হুমায়ুন আজাদ মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামে নানা বাড়িতে ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি পাশ্ববর্তী রাড়িখাল গ্রামে। রাড়িখাল পূর্ব ও পশ্চিম দিকে লম্বা একটি সূর্যদীঘল গ্রাম। তাঁর পিতার নাম আব্দুর রাশেদ, মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। হুমায়ুন আজাদ পিতা-মাতার দ্বিতীয় পুত্র ও তৃতীয় সন্তান। প্রথম পুত্র আজাদ কবীর জন্মের পরে মারা গিয়েছিল। ফলে প্রথম পুত্রের আদরেই বড় হতে থাকেন। তাঁর বড় ভাই‘র আজাদ নামটি ধারণ করেই হুমায়ুন কবীর থেকে হুমায়ুন আজাদ হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং স্থানীয় পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার।
তিনি লেখাপড়া শুরু করেন বাড়িতেই। তাঁর বাবাই তাকে বাড়িতে প্রথম লিখতে পড়তে শেখান। প্রাথমিক জ্ঞান তিনি অর্জন করেন ১৯৫১ বা ১৯৫২ সালে। হুমায়ুন আজাদ পিতার স্কুলেই সবচেয়ে নিচের ক্লাস ইনফ্যান্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়টির নাম ছিল, ‘দক্ষিণ রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এখানেই ঘটে তার মৌলিক জ্ঞান অর্জন। তৃতীয় শ্রেণীতে না পড়ে তিনি রাড়িখাল স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশনে (তখন শুধু হাই স্কুল ছিল, বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন- পড়ানো হয়) চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়িও রাড়িখালে। তাঁর নামেই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্থ শ্রেণী থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর পরীক্ষা ভালো হতে থাকে। সেভেন পর্যন- তিনি হতেন থার্ড, অস্টম ও নবম শ্রেণীতে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। টেস্ট পরীক্ষার সময় তিনি সমস- হিসাব বদলে দিয়ে প্রথম হন। অধিকাংশ দিন তিনিই প্রথম হাজির হতেন স্কুলে। ঝড়েবৃষ্টিতেও তিনি স্কুলে যেতেন। তিনি বলেছেন, রাড়িখাল প্রাইমারী স্কুল আমাকে মৌলিক জ্ঞান দিয়েছিল এবং রাড়িখাল হাইস্কুল আমার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই হাইস্কুল সে সময়েও অসাধারণ কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। এই বিদ্যালয় থেকেই অনেক বছরই কেউ পাশ করতো না। অনেক ফাস্ট বয় তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছে। হুমায়ুন আজাদ যে বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন তার আগের বছরও ফাস্ট বয় তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিল।
হুমায়ুন আজাদ ১৯৬২ সালে তিনি ম্যাট্রিকিউলেশন বা প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। ঐ বছরই ছিল এক বোর্ডের অধীনে শেষ পরীক্ষা; পরের বছর এক বোর্ড ভেঙ্গে একাধিক বোর্ড হয়। এই পরীক্ষায় এডিশনাল নম্বর ছাড়া তাঁর স্থান ছিল ১৮ তম; এডিশনালসহ ২১তম। মুন্সীগঞ্জের মধ্যে প্রথম।
ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ভর্তি হন। হুমায়ুন আজাদ বি.এ (অনার্স) পরীক্ষা দেন ১৯৬৭ সালে। তিনি একাই প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। বাংলায় সাধারণত কেউ প্রথম শ্রেণী পায় না; ১৯৫৯ সালের পরে আর কেউ পায় নি। এমএ‘র জন্য আর তাকে বিশেষ ভাবতে হয় নি; ভালো করে পড়েছেন। এখানে তাকে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা নামে একটি সন্দর্ভ লিখতে হয়েছিল। যা পরবর্তীতে বই আকারে বের হয়। তাঁর এমএ পরীক্ষা হয় পরের বছর ১৯৬৮ সালে। তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৩ সালে তিনি কমনওয়েলত বৃত্তির জন্য ইন্টারভিউ দেন, বৃত্তিও পেয়ে যান। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এডিনবরা চলে যান ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য। তিন বছর পর ১৯৭৬-এ পিএইচডি করে ফিরে আসেন।
ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসর’ আর আজাদের ‘মুকুলের মাহফিল’ লেখা শুরু করেন নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়। এমএ পড়ার সময় অনেক কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। এমএ পরীক্ষা দেয়ার পর তিনি ইত্তেফাকে ‘জর্নাল’ নামে একটি কলাম লেখা শুরু করলেন। ওটি ছিল পুরোপুরি সাহিত্য নিয়ে লেখা কলাম, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, শত্রুও সৃষ্টি হয়েছিল অনেক। এখানেই প্রথম ষাটের কবিদের কবিতা সমঙর্কে আলোচনা করা হয়েছিলো, ওই প্রথম তাদের নাম কোনো গদ্য রচনায় ছাপা হয়; শুধু তাঁর নিজের নাম ছাড়া। এতে তাঁর ক্ষতি হয়েছে। এখানে যাদের তিনি কবি বলেছেন, তারাই কবি; নিজের নাম যেহেতু লিখেননি তাই তিনি কবি নন, এমন অনেকে মনে করেন। জর্নাল এ তাঁর তীব্র সাহিত্যিক মতামত থাকতো। দু-বছরের মতো লিখেছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে থাকার সময় ‘ব্লাড ব্যাংক’ নামের কবিতাটি লিখেছিলেন ছাত্রদের একটি সাময়িকীর জন্যে। এখানে পড়াতে গিয়েই তাঁর মনে ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ বইটি লেখার কথা মনে আসে; তবে লিখেন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পরে। স্বাধীনতার পরে তিনি দৈনিক বাংলার সাহিত্যের পাতায় ‘এক একর সবুজ জমি’ নামে একটি কলাম লিখেছিলেন কিছুদিন।
হুমায়ুন আজাদ ভেবেছিলেন অনার্স ও মাস্টার্সে যেহেতু প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন, সেহেতু সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারবেন। কিন' এখানে ঢুকার জন্য যে রাজনীতি লাগে তা তিনি প্রথমে বুঝতে পারেন নি। ১৯৬৯ এর সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে যোগ দেন। সেখানে চার/পাঁচ মাসের মতো ছিলেন। ১৯৭০ এর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পদত্যাগ করে ১২ ফেব্রুয়ারি যোগদান করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭০ জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান রূপে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে বহু আরাধ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি অধ্যাপক হন। বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আমৃত্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি আবারো নিয়মিতভাবে গ্রামে আসতে থাকেন ১৯৯৪ সাল থেকে। রাড়িখাল, পাশ্ববর্তী ভাগ্যকুল গ্রামসহ শ্রীনগরে একঝাক তরুণ অনুরাগী সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম, মুজিব রহমান, সুমন- রায়, ফেরদাউসী কুইন, মুনমুন মোনায়েম, উজ্জল দত্ত, সেলিম, শ্যামল, রিপন, তাপস, শুভ্র উল্লেখ যোগ্য। তিনি আক্রান- হলে শ্রীনগরের তরুণরা গঠন করে বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ। অনুরাগীদের নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন পদ্মা নদীতে বা পদ্মার চরে। ওয়াপদা রেস্ট হাউজেও অনুরাগীদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন। ভাগ্যকুলের আকাশলীন এডুকেশন আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানেও তিনি ছিলেন। এই অনুরাগীদের টানেই তিনি বারবার গ্রামে ছুটে আসতেন। ‘চৈত্রের তীব্র দাবদাহ দেখতে আসবো।’ ভাগ্যকুলের তরুণ অনরাগী যারা তাঁর বই পড়ে তাঁর চিন্তা দ্বারা আলোড়িত হয় তাদেরকে ৬ ফেব্রুয়ারি ০৪ তারিখে বলে গিয়েছিলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি সারাদিন ও সারা রাত ভাগ্যকুলে ছিলেন। তাঁর অনুরাগীরা ছায়ার মতো তাঁর সাথে ছিলেন। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসটি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। তিনি জানান ইত্তেফাকে প্রকাশিত উপন্যাসকে পরিবর্ধিত করা হয়েছে। উপন্যাসটিকে সম্ভবত নিষিদ্ধ করা হবে, যারা পড়তে পার নি পড়ে নিও। এর আগে অসংখ্যবার তিনি ভাগ্যকুলে এসেছেন। তার হাই স্কুল জীবনের শিক্ষক ন-র উল হোসেন সাহেবের সংবর্ধনায় তিনি কাব্যময় ঢঙ্গে এক অসাধারণ সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। তিনি নৌকায় চড়ে পদ্ম দেখতেন, পদ্মার চরের বালুতে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতেন।
