বাংলাভাষাভাষী নিম্নকোটির মুসলিম নারীপুরুষ, বিশেষত নারীদের মধ্যে মকছুদোল মো'মেনীন গ্রন্থটির প্রভাব অপরিসীম। আলহাজ্জ্ব কাজী মাওলানা মোঃ গোলাম রহমান প্রণীত এই গ্রন্থটির ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক সংস্করণ প্রকাশিত ও নিঃশেষিত হয়েছে। উপহার হিসেবে বিয়েতে পাওয়ায় কিংবা পরে ক্রয়সুবাদে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ অল্পশিক্ষিত মুসলিম দম্পতির ভাণ্ডারেই এই গ্রন্থটি সংরক্ষিত আছে। যারা নিয়মিত কোরানশরিফ অধ্যয়ন করে না, তারাও এটির অধ্যয়ন ও চর্চা করে থাকে। ব্যবহারিক ইসলামের অন্যতম প্রামাণিক সংকলন হিসেবে এটি তাদের কাছে গৃহীত।
বঙ্গদেশের মুসলমান নরনারীগণ আরবি-ফার্সি-উর্দুভাষায় অনভিজ্ঞ হওয়ায় ইসলাম ধর্মের মর্ম উপলব্ধিতে ব্যর্থ, তাই ধর্মকর্মে তারা চিরমূর্খই থেকে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে বঙ্গীয় মুসলিম স্ত্রীলোকেরা আংশিকভাবে বাংলাভাষা পাঠ করতে আরম্ভ করায় তাদের মনে ধর্মভাবের কিঞ্চিৎ বিদ্যুৎস্ফূরণ ঘটাবার জন্যই বহু মোতাবর কিতাবাদি থেকে বেছে বেছে আবশ্যক জ্ঞাতব্য ও অজানা বিষয়সমূহ সংগ্রহ করে এই স্ত্রীশিক্ষা গ্রন্থটি লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছে বলে গ্রন্থকার তাঁর নিবেদনে জানিয়েছেন। গ্রন্থটিতে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ-- কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত এবং এগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ ও দূরান্বয়ী সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্কহীন অসংখ্য বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রধানত মুসলিম নারী পাঠকদের লক্ষ্য রেখে রচিত ও প্রকাশিত হওয়ায় নারীঘনিষ্ঠ বিষয়াদি নিয়ে এতে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে হায়েজ-নেফাছ, পর্দা, কীরূপ স্ত্রীলোক বিবাহ করা হারাম, স্বামীর হক্ব বা স্ত্রীর কর্তব্য, গর্ভিনীর কর্তব্য এবং খাছ স্ত্রীলোকদের জন্য ৩৫টি নছিহত প্রভৃতি।
অস্পষ্ট অথবা স্বল্পস্পষ্ট সূত্র থেকে আহরিত তথ্যের ভিত্তিতে এ গ্রন্থে নারী ও নারী-পুরুষ সম্পর্ককেন্দ্রিক যেসব হাদিস ও মন্তব্য যুক্ত হয়েছে, তাতে নারীকে মর্যাদাশীল মানুষ নয়, মনে হয় জড় ও ভোগ্যবস্তু (সমস্ত পৃথিবীটাই সুখভোগের বস্তু এবং যাবতীয় সুখভোগের বস্তুসমূহের মধ্যে সতী-সাধ্বী নারীই সর্বোৎকৃষ্ট ইত্যাদি), লুকিয়ে রাখবার জিনিস (শুন হে মোমিনগণ, খাট প্রাণপণে/পর্দা জারী রাখ, নারী রাখ সঙ্গোপণে ইত্যাদি), স্বামীপ্রভুর দাসানুদাস (যে স্ত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের স্বামীর কাপড় ধৌত করিয়া দিবে, আল্লাহতাআলা তাহার আমলনামা হইতে দুইহাজার গুনাহ কাটিয়া দিবেন এবং স্ত্রীলোকের গমচূর্ণ বা ধান ভানাই ধর্মযুদ্ধস্বরূপ ইত্যাদি), ব্যক্তিস্বাধীনতাহীন (আপনাদের স্বামী যদি আপনাদিগকে কখনও কোন কাজে ডাকেন, তৎক্ষণাৎ চক্ষের ইশারায় আসিয়া হাজির হউন এবং যে মকছুদে ডাকিয়াছেন তাহা বিনা আপত্তিতে পুরা করিতে চেষ্টা করুন, যদি শরীয়তের কোন ওজর না থাকে। যথা : হায়েজ, নেফাছ বা বিমারী ইত্যাদি), ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা বোধহীন (আপনাদের স্বামীগণ আপনাদের যেইরূপ চালাইতে চাহেন, সেইরূপ চলিতে থাকুন এবং তাহারা যেইভাবে চলিতে থাকে আপনারা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুন। কোন কাজে ও কোন কথায়ই তাহাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করিবেন না) ও বেআক্বল (স্ত্রীলোকের ঈমান ও আক্বল পুরুষের ঈমান ও আক্বলের অর্ধেক মাত্র)।
