উদ্দেশ্যমূলকভাবে কলম্বাস ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলাকে অনুসরন করতে থাকেন। কলম্বাসের লক্ষ্য ছিল ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগীতা নিয়ে বিশেষ কিছু করা। ১৪৯২ সালে স্পেনের গ্রানাডায় সর্বশেষ মুসলিম খলিফার পতন হয়। খলীফা রানী ইসাবেলার নিকট প্রতীকস্বরুপ গ্রানাডার চাবি হস্তান্তর করেন। রাতারাতি রানী ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ মুসলমানদের অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান। এ সব কিছুরই নীরব সাক্ষী ছিলেন কলম্বাস। ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ বিলাসবহুল বিভিন্ন খাতে মুসলমানদের নিকট থেকে প্রাপ্ত সোনা দানাসহ বিভিন্ন সম্পদ অবলীলায় খরচ করতে থাকেন। ইসাবেল এবং ফার্দিনান্দের মাধ্যমে কলম্বাস কর্তৃক আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার অনেকদিনের সুপ্ত বাসনাও পূর্ণ হয়। গ্রানাডার মুসলমানদের লুটপাটকৃত সম্পদকে থেকে ইসাবেলা কলম্বাসকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগীতা করেন। গ্রানাডা জয় করার দুই তিন মাস পর একই বছর অর্থাৎ ১৪৯২ সালে রানীর অর্থনৈতিকসহ সব ধরনের সহযোগীতায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কলম্বাস জাপান/ভারত গমন করতে তার প্রাথমিক যাত্রা শুরু করেন। তার সঙ্গীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পিজোঁ-ভ্রাতা মার্টিন অ্যালঞ্চো পিজোঁ (Pinjon) এবং সেন্ট ইয়ানেজ পিজোঁ। পিজোঁ ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন মরক্কোর মুসলিম পরিবার 'আবু জাইয়ান' পরিবারের উত্তরসূরী যাদেরকে জোরপূর্বক খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহনে বাধ্য করা হয়েছিল। পিজোঁ শব্দটি এসেছে মূলত আবু জাইয়ান শব্দ থেকে। কারো কারো মতে শুধু পূর্ব পুরুষরাই নয়, পিজোঁ ভ্রাতৃদ্বয়ও মুসলমান ছিলেন যদিও তারা তা গোপন রেখেছিলেন।
তখনকার সময়ে মুসলমানেরা ছিল সর্বক্ষেত্রে অগ্রসর। বিশেষ করে সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনায় তাদের দক্ষতা ছিল অত্যন্ত উচু মানের। একারনেই মূলত কলম্বাস পিজো ভ্রাতৃদ্বয়কে তার অন্যতম সফরসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। যাত্রার কয়েক মাস পূর্বে কলম্বাস স্পেনের পশ্চিম প্রান্তস্থ অ্যারাবিদা (Arrábida) নামক একটি ছোট্ট শহরে বসবাস শুরু করেন এবং সেখান থেকেই সমুদ্র অভিযানের যাবতীয় পরিকল্পনা সম্পন্ন করেন। বস্তুত অ্যারাবিদা নামক শহরটি পূর্বে 'আর রবিতা (Ar Rabita)' নামে পরিচিত ছিল। মুসলমানদের পরাজয়ের ফলে পরবর্তীতে এই শহরের প্রকৃত নাম বিকৃত করে 'অ্যারাবিদা' নামকরন করা হয় যা বর্তমানে পর্তুগালের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি ঐ শহরে কলম্বাস যে চার্চে (Church) বাসবাস শুরু করেন সেটিও ছিল মসজিদ থেকে রুপান্তরিত চার্চ। এখান থেকেই কলম্বাস মুসলমানদের পরোক্ষ সহযোগীতায় আটলান্টিক সমুদ্র পাড়ি দিতে উদ্যত হন। অনেকের মতে কলম্বাসের সঙ্গীদের অনেকেই মুসলমান ছিলেন। তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে উক্ত অভিযানে পিজো ভাইদের মত আরো অনেকেই ছিলেন যাদের পূর্বপুরুষদেরকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্ম গ্রহনে বাধ্য করা হয়েছিল।
সান্তা মারিয়া (Santa Maria), নিনা (Nina) এবং পিন্তা (Pinta) নামক তিনটি জাহাজে করে কলম্বাস তার সফরসঙ্গীসহ ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট শুক্রবার ভারতের উদ্দেশ্যে স্পেন ত্যাগ করেন। ১২ অক্টোবর, শুক্রবার 'জাহাজ পিন্তা' স্থলভাগের সন্ধান লাভ করে। সকালেই কলম্বাসের সঙ্গীরা ভূমিতে পদার্পন করেন এবং কলম্বাস এই ভুখন্ডের নামকরন করেন "সান সানভেদোর (San Salvedor)"। কলম্বাস আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন এবং দৃড়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন তিনি ভারতে এসে পৌছছেন। ভারত আবিষ্কার করার কল্পিত সফলতা নিয়ে তিনি সামনে যাত্রা শুরু করেন। ১৪৯২ সালের ২৮ অক্টোবর, রবিবার তিনি কিউবার (Cuba) ভুখন্ডে নোঙ্গর করেন এবং বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন তিনি জাপানে এসে পৌছছেন। নতুন ভূমি আবিষ্কার করার স্পৃহা নিয়ে কলম্বাস আরও সামনে এগোতে থাকেন এবং হিসপানিওলা আইল্যান্ডে (Hispaniola- বর্তমান হাইতি এন্ড ডমিনক রিপাবলিক) অবতরন করেন। এখানে জাহাজ সান্তা মারিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অতঃপর সমুদ্র অভিযান পরিচালনার জন্য জাহাজটিকে অযোগ্য ঘোষনা করা হয়। দুটি জাহাজে সফরসঙ্গীর সংকুলান না হওয়ায় এখানেই কলম্বাস ছোট্ট উপনিবেশ স্থাপন করেন। ১৪৯৩ সালের জানুয়ারী মাসের মধ্যভাগে কলম্বাস তার প্রথম সমুদ্র অভিযান সমাপ্ত করে আমেরিকা থেকে স্পেনে প্রত্যাগমন করেন। পরবর্তী আট বছরে তিনি আরও তিনবার আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে সমুদ্র অভিযান পরিচালনা করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন তিনি ভারত এবং জাপানে গমন করেছিলেন।
১৪৯৩ থেকে ১৪৯৬ সাল ব্যাপী আমেরিকায় (কলম্বাসের মতে এশিয়া) কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযান ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ এবং অধিকতর তাৎপর্যপূর্ন। এই অভিযানে তিনি বর্তমান জামাইকা (Jamaica), পুয়ের্তো রিকো (Puerto Rico) এবং ভার্জিন আইল্যান্ডসহ (The Virgin Islands) অগনিত স্থান পরিভ্রমন করেন। দ্বিতীয় অভিযানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কলম্বাস কর্তৃক দেড় সহস্রাধিক ইউরোপীয় নাগরিককে আমেরিকা থেকে স্পেনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা। মূলত নতুন ভুখন্ডে নিজের আধপত্য কায়েম করার সুপ্ত বাসনা থেকেই কলম্বাসের এ ধরনের পরিকল্পনার সূত্রপাত। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঁচশয়ের অধিক ইউরোপীয় নাগরিককে চারটি জাহাজ ভর্তি করে স্পেন পাঠানো হয় যাদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক লোকই সমুদ্রে মৃত্যুবরন করেন। জীবিত লোকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয় যাকে ইতিহাসবিদরা কলম্বাসের দাস ব্যবসা (Slave trade) হিসেবে উল্লেখ করেন। তিন বছর আমেরিকায় বিভিন্ন জায়গায় কলম্বাসের অবস্থানের ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের সীমাহীন উৎপীড়নের মধ্যে দিনানীপাত করতে হয়। নিজের পকেট ভারী করার উদ্দেশ্য কয়েকটি অঞ্চলে তিনি নিষ্ঠুর কর ব্যবস্থা চালু করেন। এসব কারনে ইতিহাসবিদরা কলম্বাসকে একজন উৎপীড়ক (Despot) হিসেবে আক্ষায়িত করেন। ১৪৯৬ সালে স্পেনের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ত্যাগ করার পূর্বে কলম্বাস সেখানে বর্ণবাদ (Rasism) এবং সাম্রাজ্যবাদের (Imperialism) কালিমা লেপন করতে সমর্থ হন।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের ইতিহাসে কলম্বাসের নাম সুপ্রতিষ্ঠিত। আমেরিকায় কিছু নাগরিক আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে নিয়ে পূজা-অর্চনা করলেও আমেরিকার ইতিহাসে কলম্বাসের তেমন কোন স্বকীয়তা নেই। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এবং পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ আমেরিকার ব্যাপারে কলম্বাসের কোনরূপ ভুমিকা স্বীকার করতে নারাজ। তার উপর সমসাময়িক সময়ে উচ্চারিত হয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্ন, কিভাবে এমন একটা ভুখন্ড আবিষ্কার করা সম্ভব যেখানে পূর্ব থেকেই জনপদ প্রতিষ্ঠিত? ইতিহাসবিদরা আরও প্রশ্ন রেখেছেন, কোন যুক্তিতে কলম্বাসকে আমেরিকা আবিষ্কারের বিশেষায়িত ভুমিকায় অধিষ্ঠিত করা সম্ভব যেখানে আমেরিকার এক ফুট ভূমি গঠনেও তার কোন অবদান নেই? কলম্বাস নিজেও কখনও বিশ্বাস করতেন না, তিনি আমেরিকায় গমন করেছিলেন। অনেক আধুনিক ইতিহাসবিদ এবং ধারাভাষ্যকার মনে করেন, কলম্বাসের হাত ধরেই আমেরিকার ভূ-খন্ডে নৈরাজ্য এবং নিপীড়নের সূচনা হয়েছিল। উপকন্তু সম্প্রতি সুং দলিল (Sung Document) এবং গ্যাভিন মানজেস (Gavin Manzies) লিখিত "১৪২১' ইতিহাসগ্রন্থসহ অনেক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে কলম্বাসের আগেও চীন থেকে পরিচালিত সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে আমেরিকায় গমনের ইতিহাস জানা যায়। সে হিসেবে কারো কারো মতে কলম্বাসকে কখনই "আমেরিকার আবিষ্কারক"বলা যায় না, বড় জোর আমেরিকার সাথে বহির্বশ্বের যোগসূত্র স্থাপনকারী বলা যেতে পারে।
সূত্র:
Axtell, James. 1992. Beyond 1492: Encounters in Colonial North America. New York, NY: Oxford University Press.
Bushman, Claudia L. 1992. America Discovers Columbus: How an Italian Explorer Became an American Hero. Hanover, NH: University Press of New England.
Dr. Abu Ammar Yasir Qadhi. 2008. History of Islam in America: Whither and Where. Lecture.
Henige, David. 1991. In Search of Columbus: The Sources for the First Voyage.Tucson, AZ: The University of Arizona Press.
Thomas, David A. 1991. Christopher Columbus: Master of the Atlantic.London, UK: Andre Deutsch.