মহান আল্লাহ্র সৃষ্ট প্রতিটি মাখলুকাতেরই জোড়ার প্রয়োজন হয়। তাই আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশতে সব নেয়ামত দান করার পরও তিনি মানসিকভাবে স্বস্তি বোধ করছিলেন না। কারণ সব মানসিক প্রশান্তি ও আরাম আয়েশের পূর্ণতা আসে সমগোত্রীয় সঙ্গ থেকে।
মহান আল্লাহ্ সে কারণেই আদম (আ.) এর বাঁ-পাঁজরের হাড় থেকে বিবি হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করেন আদম (আ.) এর সঙ্গ, স্বস্তি ও মানসিক প্রশান্তির জন্য।
আদম (আ.) এরপর বিবি হাওয়াকে (আ.) দেখে এতোই মুগ্ধ হন যে তার দিকে হাত বাড়াতে চাইলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আওয়াজ এলো হে আদম! সাবধান! বিয়ের আগে তার সংস্পর্শে যাওয়া তোমার জন্য হারাম। আর এটাই হচ্ছে নর-নারীর বিয়ে ছাড়া পরস্পরের সম্পর্ক হারাম হওয়ার মিরাস।
তখন আদম (আ.) বিবি হাওয়াকে (আ.) বিয়ে করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে মহান আল্লাহ্ নিজে তাদের উভয়ের বিয়ে দেন। এটিই মানব মানবীর বিয়ের প্রথম ঘটনা।
এ কথা স্পষ্ট যে, নর সৃষ্টি করার পর তার সঙ্গ, স্বস্তি, মানসিক শান্তির জন্য নারীর সৃষ্টি করে বিয়ে নামক বন্ধনের মাধ্যমে তাদের পরস্পরের আত্মিক, বৈষয়িক, মানসিক, জৈবিক সব বিষয়ে মিলনের বৈধতা দিয়েছেন। “ তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার হতে তার জোড়া সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে প্রশান্তি পায়” সূরা আ’রাফ-১৮৯
অর্থাৎ এক পক্ষ ছাড়া অপর পক্ষ অসম্পূর্ণ। “তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের হতে সৃষ্টি করেছেন সঙ্গীদের, যাতে তোমরা ওদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের প্রতি প্রেম প্রীতি; চিন্তাশীলদের জন্য এতে আছে নিদর্শন"।
সুরা রুম-২১।
শুধুমাত্র সঙ্গ, প্রেম, প্রীতি, সহযোগিতা আর প্রশান্তির মাধ্যমে জীবন যাপনের জন্যই নর-নারীর একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি। আর সে জন্যই মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন “ তারা তোমাদের লেবাস, তোমরা তাদের লেবাস” সুরা বাকারা-১৮৭।
আর নরকে সৃষ্টি করা হয়েছে শক্তি,সামর্থ্য দিয়ে। নারী অপেক্ষাকৃত কোমল ও নরম। তাই মহান আল্লাহ্ নারীকে পুরুষের অধীন করে দিয়েছেন। “নারীদের অনুরূপ ন্যায়তঃ অধিকার আছে পুরুষের ওপর, কিন্তু নারীদের ওপর পুরুষের অধিকার স্বীকৃত; আল্লাহ পরাক্রমশীল, বিজ্ঞ”।
সূরা বাকারা-২২৮।
“পুরুষরা নারীদের ওপর অধিকর্তা তা এ কারণে আল্লাহ্ একের ওপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং পুরুষেরা তাদের অর্থ ব্যয়ভার বহন করে, ফলে বিদুষীরা পুরুষের অনুগত থাকে এবং পুরুষের অজ্ঞাতে ও সংসার তত্ত্বাবধান করে আল্লাহর তত্ত্বাবধানের মধ্যে” সূরা নিসা-৩৪।
যেহেতু নারী কোমল স্বভাবের এবং যখন একজন নারী স্ত্রী হন তখন তিনি সম্পূর্ণভাবে নতুন পরিবেশে আসেন। যার আলো বাতাস সংস্কৃতি কৃষ্টি, রুচি, জীবন বোধ সবই একজন নারীর কাছে নতুন। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক নারীকে শৈশব কৈশোর যৌবনের চেনা পরিচিত পরিবেশ মানুষ জন ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা নতুন পরিবেশের একজন হয়ে যেতে হয়। এজন্য তার দরকার নির্ভরতার জন্য একজন যোগ্য পুরুষ যিনি হবেন একাধারে অভিভাবক, দায়িত্বশীল, যোগানদাতা ও সর্বতভাবে বন্ধুভাবাপন্ন জীবন সঙ্গী। স্ত্রীর উপমা যদি উদ্ভিদ হয় তাহলে স্বামীকে একাধারে আলো পানি, বাতাস, মাটি এক কথায় একটি উদ্ভিদের বেঁচে থাকার সব নিয়ামকের ভূমিকায় থাকতে হবে। সব নিয়ামক ঠিক থাকলেই যেমন একটি উদ্ভিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় তেমনি ভালো ফলও পাওয়া যায়। ঠিক একই কার্যকারণ একজন স্ত্রীর ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ স্বামীর দায়িত্ব বেশি। তাই একজন স্বামীকে হতে হবে অত্যন্ত কোমল ও মাধুর্যপূর্ণ ব্যবহারের অধিকারী, সহজ, কঠোরতা বিবর্জিত, নরম মেজাজ,সুঅভ্যাস, স্ত্রীর চাহিদার প্রতি সহানুভূতিশীল, স্ত্রীর ঘরের কাজের প্রতি সাহায্যের মনোভাব সম্পন্ন, বৈষয়িক বা জৈবিক চাহিদায় পরিমিত স্বভাবের, রসিক, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা সম্পন্ন। ঠিক গল্পের আবু জরার মতো যা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশাকে (আ.) বলেছিলেন। স্বামীকেই এতো কোমল, এতো ভালো বৈশিষ্ট্যের হতে হবে। কারণ, মহান আল্লাহ্ নারীকে পুরুষের অধীন করেছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওসিয়ত করে গেছেন নারীদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার করার জন্য।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নারীদের ( সঙ্গে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও কোমল ব্যবহার অবলম্বন করা ) সম্পর্কে আমার ওসিয়ত বা বিশেষ পরামর্শ নির্দেশ তোমরা রক্ষা করে চলবে। নারী (জাতির মূল অর্থাৎ সর্বপ্রথম নারী আদিমাতা হাওয়া) পাঁজরের (ঊর্ধ্বতম) হাড় হতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়সমূহের মধ্যে ঊর্ধ্বতম হাড়খানাই সর্বাধিক বাঁকা। তুমি যদি তা পূর্ণ সোজা করতে তৎপর হও (যেমন তুমি তোমার মন মতো সোজা না করে ছাড়বে না) তবে তা ভেঙে যাবে। আর যদি তোমার মন মতো পূর্ণ সোজা করায় তৎপর না হও, তবে অবশ্য তার মধ্যে একটু বক্রতা থাকবে, (কিন্তু ভাঙবে না আস্ত থাকবে, তুমি তার দ্বারা সাহায্য, সহায়তা লাভ করে নিজের অনেক কল্যাণ সাধন করতে পারবে)।
সুতরাং আবার বলছি, নারীদের (নারীদের সঙ্গে ধৈর্য সহিষ্ণুতা ও কোমল ব্যবহার) সম্পর্কে আমার ওসিয়ত বা বিশেষ আদেশ পরামর্শ তোমরা রক্ষা করে চলবে। বোখারি শরীফ,ষষ্ঠ খণ্ড,হাদিস নম্বর-২০৪৫।
আবু হুরায়রা (র.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, স্ত্রী লোককে পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে কখনো তোমার সঙ্গে সহজ ব্যবহার করবে না বা সোজা হয়ে চলবে না। আর যদি তুমি তার বক্রতা মেনে নিয়ে তার কাছ থেকে ফায়দা পেতে চাও তাহলে ফায়দা পাবে। আর যদি তার বক্রতা সোজা করতে যাও তাহলে তাকে ভেঙে ফেলবে। আর ভেঙে ফেলার অর্থ হলো তালাক। মুসলিম শরীফ,৫ম খণ্ড, হাদিস নম্বর-৩৫১০।
এতসব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “এবং তাদের আটকে রেখো না যাতে তোমরা তাদের যা প্রদান করেছো তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোনো প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে। নারীদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর। অতঃপর যদি তাদের অপছন্দ কর, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ্ অনেক কল্যাণ রেখেছেন”-সুরা নিসা-১৯।