হুমায়ুন আজাদ সবচেয়ে নিজেকেই বেশি ভালবাসতেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এ মুহুর্তে মনে হচ্ছে জীবন আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। জীবনের যা কিছু রয়েছে জীবন যা কিছুতে গড়ে উঠেছে, তার সবকিছুই আমার জন্যে প্রিয় এবং এখন মানুষের মুখ, গাছপালা, লতা যা কিছু সুন্দর, যা কিছু অসুন্দর এবং বই এবং বইয়ের ভেতরের লেখা অবশ্য যেগুলি ভাল বই, সব কিছুই আমার প্রিয়, এখন মনে হচ্ছে যেনো কিছুই আমার কাছে অপ্রিয় নয়। তবে যদি আমি একটির পর একটি সাজাই তাহলে হয়তো প্রথম দেখা দেবে যা নিয়ম এবং বাল্যকালে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল প্রকৃতি, মানুষ প্রিয়। কিন্তু নির্বিচারে নয়, বই পড়তে পছন্দ করি। ভালো বই সেটি যেকোন ধরনের। প্রিয় চিত্রকর সালভাদর দালি বা মাগিরিদ। আধুনিক পর্বের যারা প্রধান তাদের সবার ছবি কমপক্ষে ভালোলাগে, তাঁর ভালোলাগে পুরনো যে ধ্রুপদি চিত্রকর রাফায়েল বা লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি। চলচ্চিত্রে তাঁর প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন। তিনি বলেছিলেন, ওর যে কোনো ছবিরই তুলনা হয় না, বেশ মজার কারণ ওর প্রতিটি চলচিত্র ওর নিজের কল্পনা থেকে এসেছে, এটি অন্যের ধারণা ভাবনা কাহিনী গ্রহণ করে নয়।
বড়ূ চন্ডিদাস তাঁর খুবই প্রিয় কবি। তিনি মনে করতেন, বড়ূ চন্ডিদাসবাঙলা ভাষার প্রধান মহাকবি এবং রবি ঠাকুরের প্রথম পূর্বসরী। উনিশ শতকে তাঁর প্রিয় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, প্রথম রোম্যানটিক এবং একই অর্থে প্রথম আধুনিকও বটে। মধুসূদন বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে এসেছেন কিন্তু তিনি আধুনিক নন। বিহারীলাল চক্রবর্তীর গীতিকবিতা- মধুসূদন থেকে অগ্রসর। উনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক কবিদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী। পশ্চিমে কাতুলুজ বা শ্যাফোর কিছু কবিতা আমার খুবই প্রিয়, কীটস প্রিয় তাঁর সেনসুয়ালিটির জন্য, শেলীকে পছন্দ তীব্র বিদ্রোহের জন্য, ওয়ার্ডসওয়র্থের কিছু কবিতা প্রিয়। ফরাসীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বোদলেয়র। জার্মানদের মধ্যে হাইন। আধুনিকদের মধ্যে এজরা পাউন্ড, টিএস এলিয়টের কিছু কবিতা ভালো লাগে। আমেরিকার হুইটম্যান খুব প্রিয় গোপনে গোপনে। রাবার্ট ফ্রস্টও খুব প্রিয়। ট্যালেন্ট টমাস বেশ প্রিয়। ডবিণ্ডউ বি এস খুবই প্রিয়। প্রিয় ব্যক্তিত্ব বিষয়ে বলেছেন, আছে কিনা সন্দেহ। বাল্যকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ভালবাসি: রবীন্দ্রনাথ।
২০০৪ সালের বই মেলার একটি বিষয় হুমায়ুন আজাদ লক্ষ্য করেন এবং আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণিকে জিজ্ঞাসা করেন, মৌলবীরা এবারের মেলায় আমাদের স্টলে এতো ভিড় করছে কেনো? বিষয়টি তাঁর চোখে পড়েছিল মেলার শুরু থেকেই। ইউনিভার্সিটিতে তার রুমে শুকনো হাড় পেয়েছিলেন বইমেলা চলাকালেই। তখন ওটাকে খুব গুরুত্ব দেন নি। আসলে এটা ছিল সিম্বলিক। কিন' তাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে এটা কখনো ভাবেন নি। ২৭ ফেব্রুয়ারী ০৪ হুমায়ুন আজাদ অন্য দিনের মতো বইমেলার আগামীর স্টলে বসেছিলেন। স্টল থেকে তিনি বের হন সম্ভবত রাত ৯টার দিকে। তারপর হাঁটেন, কয়েকজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। লেখক চত্বরে রফিক আজাদ ও মোহন রায়হানসহ কয়েকজন লেখক ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বসতে বলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে বসেন, একটু সিগারেট খান। সেখানে ছবি তোলা হয়। তারপর আমি যাব বলে বের হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটি পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর তাঁর কিছু মনে নেই।
আক্রমন করেই ঘাতকরা বোমা ফাটিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রথমে তাঁক নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে নেয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সিএমএইচে ডাক্তাররা রক্ত চান রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ। রক্ত দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ সম্মতি জানায়। এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিক ও রিক্সা চালকরাও রক্ত দিতে চান। তাঁর আক্রান- হওয়ার খবর প্রচারের সাথে সাথেই তাঁর অনুরাগী ও মুক্তচিন্তার মানুষেরা উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের উপর ব্যাপক চাপ প্রদান করেন। সরকার বাধ্য হয় তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। হুমায়ুন আজাদকে ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২২ মার্চ ০৪ তারিখে। সাথে যান আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গণি এবং হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুরুল কবীর মাতিন। সিএমএইচ তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেও তিনি অধিকতর সুস্থ হয়ে উঠেন বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে।
ব্যাংকক থেকে ২০ এপ্রিল ০৪ দেশে ফেরার পরে মানবাধিকার ও লেখকের স্বাধীনতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, আমি ছেলে বেলায় একটি বাংলা ব্যাকরণ পড়েছি। সেখানে গোপাল নামে একটি অসাধারণ চরিত্র ছিল। সেই ব্যাকরণটি জানিয়েছে, গোপাল কলা খায়। গোপাল অন্য কিছু খায় না, শুধু কলা খায়। সুশীল বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝি একটি দুর্বল মানুষ। ভয়ে ভীত-সন্ত্রস-। সুন্দর ইস্ত্রি করা পোষক পরে, মাথায় প্রচুর পরিমাণে তেল দেয় এবং মাঝখানে সিঁথি কাটে- এই ধরনের একটি মানুষ। এই সুশীল সমাজকে দিয়ে আসলে কোন কাজ হবে না। আমাদের জন্য আসলে অশীল সমাজ প্রয়োজন। যে অশীল সমাজ চিরকাল সমাজকে রূপান-রিত করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার আছে কি না সেটা বোধ হয় খুব বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। একটি বাক্য যথেষ্ট যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। দেশে ফিরে পূর্বের মতোই সাহসী ছিলেন।
মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেণ্ড দূরে নামে বই লেখা বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ বের হলে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, বইটির নাম হবে মৃত্যু থেকে এক সেকেণ্ড দূরে। তিনি বলেছিলেন, মে মাসের মাঝামাঝি আমি আবার লিখতে শুরু করবো। বিষয়বস' হবে আমার মৃত্যু অভিজ্ঞতা। জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মৃত্যু হচ্ছে অভিজ্ঞতাহীন একটি ব্যাপার। হামলাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন, আমি বিন্দুমাত্র আশাবাদী নই। কারণ বাংলাদেশ অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয় না। সাঈদীকে ধরতে হবে, মৌলবাদীদের ধরতে হবে তারাই আসলে আমার খুনি।
জুলাই মাসের ২ তারিখ; আক্রান- হওয়ার পরে প্রথমবার এবং শেষবার নিজ গ্রামে আসেন। তাঁকে প্রথমে বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের তরুণ অনুরাগীদের পক্ষ থেকে এবং বিকেলে আমরা রাড়িখাল বাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি তাঁর অনুরাগীদের প্রথা ভাঙ্গার আহবান জানান। ২৪ জুলাই তার একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদকে অপহরণের চেষ্টা করে ঘাতকেরা, ২৫ জুলাই বিকালে টেলিফোনে বোমার ভয় দেখিয়ে তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। এর প্রেক্ষিতে ২৮ জালাই ০৪ বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে খোলা চিঠি লিখেন। শেষ করেন এভাবে, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসী, এ সঙ্কট মুহ-র্তে, বিপন্নতার সময়ে আমার পরিবারের ও আমার জীবন আমি আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম; আপনারাই সি'র করবেন বাংলাদেশের রক্তের বন্যায় কি বিনিদ্র কাঁপতে থাকবো, এবং বিশ্ব শিউরে উঠবে বাংলাদেশকে দেখে, সময় বেশি নেই, এখনই আপনাদের কর্তব্য সি'র করার জন্য আবেদন জানাই।
তিনি ব্যাংকক থেকে ফিরে বলেছিলেন, আমি লিখবো, লেখাই হচ্ছে আমার জীবন, লেখাই হচ্ছে আমার আনন্দ। আমি যদি আরও ৩০ বছর বেঁচে থাকি, এবং তাহলে হয়তো আরো অন-ত ৬০ টি বই লিখবো, এবং এগুলো বিচিত্র ধরনের হবে; তাতে বক্তব্য বা কাহিনী বা আবেগ বহুরূপে প্রকাশ পাবে এবং সেগুলো বাঙ্গালিকে বিকশিত করবে। আমার কাজ কল্যাণে এসেছে, এবং আরো বহু বছর কল্যাণে আসবে।
হুমায়ুন আজাদ একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তার সুদীপ্ত পদচারণা। এজন্যই তিনি বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম পর্বে কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করেছেন। তখন এবং তারপর বিশ্বের সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়েও লিখেছেন। তিনি জীবনের সম্পূর্ণ রূপ, সৌন্দর্য, কদর্য-অসৌন্দর্যের রূপ চিত্রণ করতে চেয়েছিলেন। সেটা তাঁর কবিতায় রয়েছে, উপন্যাসে রয়েছে, প্রবন্ধে রয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর দেশব্যাপী বোদ্ধামহলে ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ভাষাবিজ্ঞান সমঙর্কে লিখে। তিনি পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানের উপর। গবেষণা করে লিখেছেন- প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি(১৯৮৩)। একই বছর লিখেছেন ‘বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র’। ১৯৮৪ সালে লিখেন ‘বাক্যতত্ব’ এবং ‘বাঙলা ভাষা (প্রথম খন্ড)’ পরের বছর লিখেন দ্বিতীয় খন্ড। ১৯৮৮ সালে লিখেন ‘তুলনাম-লক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ এবং এর পরের বছর ‘অর্থবিজ্ঞান’। কিশোরদের উপযোগী করে তিনি ১৯৭৬ সালে লিখেন- ‘লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ এবং ১৯৮৭ সালে লিখেন- ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’।
প্রথম বই কবিতার হলেও শুরুতে কবিতা কম লিখেছেন। হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৭টি। তিনি বলতেন, কবিতার মতো প্রিয় কিছু নেই আমার বলেই বোধ করি, তবে আমি শুধু কবিতার বাহুপাশেই বাঁধা থাকি নি। খ্যাতি, সমাজ বদল এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখিনি বলেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে উঠে, সে কমঙন ধরে রাখার জন্য।
হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত প্রথম বই কবিতার- ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)। আমাদের পরিচিত বলয় নিয়েই লিখেছেন। শৈশবে শোনা পদ্মা নদীতে চলা স্টীমারের সিটির শব্দ নিয়ে লিখেছেন-
.. .. নীল ইস্টিমার চোখের মতোন সিটি বাজাচ্ছে থেমে থেমে / আমি ঘুমের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠছি / অন্ধহাতে খুঁজে ফিরছি আমার নিবিড় ট্রাউজার .. ..।
১৯৮০ সালে প্রকাশ পায় ‘জ্বলো চিতাবাঘ’। সমাজ ও রাজনীতির উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায় ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫) কাব্যগ্রনে'। কবিতাগুলো শিল্পময়। তিনি লিখেছেন-
.. .. এই সব গ্রন' শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র / শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট / গদ্য পদ্য আমার সমস- ছাত্রী মার্ক্স - লেলিন, / আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা / রাহুগ্রস' সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক / আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন' ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল’। এখানে রয়েছে অনেক সৌন্দর্যতা। লিখেছেন-
সৌন্দর্য যখন সরাসরি তাকায় তখন সুন্ধর / সৌন্দর্য যখন চোখ নত করে থাকে, তখনো সুন্দর।
পরবর্তী কাব্যগ্রন' ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’(১৯৯০)-এর রয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি লিখেছেন-
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙ্গুলের দাগ / আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবানু / আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো / আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো .. ..
তাঁর ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ ((১৯৮০) অনেক কোমল ও গীতিময়, অনেক স্বপ্ন ও দীর্ঘশ্বাসে প-র্ণ। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন' ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪) অনেক বেশি পরিণত। তাঁর অনেকগুলো প্রিয় কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রনে'। কবিতায় অন্তমিল ও ছন্দ ফিরিয়ে আনার ব্যাকুল স্বার্থক প্রচেষ্টা রয়েছে। আজ পেরোনোর কিছু নেই, ব‘সে আছি- স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের / শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে, শস্যে শব্জিতে।
জনপ্রিয় ধারার তথাকথিত উপন্যাসগুলোকে হুমায়ুন আজাদ বলতেন অপন্যাস। তিনি একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছিলেন কিশোরদের জন্য উপন্যাস- ‘আব্বুকে মনে পড়ে’। প্রথম উপন্যাস ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল(১৯৯৪) অসাধারণ সাড়া জাগিয়েছিল, এরপর বাঙলাদেশের অন্য নাম হয়ে উঠেছে ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’। এটি কোনো বিশেষ চরিত্র নিয়ে লেখা গল্প নয়, এটি তৃতীয় বিশ্বের সামরিক অভ্যুত্থানগ্রস' অবস্থ- একটি দেশের শোচনীয় অবস্থার গদ্যশিল্প। এতে কোন সংলাপ নেই। দেখতে প্রবন্ধের মতো। এতে আছে তীব্র প্রেম, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়; এর পরিবার বা বিবাহ প্রথার শোচনীয়তার উপস্থাপন।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’। এর উৎস তাঁর শৈশব। কিভাবে একে একে ভেঙ্গে পড়ে সব। উপন্যাসে এক দার্শিনিক সত্য- ‘সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’ প্রামাণ করেছেন। ‘মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসম-হ’ আবার ভিন্ন কাঠামোর। ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য- অনাকাঙিক্ষত ঘটনা মিলে এক উপন্যাস। এক আমলার কষ্ট, বিয়ে এবং একাকিত্ব নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন। ‘শুভব্রত, তার সমঙর্কিত সুসমাচার’ কী করে একজন ধর্ম প্রবর্তকের আবির্ভাব ঘটে সামাজে এবং কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে এর শিল্পিত উপন্যাস এটি। যিশুখৃষ্টের সুসমাচার প্রতীক নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন। উপন্যাসটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্তির জন্য রচিত একটি বিশাল উপন্যাস। এখানে তিনি একজন ধর্ম প্রবর্তককে নায়ক হিসাবে নিয়েছিলেন যে ক্রমশ তার উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে এক বিধাতার সন্ধান পায় এবং সমস- সমাজ রাষ্ট্রকে তার বিশ্বাসের অনুগত করতে চায় এবং একটি মৌলবাদী সমাজ স্থাপন করতে চায়। কিন' শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে রাষ্ট্রে তারও দম বন্ধ হয়ে আসে এবং সে ঘোষণা করে যে, বিধাতা তার মনেরই সৃষ্টি। তখন ক্ষমতা ও ধনলিপ্সু সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে এবং দেশের পর দেশ জয় করতে বেরিয়ে পড়ে। এটি একটি মহৎ উপন্যাস। ‘রাজনীতিবীদগণ’ জনগণের মুখের ভাষায় লেখা সমঙ-র্ণভাবে এক রাজনৈতিক উপন্যাস। আমাদের রাজনীতিবিদদের হিংস্রতা, প্রতারণা, পাশবিকতা চিত্রিত হয়েছে এটিতে। এর ভাষাটা লেখকের নয়, জনগণের ও রাজীতিবিদদের; এটা একটা নিরীক্ষাও- এর মধ্যে সাধু, চলতি, আঞ্চলিক, ইংরেজি, ভুল বাঙলা বা ভুল ইংরেজির একটি কুৎসিত ভাষারূপ তৈরি করা হয়েছে, যা আমাদের রাজনীতিবিদদের মতোই নোংরা। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কোনো বাস-ব চরিত্রের অবিকল উপস্থাপন নয়, তবে অনেক বাস-ব চরিত্রকে ভেঙ্গেচুরে আরো বেশি বাস-ব করা হয়েছে। তিনি আধুনিক কবিদের নিয়েই লিখেন- ‘কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ’। চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই বাংলাদেশের বাস-ব কবিরা বেরিয়ে আসেন। ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ উপন্যাসে আবারো আমারা রাড়িখালের এক কিশোরকে খুঁজে পাই। তাঁর শৈশব এখানে জীবন- হয়ে ফিরে এসেছে। ‘ফালি ফালি করে কাঁটা চাঁদ’ এক অধ্যাপিকার পাহাড়ী বাংলোয় এক ভদ্রলোকের সাথে দু‘রাত্রী যাপন এবং এতে তার বদলে যাওয়ার কাহিনী। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক লেখকের অসাধারণ উপন্যাস। এরপর তিনি লিখেছেন ‘শ্রাবণের বৃষ্টি রক্তজবা’ ‘১০০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ’ এবং ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ নামে চমৎকার তিনটি উপন্যাস। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ(২০০৪)’ পড়ে মানুষ মৌলবাদীদের ভয়াবহ জীবন বর্ণনা দেখে আঁতকে উঠেছিল। পরবর্তীতে এ উপন্যাসটি তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে মৌলবাদীদের জীবন উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসটির বর্ণনার মধ্যে অনেক রূপক ও প্রতীক রয়েছে। কিন্তু এখানে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা সত্য- শৈল্পিকভাবে সত্য, বাস-বেও সত্য।
নারী গ্রন'টি লিখতে তাঁর সময় লেগেছে এক বছর কয়েক মাস। নারীবাদ ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর প্রিয় বিষয়। তবে ১৯৯০-উৎসাহ বোধ করেন নারী সমঙর্কে বই লেখার। প্রথাগত সমাজকে তিনি আক্রমন করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। তিনি এক সময় বুঝতে পারেন একে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করা সম্ভব শুধু নারীকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি বলেছেন, “বর্তমান সমাজ ও সভ্যতা মানুষের উপযুক্ত নয়, তা অর্ধ মানুষের উপযুক্ত।” এই বইটিতে তিনি কোনো অভিনব তথ্য উদঘাটন করেন নি; প্রচুর তথ্য এ বিষয়ে মেলে, তিনি সেগুলোকে তাঁর মতো করে তাত্ত্বিক কাঠামোতে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর আলোচিত প্রবন্ধের বই ‘নারী’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হলে তিনি মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন। বইটিতে নারীর প্রতি যুগে যুগে নিপিড়নের কথা বলা হয়েছে। মৌলবাদীদের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার ১৯৯৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে। তবে ২০০০ সালে আইনী লড়াইতে বইটি মুক্ত হয়। নারী নিষিদ্ধ হলে তিনি অনুবাদ করেন ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’।
হুমায়ুন আজাদের কিশোর সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে- ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, ‘আমাদের শহরে একদল দেবদ-ত’, ‘বুক পকেটে জোনাকী পোকা’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’। এছাড়া তিনি একটি ইংরেজি বই লিখেছেন কিশোরদের জন্য- ‘আওয়ার বিউটিফুল বাংলাদেশ’। ইংরেজিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা সেরা বই।
হুমায়ুন আজাদ এক পত্রিকার সমঙাদকের অনুরোধে ড. আহমেদ শরীফ, শামসুর রাহমান, আব্দুর রাজ্জাক ও শওকত ওসমান এর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন । এই সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে একটি বহুল পঠিত বইও রয়েছে। কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখেছেন একটি প-র্ণাঙ্গ বই- ‘শামসুর রাহমান: নিঃসঙ্গ শেরপা’। এই প্রথম কোন জীবীত কবিকে নিয়ে আরেক প্রধান কবির বই। এখানে তিনি শামসুর রাহমানকে প্রধান কবি হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের নিজ রচিত সাহিত্যের মতোই তাঁর সাক্ষাৎকার আকর্ষণীয়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- ‘আতায়ীদের সাথে কথোপকথন’ এবং ‘একুশ আমাদের অলিখিত স্বাধিনতা দিবস’। মাসিক বলাকা তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ৯৪ পৃষ্ঠার একটি ম্যাগাজিন বের করে। পরবর্তীতে এই সাক্ষাৎকারটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে- ‘হুমায়ুন আজাদ এই বাংলার সক্রেটিস’ নামে। মহাবিশ্ব নিয়ে বিভ্রানি- ও ভ্রান- ধারণা দূর করতে লিখেছেন- ‘মহাবিশ্ব’। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁর ‘প্রবচনগুচ্ছ’ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এখানেও তিনি তীব্র কটাক্ষ করেছেন প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও প্রথাকে। হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগতভাবে যেমন ছিলেন প্রথাবিরোধী, তাঁর সাহিত্যও অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেটা যেমন মানের দিক থেকেও আবার বিষয়ের দিক থেকেও। পৃথিবীতে সাহিত্যের এতো বিচিত্র বিষয় নিয়ে এতো সাবলিলভাবে লিখেছেন খুব কম লেখকই।
পাক সার জমিন সাদবাদ উপন্যাসটি পত্রিকায় পড়েই অনেকের মনে হয়েছিল এটি অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। বিভিন্নজন আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। বইটি মানুষের চিন-ার রাজ্যে কতোটা প্রভাব রাখবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। যা ঘটেছে তা হল, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি চাপাতির কোপে মারা্তকভাবে আহত হন, চিকিৎসায় কিছুটা সুস'্য হন। আন-র্জাতিক সংগঠন পেন এর আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনের উপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান ৭ আগস্ট। পরিবারের লোকেরা এবং অনুরাগীরা কেউ তাকে একা যেতে দিতে চান নি। কিন' তিনি একাই যান। এর মাত্র ৫ দিন পর ১২ আগস্ট মিউনিখস' নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ২৭ আগস্ট রাড়িখালে তাঁর নিজ বাড়িতে সমাহিত করা হয়। বিকেল ৪টার দিকে রাড়িখালে শোনা যায়, তাঁকে সাড়ে পাঁচটায় জানাজা নামাজ পড়ানো হবে স্থানীয় হাইস্কুল প্রাঙ্গনে। স্থানীয় লোকজন জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখেন তাঁর বাড়ির নিকটবর্তী মসজিদের ইমাম নেই। তিনি চলে গেছেন যাতে জানাজা নামাজ না পড়াতে হয়। স'ানীয় আরেকটি মাদ্রাসার সুপার জানাজা নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। মাদ্রাসা ছুটি ঘোষণা করেছেন। স'ানীয় কবরস্থান কর্তৃপক্ষ তাঁর মায়ের পাশে তার কবর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। জানাজার স্কুল মাঠে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয় কর্তপক্ষ নেই। সকল কক্ষ তালা দেয়া। মাঠের এখানে সেখানে বৃষ্টির পানি ও কাদা। প্রধান শিক্ষকসহ কোন শিক্ষক নেই। ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন না। একজন দপ্তরীকে চাবি দিয়ে সকলেই চলে গেছেন। তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই বিদ্যালয় থেকে তিনি বোর্ড স্ট্যান্ড করে গৌরব বয়ে এনছিলেন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকলেও উপজেলার বা জেলার কোন সরকারী কর্মকর্তাই উপসি'ত থাকেন নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাতো নয়ই।
সোয়া পাঁচটায় যখন লাশ আসে তার সাথে আসে দুটি বাসভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী। তারপরেও প্রগতিশীল মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা নামাজে বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ভরে যায়। ইমামতি করেন তাঁই এক জ্ঞাতি ভাই যিনি কোন মসজিদের ইমাম নন। জানাজা শেষে হুমায়ুন আজাদের পৈত্রিক বাড়িতে বিকেল ৬:৪৪ মিনিটে লাশ দাফন করা হয়। তার অনুসারীরা ফুলে ফুলে তার সমাধী ঢেকে দেয়। তিনি চেয়েছিলেন ৩০ বছরের আরেকটি জীবন, দ্বিতীয় জীবন। তাঁর ইচ্ছাটা শরীর গ্রহণ করতে পারে নি। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ১৬২ দিন। আজও তার অনুরাগীরা তাঁকে সমানভাবে উপলব্ধি করে। তিনি নেই এটা আজ বড় বেশি অনুভব হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:১১