গ্রন্থটি স্ত্রী নির্যাতন (স্বামী নিম্নলিখিত চারি কারণে স্ত্রীকে প্রহার করিতে পারে-- ১. স্বামী যদি স্ত্রীকে সাজ-সজ্জা করিয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইতে বলে, আর যদি সে তাহা অমান্য করে। ২. স্বামী ছোহবতের উদ্দেশ্যে তাহাকে ডাকিলে যদি সে উপস্থিত না হয়। ৩. যদি স্ত্রী নামায ও নাপাকীর গোসল ত্যাগ করে। ৪. যদি সে স্বামীর বিনা হুকুমে অন্য লোকের বাড়ী যায়।) ও স্বামীর একাধিক বিয়ে করাকে (যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহতাআলা শহীদের তুল্য ছওয়াব দান করিবেন।) বৈধতা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হলেও তার রাগান্বিত বা বিচারপ্রার্থী হবার কোনো নিয়ম নেই। এ গ্রন্থ নছিহত করছে স্বামী যদি কোন সময় কোনও ক্রুটি পাইয়া আপনাদিগকে মারেন বা গালাগালি করেন তজ্জন্য চুপচাপ গাল ফুলাইয়া মনের রাগে দূরে সরিয়া থাকিবেন না ; বরং হাতে পায়ে ধরিয়া অনুনয়-বিনয় করিয়া ও নিজের দোষ স্বীকার করিয়া যাহাতে তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারেন তাহার ব্যবস্থা করুন।
সূত্রোল্লেখ ব্যতীত মনগড়া বাক্যবিন্যাসে এখানে যেসব নছিহত দেয়া হয়েছে, তা কিছুতেই নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয় না। মানুষ হলে তার ভালোমন্দ বোধ থাকবে, পছন্দাপছন্দ থাকবে। কিন্তু এ গ্রন্থ বলে, স্বামী বড় লোক হউক আর ছোট লোক হউক, ধনী হউক আর গরীব হউক, বিদ্বান হউক কি মূর্খ হউক, অন্ধ হউক কি কানা হউক, খঞ্জ হউক কি আতুর হউক, সুশ্রী হউক কি কুশ্রী হউক, সর্বদাই সন্তুষ্টচিত্তে তাঁহার পদতলে জীবনখানিকে লুটাইয়া দিতে থাকুন এবং সর্বদাই উভয়ে মিলে-মিশে মহব্বতের সহিত জেন্দেগী কাটাইতে চেষ্টা করুন।
ধর্মীয় পুস্তকের বক্তব্য, বক্তব্যের অতিরঞ্জন এবং মনগড়া কথার মাধ্যমে এ গ্রন্থ যেসব মতকে সামাজিকীকরণ করেছে ও করে চলেছে তা ভয়ানকভাবে নারীস্বার্থবিরোধী। এতদিনে আমাদের সমাজের এটুকু পরিবর্তন অন্তত সাধিত হয়েছে যে, নারী ও নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ক এসব মতকে আর অবশ্যপালনীয় বলে মনে করা চলে না। বাংলাদেশের সংবিধানও এসব মত সমর্থন করে না। এটি ও এ জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ দ্বারা মুসলিম সমাজের মধ্যে যে পশ্চাৎপদতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে, তা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করছে।
এগুলোসহ গ্রন্থভুক্ত তাবীজাত ও দ্রব্যজাত অধ্যায়ে বর্ণিত ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবজের চিকিৎসা সংক্রান্ত কুসংস্কার আচ্ছন্নতার কারণে অনেক আগেই নারীস্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁর একটি কলামে এ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করবার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
বিজ্ঞ ও সম্মানিত পাঠক, আপনারাও কি মনে করেন না যে এ গ্রন্থটি অচিরেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:৩৭