প্রকাশ্য অশ্লীলতা বা ব্যভিচার করা প্রসঙ্গে উক্ত আয়তের অংশ টুকু পরবর্তীতে রজমের আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গেছে (তাফসিরে ইবন আব্বাস)।
কোনো নারীর অসদাচারণ সত্ত্বেও তার সঙ্গে সংসার করার নির্দেশ করেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন হয়তো এর মধ্যে যে কল্যাণ রয়েছে তা তোমরা প্রত্যাখ্যান করলে। অর্থাৎ ওই কল্যাণের জ্ঞান শুধুমাত্র মহান আল্লাহর রয়েছে।
যে স্বামী তার স্ত্রীকে অবজ্ঞার চোখে দেখে, তার জীবনে সুখ শান্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমান অনুরাগ না থাকলে পারিবারিক সুখ থাকে না। আজকের সমাজে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক দাম্ভিকতার কারণে উভয়ে অসুখী থাকে এবং এ থেকে মুক্তির উপকরণ খুঁজতে গিয়ে পরকিয়ার মতো পাপাচারে লিপ্ত হয়।
পারিবারিক সুখ না থাকলে স্ত্রীর রুপ যৌবন যেমন নষ্ট হয় তেমনি স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণও কমে যায়। শরীর বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান এটা প্রমাণ করেছে যে মনের আনন্দ এক প্রকার টনিক। এই টনিক শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখে। মনের জোর থাকলেই শরীর ও মনে সতেজতা আসে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পায়। জীবন সুন্দর হয়। ঘরের পরিবেশ সুন্দর হয়, সন্তান-সন্ততি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন সে পবিত্র শরীর ও মনের থাকে। বাবা-মা বা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুর মন মানসিকতা গড়ে তোলে। তাই দাম্পত্য সম্প্রীতি অতি প্রয়োজনীয়।
আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে প্রশ্ন করেছেন, “দল দু’টির দৃষ্টান্ত-অন্ধ,বধির এবং দৃষ্টি শক্তি ও শ্রবণ শক্তি বিশিষ্টের অনুরূপ, তুলনায় দু’টি কি সমান? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?”(১১:২৪)।” সূরা হুদ-২৪।
আমরা যখন বলি, “আমি তোমাকে আর ক্ষমা করবো না”, বা “আমার পক্ষে তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব না”, বা “জীবনেও আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না”, বা “এটা আমার পক্ষে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব না”...ইত্যাদি, মনে রাখতে হবে যখনই আপনি “পারবো না”, “করবো না”, “মানবো না”, “মানা সম্ভব না”, “ক্ষমা করবো না”--- এই জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার করেন, তখন এক অর্থে আপনার অক্ষমতাই প্রকাশ পায়। অর্থাৎ আপনার আর ক্ষমতা নেই মাপ করার বা মেনে নেওয়ার। কিন্তু মহান আল্লাহর এক অন্যতম গুণ হচ্ছে ক্ষমা।এই ক্ষমা যদি আমরা করতে পারি তাহলে কিন্তু ক্ষমতা আবার প্রথম থেকে শুরু হয়ে যায় এবং ক্রমাগত ক্ষমা ক্রমাগত ক্ষমতার আধার।এটাই মহান আল্লাহর রীতি।
তাই স্ত্রীর হক বা অধিকার হলো এই সব “না” কে বাদ দিয়ে তার বক্রতাকে মেনে নেওয়া কৃতজ্ঞতার আলোকে। কারণ একজন স্ত্রী যদি কর্মজীবী হন তাহলে স্বামী, সংসার, সন্তান, কর্মক্ষেত্র সবই তিনি একা সামলে নেন এবং একজন গৃহিণী ও অনুরূপ। পক্ষান্তরে একজন স্বামী কখনোই সাধারণত এ রকম নন। সুতরাং একজন স্ত্রী, যিনি এতো কিছু করেন তিনি তো একটু অধিকার বেশি খাটাতেই পারেন। যিনি কাজ বেশি করেন তিনিই ভুল করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ কাজ যে করে না তার ভুলও নেই।
সূত্র- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম