, ভীত, পরিচিত, অপরিচিতেরা। প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনেরা। তার জন্যে ভীনদেশী ভাষায় সুরেলা কন্ঠে প্রার্থনার আয়োজন ছিলো। সে ভাষা সবার কাছে দুর্বোধ্য হলেও অনেকেই পুণ্য উপার্জনের নেশায় মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো।
মৃতের বাড়ি হলেও বাড়িটা মৃত ছিলোনা। বরং তা ছিলো অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। প্রয়াত ব্যক্তি, শহরে যার একটা বড় মুদী দোকান ছিলো, শেষ জীবনে ছেলের ভাগ্যপ্রাপ্ত বিদেশ গমনের সুবাদে বড় রকমের অর্থ প্রাপ্তির ফলে সাচ্ছ্যন্দ এবং সচ্ছ্লতা এসেছিলো, এসেছিলো যশ এবং প্রতিপত্তি তার মৃত্যুতে অধিক লোকের সমাগম হবে এটাই স্বাভাবিক। এই মফঃস্বলে দেশের কেন্দ্রস্থল থেকে আসা পরিচিতেরা খানিকটা রুষ্ট ছিলো ক্লান্তিকর ভ্রমণেরর পরেও প্রয়োজনীয় খাবার এবং বিশ্রাম না পাওয়ায়। কিন্তু মৃতের সহধর্মিনীর থেকে থেকে উচ্চঃস্বরে বিলাপ তাদের সেইসব জৈবিক স্পৃহাকে অনেকটাই বিলোপ করে দিচ্ছিলো। তারা গম্ভীর মুখে আশপাশে হাঁটাচলা করতে থাকে। এহেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শোক প্রকাশের পরে তারা আরো কিছু বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হয়। মৃতকে সমাধিস্থ করার পরে বিশেষ এক ধর্মীয় আরাধনার আয়োজন করার তাগিদ অনুভব করে। এই আলোচনায় সোৎসাহে অংশগ্রহণ করে মৃতের বড় ছেলে এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।
একজন ধর্মসাধক
কিছু তন্ত্রমন্ত্র
তিনটে পশু
একজন কসাই
খাবার বিলিবন্টনের ব্যবস্থা
এসবের তদারকি করার জন্যে বিভিন্নজনের ওপর দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। তবে অনুষ্ঠানটি কখন হবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ বেঁধে যায়। হালকা বাকবিতন্ডাও হয়। কারণ সবাই পকেটে মানিব্যাগ, সময় এবং জীবন সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। মানিব্যাগের ভান্ডার থেকে খরচ করতে চাইলেও জীবন এবং সময়ের ব্যাপারে তারা ছিলো ভীষণ কৃপণ। তবে সুখের বিষয় এই যে, তারা অবশেষে মতৈক্যে পৌঁছুতে পারে। ফলে তারা পুনরায় সুখী এবং পরিতৃপ্ত মনে শোক প্রকাশে শামিল হয়।
*
মৃত ব্যক্তির সম্পদ এবং সম্পত্তির মধ্যে ছিলো সুরম্য বাড়ি, বিশাল দোকান, সোনাতুল্য জমি, সুন্দর সুন্দর পুত্রবধু এবং নাতি নাতনী। তবে তার একটা সম্পত্তি ছিলো অকেজো, পরিত্যক্ত। একসময় সে একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি করেছিলো, যা ভোক্তাদের চাহিদা এবং প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে পরিত্যক্ত ঐ জায়গাটা এখন বেশ কাজে লাগছে। অপেক্ষাকৃত নীচু অবস্থান থেকে আসা দরিদ্র আত্মীয়দের শোবার ব্যবস্থা ওখানেই করা হয়েছে। যেহেতু তাদের শোকের প্রকাশটা বেশি ছিলো তাই তাদেরকে পুরস্কারস্বরূপ এই অত্যাধুনিক জায়গায় থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তারা কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবে। অকেজো যন্ত্রাংশগুলো তারা ঘুরে ফিরে গভীর আগ্রহে দেখে। কেউ একজন অতি উৎসাহী হয়ে একটি যন্ত্র চালানোর চেষ্টাও করে। কিছুটা শব্দ করে ওঠে যেন সেটি! তারা সবাই বিস্ময় এবং আনন্দের সম্মিলিত ধ্বণি করে।
*
বাড়ির মূল অংশে, মৃতের শয্যার আশেপাশে বসে খোশগল্প করতে থাকা বড়ছেলে যখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, শোকের সামাজিক এবং ধর্মীয় ওজন একটা সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে এবং মৃতকে সমাধিস্থ করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়, তখনই ঘটনাটা ঘটল।
শেষবারের মত দাফনের কাপড় তুলে মৃতের মুখটি সবাইকে দেখাতে গিয়ে আবিস্কার করল যে তার চোখ খোলা। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন সবার দিকে।
এতে সবাই বিস্ময় এবং আনন্দের সম্মিলিত ধ্বণি করে।
খবর পেয়ে ঘনঘন মুর্ছা যাওয়া মৃতের স্ত্রী ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। সে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তার শরীর ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে। চোখ মেলার সাথে কথাও বলে উঠবে, এই তার প্রত্যাশা।
*
আইসক্রিম ফ্যাক্টরির অংশের মানুষজন অত্যন্ত উত্তেজিত। তারা একটি মেশিন চালু করতে সক্ষম হয়েছে অবশেষে। সেখান থেকে উন্নতমানের আইসক্রিম উৎপাদন করবে এই তাদের প্রত্যাশা। তারা দ্রুত সাফল্যের দিকে এগুচ্ছে। পরিত্যক্ত আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আবার সেই পুরোনো হিমেল যান্ত্রিকতা ফিরে পাচ্ছে।
*
মৃত ব্যক্তিটির সহধর্মিনী এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে হীমশিতল শরীরে উষ্ণতা আনয়নের জন্যে। এই প্রাণান্ত চেষ্টায় যুক্ত হয়েছে মৃতের জীবৎকালীন সময়ের কাছের আরো কেউ কেউ। তবে জনতার বেশিরভাগই দর্শক। তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সবাই তাকিয়ে আছে তার অর্ধ নিমীলিত চোখের দিকে।
কেউ চায় চোখ বুঁজে যাক আবার। যাদের পকেটে মানিব্যাগ, সময় এবং জীবন। এগুলো খরচ করতে হয় কৃপণের মত।
তাদেরই একজন, যে কফিনে শোয়ানো ব্যক্তিটিকে এখন মৃত, বৃদ্ধ, নাকি এতদিন ধরে ডেকে আসা আত্মীয়তার সম্বোধনে ভাববে, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো। সে অস্বস্তি এবং উৎকন্ঠা অনুভব করতে লাগলো। বৃদ্ধের (অবশেষে এটাকেই উপযুক্ত সম্বোধন হিসেবে মনে করল সে) জীবন আরো প্রলম্বিত হওয়া মানে তার মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্যে আরো এক বা দুইদিন বা দু ঘন্টা বেশি থাকা। কিন্তু সে এতটা সময় এখানে কাটাতে ইচ্ছুক ছিলোনা। তাই সে বৃদ্ধের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে কিনা এই আশায় আরেকবার তাকালো।
সে এক অদ্ভুৎ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল। বৃদ্ধের চোখের ভেতরে...
একটা বড় মুদীর দোকান। হাশিখুশি গোলগাল দোকানের মালিক। একটা বাচ্চা ছেলে।
"কাকা, কিসমিস খাবো!"
একটা বাচ্চা ছেলে জেদ ধরে।
"কিসমিস খাবি সে আর কি বেশি কথা! এই নে এক প্যাকেট। আরো লাগলে চেয়ে নিস। এতো তোদেরই দোকান!"
ছেলেটি প্রাণপনে চেষ্টা করে চোখ সরিয়ে নিতে। তখন তারই মত আরেকজন তার কাছে এসে মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে,
"চোখ মেলেছে, খুবই আশাব্যঞ্জক ব্যাপার, কি বল?"
সে কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না। সে মৃত বা বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। তার শরীরে হাত দেয়, "যাক এখনও হিমশীতলই আছে দেহ" ভাবে।
কিন্তু চোখদুটি ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন! "এখনও হিমশীতলই আছে দেহ!" সে সভয়ে ভাবনাটা কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের চেষ্টা করে।
*
আইসক্রিম ফ্যাক্টরির লোকজন এখন মহা উল্লসিত। তারা পুরো ফ্যাক্টরিটাকেই চালু করতে পেরেছে। যন্ত্রাংশগুলো সচল। যথাযথ হিমাঙ্ক বিদ্যমান। তারা সবাই পোষাক পরে কাজে লেগে গিয়েছে। আইসক্রিম উৎপাদিত হচ্ছে চমৎকার নির্ভুল যান্ত্রিক গতিতে। তারা বিজ্ঞাপন এবং ব্যানার তৈরীতে লেগে গেল। একাংশ তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্যে বাড়ির কেন্দ্রাংশে চলে আসলো।
"আইসক্রিম! আইসক্রিম! মজার আইসক্রিম! মাত্র দু টাকায় প্রাণ ঠান্ডা করা আইসক্রিম!"
সুরেলা গলায় গাইতে গাইতে তারা এগুতে থাকে।
আইসক্রিমঅলা যখন তার গাড়ি নিয়ে মৃতের কাছে এলো, তখনও তার চোখ খোলা এবং উপস্থিত সবার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান।
সবার উৎকন্ঠা দূর করার জন্যে সে আইসক্রিম বিলি করা শুরু করল। চমৎকার স্বাদের বিদেশী ফ্লেভারের আইসক্রিম। সবার মধ্যে হুল্লোড় পড়ে গেলো আইসক্রিম নেবার জন্যে। এই হুড়োহুড়ির ফাঁকে কয়েকটা আইসক্রিম পায়ের নিচে দলিত হল। ফলে সবাই আইসক্রিম পেলোনা। এ নিয়ে অনেকেই যখন হা হুতোশ করছে সেই সময় শায়িত ব্যক্তির চোখ আবার বুঁজে এলো। কেউ টের পেলোনা।
এখন তাকে বৃদ্ধ না বলে আবারও মৃত সম্বোধনে সম্মানিত করা যায়।
এই ভেবে স্বস্তি পেল সেই ছেলেটি, মৃত্যুর চেয়ে বার্ধক্যকে যে বেশি ভয় পায়।
এই দেখে স্বস্তি পেল মধ্যবয়স্ক সেই লোকটি, যে সময়ের প্যাকেজ প্রোগ্রামের এক তোতাপাখি কুশীলব।
খুশী হয়ে উঠলো পুরু গোঁফের কসাইটি যাকে পরেরদিন মৃতের সম্মানার্থে পশু জবাই করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।
*
মানুষজন যখন ধর্মীয় মন্ত্র জপ করতে করতে খাঁটিয়া কাঁধে মৃতকে নিয়ে যাচ্ছিলো গোরস্থানের দিকে, আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে তখন তুমুল উদ্দমে কাজ চলছে।
আইসক্রিমের গাড়ির ঘন্টার টুং টাং শব্দ এবং শববাহীদের উচ্চারিত মন্ত্র একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো।
ঘরে বসে এসব দেখছিলো স্কুলে পড়া এক পড়ুয়া বালক। সে এই অপসৃয়মানতাকে পদার্থবিদ্যার শব্দসংক্রান্ত ডপলারের সুত্রে মিলিয়ে আঁক কষতে শুরু করল। সূত্রগুলো তার মুখস্থ এবং ভালোভাবে আয়ত্ত করা। কিন্তু এই অংকটি করতে তার কেন যেন সব গুলিয়ে যেতে লাগলো!
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন