প্রথম পর্ব : Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব : Click This Link
বিপ্লবের তরঙ্গসংকুল পথ
ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ১৪ জুলাই ১৭৮৯ ধরা হলেও তা ধাপে ধাপে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়েছে। বাস্তিলের পতন, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকারের ঘোষণা ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে বিপ্লব এগিয়ে গেল প্রজাতন্ত্র ঘোষণার স্তরে। ১৭৯১ সালের ১০ আগস্ট প্যারিসের সংগ্রামী জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয়। বিপদ টের পেয়ে রাজা-রানী আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন। বন্দি রাজা বাধ্য হলেন সংবিধানকে স্বীকৃতি দিতে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটে, স্থাপিত হয় প্রজাতন্ত্র। এটাকে ধরা হয় বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর হিসাবে।
১৭৯২ এপ্রিল মাসে প্রতিবেশী অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সে যুদ্ধে ফ্রান্সের বিপর্যয়ও ঘটে। এ সময় জিরদ্যাঁ গোষ্ঠী (ফইয়্যা মন্ত্রীসভা) ‘জন্মভূমি বিপন্ন’ শ্লোগান তোলে এবং বিদেশী শক্তির সহযোগিতায় তারা ঘোষণা করে যে রাজতন্ত্র-বিরোধীদের প্রতি কঠোর শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ফেদেরের স্বেচ্ছাসেবকদের প্যারিসে সমবেত হতে থাকে। মার্সেইর ফেদেরেরা যে গান গাইতে গাইতে প্যারী আসে সেই গানই বিপ্লবী ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় বিপ্লব দোদুল্যমান আইন সভার ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। ক্ষমতায় আসে জিরদ্যাঁপন্থী বা জিরোন্ডিস্টরা। ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বরে আইন পরিষদ বাতিল করে ডাকা হয় জাতীয় কনভেনশন। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এ কনভেনশন গঠিত হয়। জ্যাকোবিন গোষ্ঠীর রাজত্বকালকে ধরা হয় বিপ্লবের তৃতীয় পর্ব হিসাবে। সামন্ততন্ত্র পুরোপুরি উচ্ছেদ, রাজার বিচার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে জিরদ্যাঁ গোষ্ঠী আপোষমুখী ভূমিকা গ্রহণ করলে জ্যাকবাঁপন্থী বা জ্যাকোবিনরা বিপ্লবের সামনের কাতারে চলে আসে। ১৭৯৩ সালের ২ জুন প্যারিসের বিপ্লবী জনতা ঘেরাও করে জাতীয় কনভেনশনের সভাস্থল। বন্দি করা হয় জিরদ্যাঁপন্থী নেতাদের। এরপর জ্যাকোবিনদের নেতৃত্বেই সামন্ততন্ত্র ও যাজকতন্ত্রের পুরোপুরি উচ্ছেদ সাধিত হয়।
বুর্জোয়াশ্রেণী শক্তি নিয়ে উদ্ভূত হলেও এ শ্রেণীর কোনো একক নিটোল চরিত্র ছিল না। এদের মধ্যে পুঁজি লগ্নীর কারবারে লিপ্ত অংশ ছিল যথেষ্ঠ শক্তিশালী, সামন্তী ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সংযোগ ছিল নিবিড়; তাদের ওপর রাজা নির্ভরশীল থাকত, বিনিময়ে তারাও নানা রকম সুবিধার ভাগ পেত। ফলে বিপ্লবের ময়দানে এদের ভূমিকা সংস্কারবাদী হলেও ছিল রক্ষণশীল, খানিকটা সামন্ততন্ত্রের সমর্থক। অভিজাত ও যাজকদের মধ্যে যারা বিপ্লবের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মতো এরাও ছিলেন দোদুল্যমান, রাজতন্ত্র-সামন্ততন্ত্র পুরোপুরি উচ্ছেদের প্রশ্নে বিপ্লব-বিরোধী। অন্যদিকে ফ্রান্সের গরিব মানুষেরা, বিশেষত নারীসমাজ ও শ্রমজীবীরা তুলনায় ছিল অনেক বেশি বিপ্লবকামী।
প্যারিসের বিপ্লবী নারী ও শ্রমজীবী জনগণ
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ফ্রান্সের, বিশেষত প্যারিসের নারীদের ভূমিকা, তাদের বিপ্লবী উদ্যোগের কথা। শুধু যে জনগণের প্রতিটি অভিযানে দরিদ্র, নিপীড়িত পরিবারের নারীরা অংশগ্রহণ করেছে তাই নয়, নারীদের ভুখা মিছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই উত্তাল সময়ে নারীরা দাবি তুলেছে একচেটিয়া সম্পত্তি তথা একচেটিয়া পুঁজিকে খর্ব করা, খাদ্যশস্যের দর বেঁধে দেওয়া, জমির খাজনা নির্দিষ্ট করা, নারীদের ওপর পুরুষের অত্যাচার বন্ধ করার দাবি তুলেছে। বাস্তিল দখল, রাজাকে বন্দি করা, জনগণের কর আদায়, ন্যায্যমূল্যে জোর করে জিনিস কেনা, রাজার সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করা, নিজেদের সঞ্চয় এমনকি গয়না দিয়ে বিপ্লবীদের সহযোগিতা করা, বিপ্লবী সৈনিকদের জন্য মোজা বুনে দেওয়া, সুলভ দামে খাদ্যের দাবিতে কঁভ্যাসিয়ঁ ঘেরাও, জার্মিনাল ও প্রেয়ারিয়ালের সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রচেষ্টা, সব কিছুতে মেয়েরা ছিল অগ্রণী। প্যারিসের একদল মেয়ে একটি চিনির গাড়ি থামিয়ে ন্যায্যমূল্যে -- অর্থাৎ মোটামুটিভাবে মূল্যবৃদ্ধির আগের দামে -- চিনি বেচতে বাধ্য করল। নারীদের এ ভূমিকায় উৎসাহিত হয়ে সাধারণ মানুষও দোকানে দোকানে হানা দিয়ে ‘ন্যায্যমূল্যে’ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে লাগল। তারা জারি করল ‘জনগণের কর’। ধোপানিদের একটি দল মিছিল করে সাবানের দাম বেঁধে দেওয়ার দাবি করেছিল। অনেকটা মেয়েদের চাপেই সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমার আইন পাস হয়েছিল। সাঁকুলোৎ’দের সভা-সমিতিগুলোতে মেয়েরাও যোগ দিত। ১৭৯০ সালে ক্লদ দানসার্ট প্রতিষ্ঠা করেন ‘নারী-পুরুষের ভ্রাতৃত্ব সংঘ’। মেয়েরা ১৭৯৩ সালে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব সংগঠন গণতান্ত্রিক নারী সমিতি (Society of Revolutionary Republican Women)। শুধু নিজেদের জন্য নয়, তারা সমাজের দুর্দশাগ্রস্ত নারীদের কথাও ভেবেছিল। নারী গণতান্ত্রিক সমিতির একটি দাবি ছিল গণিকাবৃত্তি বন্ধ করা, গণিকাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
জিরদ্যাঁ নেত্রী পলিন রোলাঁ, অলিম্পে দ্য গুগজ এমন অনেক নারীনেত্রীকেই প্রাণ দিতে হয়েছে গিলোটিনে। নারী গণতান্ত্রিক সমিতির নেত্রী রোজ লাকঁবকে কেউ কেউ বিশ্বের প্রথম নারী কমিউনিস্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন। শোনা যায়, নেপোলিয়ান যখন নারীদের রাজনীতি করার অধিকার খর্ব করেছিল তখন এক বিপ্লবী নারী তার মুখের ওপর জবাব দিয়েছিল, ‘সম্রাট, মেয়েদের মাথা যদি গিলোটিনে কাটা যেতে পারে, তাহলে তারা কেন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না?’ মেয়েদের রাজনীতি করা নিয়ে বিপ্লবীদের মধ্যেও মতবিরোধ ছিল। সবশেষে ত্যারমিদরী প্রতিক্রিয়ার আমলে মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
ফরাসি বিপ্লবে দরিদ্র জনগণের বিশেষত পেটিবুর্জোয়া জনগণের ভূমিকা শুধু কিছু মিছিল আর সশস্ত্র অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বুর্জোয়াদের উচ্চারিত সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণী এদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সামন্তীসমাজ থেকে মুক্তির বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু বিপ্লবের গতিপথে কিছুদূর এগোনোর পর এরা দেখেছে, যে স্বাধীনতার কথা তারা শুনেছে এবং ভেবেছে, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বুর্জোয়াদের সম্পত্তি অর্জনের ও তার সাহায্যে সম্পত্তি বৃদ্ধির অধিকারের স্বাধীনতায় (১৭৮৯ সালে ঘোষিত মানবাধিকারের ঘোষণায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য ঘোষণা করা হয়)। তারা দেখল যে দরিদ্র জনগণ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেল। পেটিবুর্জোয়াদের সংগঠিত শক্তি ‘সাঁকুলেৎ’-দের ১৭৯৩ সালের কনভেনশন থেকে দাবি তোলা হল যে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দর, শ্রমের মজুরি, শিল্পবাণিজ্যের মুনাফা -- এগুলির হার বিনাশর্তে বেঁধে দিতে হবে। তারা দাবি তুলেছিল, সম্পদের ঊর্ধ্ব সীমা বেঁধে দিতে হবে, প্রত্যেকের জন্য একটাই ঊর্ধ্বসীমা থাকবে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি চাষের জমি কেউ রাখতে পারবে না, কোনো নাগরিক কেবল একটা কারখানা বা একটা দোকানের মালিক হতে পারবে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হল, ‘যারা বলে সম্পত্তির স্বাধীনতা অলঙ্ঘ্যনীয়, তারা ভুল বলে কারণ বাস্তব প্রয়োজনের বাইরে সম্পত্তির কোনো ভিত্তি নেই’। শ্রমিকদের অবস্থার কথা আমরা আগেই বলেছি। এরাই সেদিন দলে দলে এগিয়ে এসে এক একটা জুর্নি (Journee) বা বিপ্লবী অভিযানকে সফল করে তুলেছিল। এরাই সেদিন ভেঙে দিয়েছিল কুখ্যাত শুল্ক ঘাঁটি -- রাজার খাজনা আদায়ের কেন্দ্রস্থল, এদের হাতেই ধ্বংস হয়েছে সামন্তী শাসনের ঘৃণিত প্রতীক বাস্তেই বা বাস্তিল দুর্গ। রাজার আদেশ মেনে তৃতীয় এস্টেটের ডেপুটিদের বন্দি করতে অস্বীকার করার সৈন্যদের কারারুদ্ধ করা হলে এরাই জেল ভেঙে সৈন্যদের মুক্ত করেছে।
বিপ্লব যত এগিয়েছে, দেখা গেছে যে পেটিবুর্জোয়া জনগণ অসংগঠিত হলেও নেতৃত্ব যখনই বিপ্লবী লক্ষ্যকে সামনে তুলে ধরেছে, জনগণ তার সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। যখই নেতৃত্ব আপোষ করতে চেয়েছে, কিছুদূর এগিয়ে থেমে যেতে চাইছে, জনগণ তার বিরোধিতা করেছে। চলতে চলতে পেটিবুর্জোয়া জনগণও খানিকটা সংগঠিত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সেদিন আধুনিক রাজনৈতিক দল বলতে যা বোঝায় তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ছিল ভ্রণাবস্থায়। তখন গড়ে উঠেছিল কিছুটা ঢিলেঢালা ধরনের সংগঠন বা গোষ্ঠী। মানুষ কোনো বিশেষ নেতা বা ব্যক্তির পেছনে জোট বাঁধত, কোনো বিশেষ পত্রিকাকে ঘিরে গোষ্ঠী বা সমিতি গড়ে উঠেছিল। জ্যাঁকোবিনদের ক্লাবগুলো গড়ে উঠেছিল শহরাঞ্চলে। কর্দেলিয় ক্লাব ছিল সমাজের নিচুতলার মানুষদের নিয়ে। প্যারিসের প্রতি পাড়ায় মহল্লায় গরিব-শ্রমজীবী মানষের সংগঠন সাঁকুলোৎ’দের ক্লাব বা সমিতি গড়ে উঠেছিল। তারা নিজেদের অফিসার নির্বাচন করত, স্থানীয় প্রশাসনের ভার নিত, আবার জাতীয় রাজনীতির দিকে তীক্ষ্ম নজর রাখত। সমিতির মিটিংয়ে আসার জন্য প্রত্যেককে চল্লিশ সু (পয়সা) করে দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। এর পেছনে যুক্তি ছিল যে গরিব মানুষ রুজি-রোজগার বাদ দিয়ে রাজনীতি করবে কিভাবে? তাদের এ সহায়তা না দেওয়া হলে রাজনীতি করতে পারবে না, আর এর ফলে রাজনীতি ধনীদের একচেটিয়া হয়ে যাবে। ক্লাবের মিটিংয়ে নানা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, পত্রিকা পড়া, দার্শনিকদের রচনা পাঠ করত। সাঁকুলোৎ’রা পথনাটকও মঞ্চস্থ করত যেখানে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি, জনগণের সমস্যা সবাই উঠে আসত। সাঁকুলোৎ’দের সবচেয়ে বড় অবদান নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের (direct democrecy) চর্চা, যার কথা রুশো বলতেন। কয়েক বছর অন্তর অন্তর নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচন করে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকা নয়। জনগণ নিজেরাই সরাসরি প্রশাসন চালাবে, আইন পাস করবে। ক্লাবের অফিসারদের নির্বাচকরা ইচ্ছামতো প্রত্যাহার করে (right to recall) নিতে পারত। প্রাচীন রোম ও গ্রিসে খানিকটা এ ধরনের চর্চা হত, এ পদ্ধতিরই উন্নত ও বিকশিত রূপ আমরা দেখেছি রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে।
সাঁকুলোৎ’দের রাজনীতি নরমপন্থী-আপোষকামী বুর্জোয়া শক্তিকেও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। বিপ্লব-বিরোধীদের বিরুদ্ধে সাঁকুলোৎ’দের আপোষহীন লড়াই নরমপন্থী বুর্জোয়াদের আরো বেশি করে বিপ্লব বিরোধী করে তুলেছিল। ফরাসি বিপ্লবের রোবসপীয়ের ছিলেন এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। রুশোর একনিষ্ঠ অনুগামী রোবসপীয়ের যখন নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তখন একদিকে রাজতন্ত্রের সমর্থক বিদেশী রাজশক্তির হাতে ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনী ক্রমাগত পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে, বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী তখনও পর্যন্ত সংহত হয়ে ওঠেনি, অপরদিকে দেশের মধ্যে হীনবল রাজতন্ত্রী-অভিজাত-যাজকশক্তি, আপোষকামী উচ্চবর্গীয় বুর্জোয়াশ্রেণী, জিরদ্যাঁ গোষ্ঠীর মতো মধ্যবুর্জোয়ারা, এমনকি তাঁর নিজের জ্যাকবাঁ গোষ্ঠীতে দাঁতঁ’র মতো অনেকে বিপ্লবের অগ্রগতিকে রোধ করতে চাইছে, বিপ্লববিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। ওই সময় রোবসপীয়ের নির্ভরযোগ্য সহযোগি হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন বিপ্লবী সাঁকুলোৎ জনগোষ্ঠীকে। এদের সাথে নিয়েই তিনি কঠিন হাতে বিপ্লববিরোধী বিশ্বাসঘাতকদের দমন করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
গরিব মানুষ, বিশেষত সাঁকুলোৎ’দের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার ঘটনা বুর্জোয়াশ্রেণী ও বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্বকে প্রবল করে তোলে। ১৭৯৪ সালের ২৮ জুলাই ফরাসি বিপ্লবের মহান নেতা রোবসপীয়ের গিলোটিতে প্রাণ দিলেন। বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল উপরের দিকের বুর্জোয়াদের হাতে, তারাই ক্ষমতা দখল করল। শুরু হল ত্যারমিদরী প্রতিক্রিয়া। এ সময় সাঁকুলোৎ’দের কেবল অর্থনৈতিকভাবে সর্বনাশ করা হল তাই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের পাখা কাটার বন্দোবস্ত হল। বিপ্লবী কমিটিগুলি তুলে দিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হল। বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সবক্ষেত্রে প্রতিআক্রমণ শুরু হল। এক আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলা হল যারা সাঁকুলোৎ’দের খতম করা। এরই এক পর্যায়ে সাঁকুলোৎ জনগণ জ্যাঁকবা গোষ্ঠীর অবশিষ্টাংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জার্মিনাল ও প্রেয়ারিয়লের বিদ্রোহ (এপ্রিল ও মে ১৭৯৫) শুরু করেছিল। কিন্তু তাদের সে বিদ্রোহ সফল হয়নি। বুর্জোয়াদের এই প্রতিবিপ্লবী বর্বরতার ধারাবাহিকতায় নেপোলিয়ন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হল। ১৭৯৯ সালে এক ক্যুদেতার মাধ্যমে নেপোলিয়ন বোনাপোর্তের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল প্রকারান্তরে রাজতন্ত্রই কায়েম করেছিল।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা
জাতি সম্পর্কে, গণতন্ত্র সম্পর্কে ফরাসি বিপ্লব নিয়ে এল এক নতুন ধারণা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুরনো ল্যাটিন ধারণা অনুযায়ী জাতি বলতে বোঝাত একটি দেশের অধিবাসীদের। ফরাসি বিপ্লবের মধ্যদিয়ে জাতি শব্দটি একটি নতুন ব্যঞ্জনা পেল। ‘জাতি’ শব্দটির অর্থ হয়ে দাঁড়াল দেশের নাগরিকদের দ্বারা সৃষ্ট এক রাজনৈতিক সমষ্টি। বিশেষত, রাজা ষোড়শ লুইকে খোদার প্রতিভূ থেকে সাধারণ নাগরিক লুইতে পরিণত করার পর, জাতি শব্দটি তার সার্বভৌমিক পরিপূর্ণতা লাভ করল। কিন্তু এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ‘জাতি’ নিঃসন্দেহে বুর্জোয়াদের শ্রেণীগত প্রাধান্যে উত্তরণের প্রতীক, মাধ্যম ও অভিব্যক্তি। ১৭৮৯-এর ৪ আগস্ট প্রাদেশিক বিশেষ সুবিধাগুলির বিলোপসাধন, প্রদেশগুলির সমতাভিত্তিক, সুনির্দিষ্ট শাসনতান্ত্রিক বিভাজন করা হল। সাম্যভিত্তিক এই নতুন প্রাদেশিক বিভাজনের কাঠামোটি নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগকে সহজতর করেছিল। প্রাদেশিক পুনর্গঠনের সমান্তরালে ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর বিপ্লবীদের রচিত সংবিধান ঘোষণা করেছিল যে মাতৃভূমি হল ‘এক এবং অবিভাজ্য’। পুরনো সামন্তীয় রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ সাধন করে তারা প্রণয়ন করেছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মানচিত্র।
একইভাবে সেদিন ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আইনি সমতা। দার্শনিক হেগেলে বলেছিলেন যে ফ্রান্সে ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইন বদলায়। দেশটির কোথাও ছিল লিখিত আইন, কোথাও প্রথাগত আইন। বিপ্লরেব পর একটিমাত্র নির্দিষ্ট আইন ও বিচারব্যবস্থার আওতায় এল সমগ্র দেশ। ১৭৯০-এর ৫ জুলাই সংবিধানসভা আইন করে বিচারপতিদের সরকারি বেতনভোগী কর্মচারীতে পরিণত করল এবং বিনাখরচে সাধারণ মানুষের কাছে বিচারব্যবস্থাকে পৌঁছে দিল। এই আইন অনুযায়ী, শুধু অভিজাতরাই নন, যে-কোনো নাগরিকই বিচারপতি পদে নিযুক্ত হতে পারবে।
ফরাসি বিপ্লবের যুগান্তকারী ঘটনাটি ইউরোপে এক অবিশ্বাস্য ওলটপালট ঘটিয়েছিল। এ সময় থেকেই ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠল এক আন্দোলন, এক যুদ্ধ, যা নিছক রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বলা দরকার যে আংশিক হলেও, জনগণের এক বিরাট অংশকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়ে বিপ্লব গণতন্ত্রকে প্রয়োগ করে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জোরদার করে। ফরাসি বিপ্লবের ধারণা অনুযায়ী গণতন্ত্র হল এমন এক জমানা যেখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলির পেছনে থাকবে জাতীয় স্বার্থ এবং যেখানে নাগরিকের অধিকার থাকে সুরক্ষিত। বিপ্লবের পর নাগরিকদের নিজ নিজ পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, সমস্ত সরকারি পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ এবং নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে জোরদার করেছিল। ফরাসি বিপ্লব এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল যা থেকে ফ্রান্স তো বটেই ক্রমে ইউরোপ এবং সারা পৃথিবী লাভবান হয়েছে। আজকের পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ, জাতীয় তথা জনগণের সার্বভৌমত্বের ভাবাদর্শটির জন্য ফরাসি বিপ্লবের কাছে ঋণী।
এর পাশাপাশি ফ্রান্সে কার্যকর করা হল রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। বিপ্লবী সরকার কর্তৃক নাগরিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হল। ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চ ও এর যাজক-পাদ্রীদের দৌরাত্ম্যে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। জোর করে ধর্মান্তর করানোর ঘটনাও ঘটত। ১৭৯১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নিয়ম করা হল, নাগরিকদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গির্জার কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না, থাকবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। যেসব নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় যেগুলিতে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সুপরিস্ফুট। উদাহরণস্বরূপ, বিধিবদ্ধ উপায়ে সরকারি কর্মচারীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত না হলে, বিবাহকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। এ ধরনের বিবাহে যাজকদের অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ করা হয়। এমনিভাবে নিয়ম করা হয় যে ‘কোনো পার্থক্য না করে, সমস্ত অধিবাসীদের’ জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সংক্রান্ত তথ্যগুলি শুধু সরকারি কর্মচারীরাই লিপিবদ্ধ করবেন।
ফরাসি বিপ্লব আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সেটি হল মেট্রিক পদ্ধতি চালু। ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ৮শ’ ভিন্ন রকমের পরিমাপ-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল যা কৃষক, কুটিরশিল্পী, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন লেনদেনকে ব্যাহত করত। বিশেষত উঠতি বুর্জোয়া এবং ব্যবসায়ীদের জন্য এ ছিল এক চরম দুর্ভোগ, তাদের আকাক্সিক্ষত অখ- বৃহৎ জাতীয় বাজার গড়ে তোলার পথে বাধা। ১৭৯০ সালের ৮ মে সংবিধান সভায় পরিমাপ ব্যবস্থার ঐক্যসাধন সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় এবং ১৭৯৩ সালের ১ আগস্ট এ পদ্ধতি সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়। ১৭৯৫ সালের ৭ এপ্রিল থেকে তা সমগ্র ফ্রান্সে প্রচলিত হয় এবং পরে পুরো ইউরোপ এবং গোটা বিশ্বে এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে।
বিপ্লবের অভিমুখ : সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ
বিপ্লবের সময় একজন গরিব ধর্ম যাজক বলেছিলেন, “মানুষের জীবনের চেয়ে কি মূল্যবান কতিপয় শয়তানের সম্পত্তির অধিকার?” ফরাসি বিপ্লবই প্রথম এ চিন্তা তুলে ধরে যে সমাজে বৈষম্য আর অবিচার-নিপীড়নের ভিত্তি হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। রুশোর লেখায় আমরা তার সন্ধান পেয়েছি। এ বিপ্লব আরো দেখিয়েছে সমাজের তথাকথিত নিচুতলার অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্ঘশক্তির স্বরূপ। ফরাসি বিপ্লবের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলোতে গরিব শ্রমজীবী মানুষের মনে এ উপলব্ধি স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছিল যে, বুর্জোয়ারা যে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার শ্লোগান তুলেছে তা আসলে বুর্জোয়াদের সম্পত্তির অধিকার এবং শোষণের স্বাধীনতা। গরিব মানুষ শোষণ থেকে মুক্তি পায় নি, কারণ শ্রেণীর উচ্ছেদ হয়নি। বিপ্লবের এক পর্যায়ে যখন গরিব মানুষের মধ্যে এসব চিন্তা প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছিল তখনই আবির্ভূত হয়েছিলেন বাব্যুফ ও তার সমর্থকগোষ্ঠী। বাব্যুফ’কে বলা হয় ইউটোপিয়ান বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।
ফরাসি বিপ্লবে যে শোষণমুক্তির চেতনা মার খেয়েছিল তাকে বিজ্ঞানসম্মত ও ইতিহাসসম্মতভাবে প্রণালীবদ্ধ করে মহান কার্ল মার্কস বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সহযোগিতায় দাঁড় করালেন এ যুগের বিপ্লবী তত্ত্ব, যাকে আমরা বলি মার্কসবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কার্ল মার্কস দেখালেন, যে পর্যন্ত সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ হয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হবে সে পর্যন্ত সামাজিক সাম্য বা ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাঁদের ওই চিন্তা ওই সময়ই ফ্রান্সের বুকে নতুন ঢেউ তুলেছিল। ফরাসি সমাজের ক্রমবর্ধমান শোষণমুক্তির চেতনা সদ্য গড়ে ওঠা মার্কসবাদী চিন্তাকে অবলম্বন করে পরিণতি পেয়েছিল ১৮৭১ সালে প্যারিসের মাটিতে প্যারি কমিউনে, মাত্র ৭২ দিনের সংক্ষিপ্ত অথচ বিশ্বের প্রথম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে মার্কসবাদকে হাতিয়ার করে শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাশিয়ার মাটিতে বিপ্লব করেছেন কমরেড লেনিন এবং রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী। প্যারি কমিউন টেকেনি, মাত্র ৭২ দিন ছিল তার আয়ু। রাশিয়ার মাটিতেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বহু সফলতা সত্ত্বেও, এক পর্যায়ে এসে শোধনবাদের খপ্পরে পড়ে ব্যর্থ হয়েছে। বলে রাখা দরকার যে ফরাসি বিপ্লবও আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল নেপোলিয়ানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যমে। তারপরও এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায় যে ফরাসি বিপ্লব, প্যারি কমিউন এবং রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলন যে অনির্বাণ শিখা জ্বেলে রেখে গেছে -- তা বিশ্বের শোষিত মেহনতি মানুষকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে পথ দেখাবে, শক্তি ও সাহস যোগাবে।
তথ্যসূত্র
১. দেশ (ফরাসী বিপ্লব : দ্বিশতবার্ষিকী সংখ্যা), ১৫ জুলাই ১৯৮৯; কলকাতা।
২. ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি -- আবুল কালাম; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ডিসেম্বর ১৯৮২
৩. ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব -- হায়দার আকবর খান রনো; তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা; একুশে বইমেলা ’০৭।
৪. পথিকৃৎ, অক্টোবর ১৯৮৯; কলকাতা।
৫. ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস -- মোরশেদ সফিউল হাসান; ঈক্ষণ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:২৩