শিক্ষার মতোই আমাদের পাঠ্যবইগুলো শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয় তা বিজ্ঞানবিমুখও। এটা অনেকসময় পরিকল্পিতভাবেই করা হয়ে থাকে। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ানো হয় বিবর্তনবাদ। এগুলো যারা লিখেছেন তারা কেউই যে বিবর্তনবাদ বুঝেন না তা বই পড়লেই স্পষ্ট হয়। গাজী আজমল ও গাজী আসমতের জীববিজ্ঞান বইটি খুবই জনপ্রিয়। গাজী আজমল স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন। আমাদের প্রাণিবিজ্ঞান তিনিই পড়াতেন। তবে বিবর্তনবাদ পড়ানোর দুইদিন আসলেন মিজান স্যার। তিনি আবার হুজুর মানুষ। এসেই বললেন, বিবর্তনবাদ একটি ভুয়া মতবাদ। যদি বানর থেকে মানুষ হতো তবে পৃথিবীতে কোন বানর থাকতো না। তোমাদেরও বিশ্বাস করার কিছু নেই। পড়াতে হয় তাই পড়াচ্ছি। নটরডেমের মতো কলেজে এমন মতাদর্শ অভাবনীয়। সাম্প্রতিক অনেকের কাছে শুনলাম গাজী আজমল স্যারও নাকি হুজুর হয়েছেন। মানে হল তিনিও বিবর্তনবাদ বিশ্বাস করেন না। তাহলে তিনি কেন লিখবেন বিবর্তনবাদের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়? আমার একটা কষ্ট ছিল একজন ভুল স্যার আমাদের বিবর্তনবাদ পড়িয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে তাতে ভিন্নতা হতো না।
তাঁর বইটিতে তিনি বিবর্তনের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- ‘মন্থর গতিসম্পন্ন ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে সরলদেহী জীব থেকে জটিল জীবের আবির্ভাবকে বিবর্তন বলে।’ এই সংজ্ঞা দিয়ে তিনি কি বুঝালেন? শিক্ষার্থীরা শুরুতেই বিভ্রান্তিতে পড়বে এবং এ সংজ্ঞা থেকে তারা সহজে কিছু বুঝতে সক্ষম হবে না। প্রকৃতপক্ষে বিবর্তনের সংজ্ঞা থেকে শিক্ষার্থীরা শিখবে- জীব স্থির নয়, তাদের পরিবর্তন ঘটে আসছে, তাদের কাউকেই পৃথকভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। তারা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। প্রকৃতিতে পুরাতন প্রজাতি থেকে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্বব ঘটে এবং তা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটে থাকে। কেন তিনি জটিলভাবে সংজ্ঞাটি দিলেন?
এরপরই তিনি বিবর্তনের মতবাদসমূহ নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন কীভাবে বিবর্তন ঘটে তা ব্যাখ্যা করার জন্য একাধিক মতবাদ প্রচলিত হয়েছে। জৈব বিবর্তনের প্রধান দুটি মতবাদ হিসেবে তিনি ল্যামার্কবাদ ও ডারউইনবাদের কথা বলেছেন। এছড়া নব্য ডারউইনবাদের কথা আলোচনা করেছেন। এটুকু পড়লেই শিক্ষার্থীরা বুঝে যাবে ল্যামার্কবাদও বিবর্তনবাদ এবং এ মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম তারা যথারীতি ভুল বুঝেছে তা লেখকদ্বয়ের হয়তো লক্ষ্য এটাই ছিল। তিনি বইতে যা লিখেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য নয়। যেমন- ১) বিবর্তন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ২) কিন্তু ঠিক কীভাবে বিবর্তন হচ্ছে, এ ব্যাপারে কেউ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। ৩) বিবর্তন সহজে অনুধাবন ও অবলোকন করা যায় না। ৪) কয়েকজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক তাঁদের লেখায় বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু কাল্পনিক ধারণা রেখে গেছেন। ৫) আধুনিক বিজ্ঞানীরা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে …। এমন অনেক আপত্তিকর ও ভিত্তিহীন বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন তা পড়লেই শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে বাধ্য হবেন যে, বিবর্তন ভুয়া মতবাদ। মনে হবে বিবর্তন নিয়ে বহুজন যে যার মতো করে বলেছেন। ল্যামার্ক এক রকম বলেছেন, ডারউইন আরেক রকম, ডে ভ্রিস ভিন্ন রকম এবং ভাইজম্যান উল্টো বলেছেন!
আমাদের এতো মতবাদতো শেখার দরকার ছিল না। বিবর্তনের ইতিহাস শেখার চেয়ে দরকার প্রকৃত বিবর্তন কি, কিভাবে ঘটে ও তার প্রমাণ কি কি সেটা পড়ানো। ল্যামার্কের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরে তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এখন কেন ল্যামার্কের সূত্রসমূহ পড়তে হবে? যদি কারো অধিক জানার আগ্রহ থাকে তবে তারা বিবর্তন নিয়ে বিস্তর পড়ে নিবে। সেই আগ্রহটা তৈরি করাই হতে পারতো- এই বইয়ের মূল লক্ষ্য। এজন্য বিবর্তন কি ও কিভাবে ঘটে তার সাথে বিশদভাবে পড়াতে হবে বিবর্তনের ৯ ধরনের প্রমাণ। এক ধরনের প্রমাণের ভিতরে থাকা আরো বিভিন্ন ধরন। প্রতিটির জন্যই অনেকগুলো উদাহরণ ও ছবি থাকবে। এক ধরনের প্রমাণের সাথে আরেক ধরনের প্রমাণের সম্পর্ক রয়েছে তারও বর্ণনা থাকবে যেমন- জীবাশ্মগত প্রমাণের সাথে জিনতত্ত্বীয় প্রমাণের সম্পর্ক রয়েছে। বিবর্তনবাদ যে একটি বহুভাবে প্রমাণিত মতবাদ সে কথাটাই বলা প্রয়োজন ছিল। বাস্তবিক অধ্যায়টি তিনি নির্মোহ থেকে লিখতে পারেন নি। শিঘ্রই আশা করবো এমন বিভ্রান্তিমূলক অধ্যায় পরিবর্তন করিয়ে প্রকৃত ও সহজবোধ্যভাবে অধ্যায়টি পরিমার্জন করবেন। অন্যথায় স্যারের উচিৎ বিজ্ঞানের বই না লেখা।