আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো সময়। কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে এই নেয়ামতটির যথার্থ মূল্যায়নের প্রতি বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনে একটি সুরা-ই নাজিল করা হয়েছে ‘আসর’ বা সময় নামে এবং এই সুরায় আল্লাহ সময়ের কসম বা শপথ করেছেন। এ থেকে সময়ের মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করা যায়। মানুষের পার্থিব জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। এই স্বল্পকালীন জীবনে পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে হয় অনন্ত অসীম পরকালের জীবনের জন্য। এতে তার সবচেয়ে বড় মূলধন সময় ও স্বাস্থ্য। প্রত্যেক মানুষকেই আল্লাহ তায়ালা এই দুটি পুঁজি দান করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, এমন দুটি নেয়ামত রয়েছে, যার সুফল লাভে অধিকাংশ মানুষই ব্যর্থ হয়- সুস্থতা ও অবসরতা। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব জাতি সময়ানুবর্তী, যারা অহেতুক সময় নষ্ট করে না, জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগায়, সমৃদ্ধি ও উন্নতি লাভ তারা করবেই। তাতে কোন সন্দেহ নেই ৷
পক্ষান্তরে যে জাতি অলস, অচল, স্থবির এবং গতিহীন; সে জাতির মোটেই কল্যাণ সাধিত হয় না। অধঃপতন ও নিম্নগামিতা সে জাতিকে পেয়ে বসে। এ সত্য যেমন জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অলসতা ও অকর্মণ্যতায় আক্রান্ত হয়ে কেউ কখনো উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয় না। আমরা পেছনে যে সময়টি রেখে আসি, তা কতটুকু অর্থবহ হয়েছে, তা নির্ণয় করতে হলে হিসেব করে দেখতে হবে আমরা কী পরিমাণ সময় ভালো কাজে ব্যয় করেছি। মুমিন বান্দার জীবনে অনর্থক ব্যয় করার মতো কোনো সময় নেই। মুসলমানের জীবনের সৌন্দর্যই হলো অহেতুক বা অর্থহীন কাজ পরিহার করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেনঃ
নিশ্চিত ভাবেই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা। যারা নিজেদের নামাযে বিনয়ী ও নম্র। যারা বাজে বা অযথা কথা-কাজ থেকে দুরে থাকে। যারা তাজকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়। এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (সূরা আল মু’মিনূন ১-৫)
সুরা আল-মু’মিনূনের প্রথম পাঁচ আয়াতের মাধমে বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট। এখানে আল্লাহ তাদের কথা বলেছেন যারা নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে এবং তাদেরকেই মুমিন বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে প্রথমেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং কাজ সালাত এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা বিনয়ের সাথে যথাযথভাবে আদায় কত্রে হবে। এর পরেই বলা হয়েছে যে বাজে বা অযথা কথা-কাজ থেকে দুরে থাকতে। আর বাজে বা অযথা কথা-কাজ থেকে দুরে থাকার অর্থ হচ্ছে সর্বদা ভালো কাজ করা। যেই কাজের মাধমে দুনিয়ার কল্যানের সাথে সাথে আখিরাতের কল্ল্যান লাভ করা যায় সেই কাজ করা। সবথেকে ভালো কাজ হলো আল্লহর ঈবাদত করা এর পর হালাল জীবিকার সন্ধান করা।
আর এর বিপরীত কিছু অর্থহীন কাজ হচ্ছেঃ
১. অনেক্ষন কাজ ছাড়া বসে থাকা।
২. বেশি ঘুমানো।
৩. আজে বাজে চিন্তা করা।
৪. অপচয় বা বিলাসিতা করা।
৫. ধূমপান বা নেশা করা।
৬. মানুষের দোষ খুজে বেড়ানো বা গীবত করা।
৭. মোবাইল বা কম্পিউটারে গেমস খেলা বা অপ্রয়োজনীয় চ্যাট করা।
৮. অনেক সময়ধরে টিভি দেখা বা টিভি-তে অপ্রয়োজনীয় অনুস্থান দেখা।
৯. খেলাধুলা দেখা, মুল্যবোধহীন গান বা নাটক-সিনেমা দেখা বা শুনা, নাচ দেখা।
১০. শরীরচর্চা হয় না এমন খেলাধুলা করা যেমনঃ তাস, দাবা, লুডু, ক্যারাম ইত্যাদি খেলাধুলা করা।
১১. অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বা আড্ডা দেয়া।
১২. অশ্লীল ছবি দেখা বা অশ্লীল চিন্তা করা।
১৩. অর্থ, শ্রম এবং সময়ের অধিক অপচয় করে শিল্পকর্ম করা।
১৪. মৌলিক বা অধিক প্রয়জনীয় সামগ্রিক তুলনায় যৌগিক বা বিলাসী সামগ্রীকে প্রাধান্য দেয়া।
১৫. যার যেই কাজের যোগ্যতা নেই বার বার সেই কাজের সেই কাজের চেষ্টা করা।
১৬. বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে কম গুরুত্ব দেয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া।
মৃত্যুর পরের জবাবদিহিতা সম্পর্কে যেহেতু কোনো মুসলমানের সন্দেহ নেই, সুতরাং পার্থিব জীবনের সবসময়েই যাতে নেক কাজে ব্যয় হয় সে জন্য সচেষ্ট থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ ( র: ) নবী করীম (স: ) থেকে বর্ণনা করেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদম ও স্ব স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না।
১. জীবন কিভাবে অতিবাহিত করেছ?
২. যৌবন কিভাবে অতিবাহিত করেছ?
৩. কিভাবে ধন-সম্পদ উপার্জন করেছ?
৪. কোন পথে ধন সম্পদ ব্যয় করেছ?
৫. কতটুকু জ্ঞান আহরন করেছ এবং সে অনুযায়ী কাজ/আমল করেছ কিনা?
এই পাঁচটি প্রশ্নের প্রত্যেকটি-ই সাথে সময় এবং কাজ বিষয়ক।
ঠিক উপরের হাদিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসূল (স: ) সাহাবীদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন পাঁচটি বস্তুকে একে অপরের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিবে এবং মূল্যবান মনে করবে,
১) বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে,
২) অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে
৩) দারিদ্রতার পূর্বে স্বচ্ছলতাকে
৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবকাশকে
৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে। ( হাকীম, বাইহাকী)
আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
দুটি নেয়ামতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ ধোকাপ্রাপ্ত। একটি হলো সুস্থতা আর অপরটি অবসরতা।(বুখারী) অর্থাৎ, সুস্থতার মর্যাদা তখনই বুঝা যায়, যখন অসুস্থতার পাহাড় মাথায় চেপে বসে। দ্বিতীয় প্রকার নেয়ামতের কথা ঐ সকল লোকের নিকট জিজ্ঞেস কর, যারা সামান্য সময় অবসর পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল।
মানুষের অন্যতম বড় দুর্বলতা হচ্ছে ভুলে যাওয়া। অর্থাৎ মানুষের করনীয় কাজ ভুলে যাওয়া বা স্মরণ না থাকা। মানুষের চিন্তা করা উচিৎ যে, এই দুনিয়ার জীবন কি? এ তো জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে অনিশ্চিত সামান্য বিরতি।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আমাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণময় ও শান্তিময় জীবন অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪৩