
সামনে খোলা জানালা, মুখ তুলে তাকালেই চোখে পড়ে আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা থালার মত চাঁদটা। উথাল পাথাল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে আজকের রাত। জানালার এপাশে ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে একটা টেবিল, আর তার সামনে তারচেয়েও নড়বড়ে বহু পুরনো হাতল ভাঙা একটা চেয়ার। চেয়ারে ঘাড় গুজে বসে আছে মানুষটা। দু'আঙুলে সর্বশক্তিতে আকড়ে ধরা কলম, কখনো কামড়ে ধরছে ঠোঁট, কখনো বাঁ হাতের অস্থির আঙুল চলছে চুলে, চেপে ধরছে কপাল, মাথা, কখনো হাল ছেড়ে দিয়ে চোয়াল এসে ঠেকছে বুকে। অস্থির, বড় অস্থির। বিছানায় নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়ে বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে মায়া। গত কয়দিন ধরে মানুষটার এইরকম উদভ্রান্ত দশা। খায় না, ঘুমায় না, কথা কয় না, হাসে না। রক্তজবার মত ঘোরলাগা টকটকে লাল চোখে কখনো কখনো মায়াকে দেখে, সেই দৃষ্টি মায়াকে ভেদ করে কই চলে যায়! এমন দিনগুলোয় মানুষটা মায়াকে চিনতেও পারে না, মায়ার কাছেও সে হয়ে ওঠে বড় অচেনা একজন।
বুক নিংড়ে গাঢ় একটা শ্বাস বেরিয়ে আসে মায়ার। মানুষটার জন্য কিছু একটা করতে খুব ইচ্ছা হয় তার। কিন্তু কি করতে পারে সে? কতটুকুই বা তার ক্ষমতা! এই যে এখন অস্থির পা টেনে পায়চারী করছে ঘরের এ মাথা ও মাথা, একবারও কি ঘাড় ফিরিয়ে চেয়েছে বিছানার দিকে? সে কি বুঝতে পারে আরেকটি প্রাণীও বড় সন্তর্পণে শ্বাস ফেলে এ ঘরে? এক জোড়া চোখ অনুসরণ করছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ? সে তো বেমালুম ভুলেই গেছে মায়ার অস্তিত্ব। মায়ার বড় বড় চোখ ভরে ওঠে জলে, দাঁতে ঠোঁট কামড়ে প্রাণপন চেষ্টায় তার গড়িয়ে পড়া থামায় সে। বিড়বিড় করে কি যেন আউড়ে চলে মানুষটা, বারবার মাথা ঝাকায় কিছু ঝেড়ে ফেলার মিছে চেষ্টায়। সশব্দে ফিরে গিয়ে বসে পড়ে চেয়ারে, দু'হাতে খামচে ধরে চুল।
মানুষটার কষ্টে বুক ভেঙে আসে মায়ার। ধীরে বিছানা ছাড়ে, নি:শব্দে ট্রাঙ্কেও ডালাটা খুলে বের করে বহুদিন আগের একটা শাড়ি, টকটকে লাল একটা বেনারসী, মায়ার বিয়ের শাড়ি। শাড়িটা বুকে চেপে ধরে মায়া, পাঁচ বছর...পাঁচ বছর...কিভাবে সময় বয়ে যায়! আলনাটার ওপাশে সরে গিয়ে ধীরে ধীরে পরে নেয় সেটা। হারিকেনের টিমটিমে ভূতুড়ে হলুদাভ আলোয় দাগ পড়া ঝাপসা আয়নাটায় দেখে নিজেকে। কতদিন, কতদিন সে নিজের দিকে তাকায় না ফিরে। চিরুনি হিচড়ে নিয়ে বহুচেষ্টায় পাট করে তার রুখুসুখূ চুল, বড় একটা হাতখোপা বেঁধে নেয়। হাল্কা পাউডার বোলায় মুখে, চোখের কোলে টানে কাজলের গাঢ় রেখা, কপালে বড় একটা লাল টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে একগাছা রেশমের চুড়ি। এইসব সস্তা প্রসাধন তাকে কতটা আকর্ষণীয় করে তুলল, ঘুরে ঘুরে সে দেখে একটু। মনে হয় সস্তা একখানা রঙচঙে কাগজের ফুল; ঘ্রাণ নেই, প্রাণ নেই, বাইরের চটকখানি কেবল।
চুড়ির রিনঠিন তুলে সে ভেসে আসে মানুষটার কাছে, হাত রাখে তার কাঁধে। ফিরে তাকায় মানুষটা, কোন এক গভীর শূণ্যতা থেকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে তার চোখ, ফিরে আসে দৃষ্টি। ঠোঁটে ফুটে ওঠে অদ্ভূত এক টুকরো হাসি। চোখে মদিরা তুলে সে হাসি ফিরিয়ে দেয়ে মায়াও। হাত ধরে নিয়ে আসে বিছানার প্রান্তে, আলগোছে খসে পড়ে মায়ার শাড়ির আঁচল। মানুষটার উদভ্রান্ত শূণ্য চোখে মায়া দপ করে জ্বলে উঠতে দেখে কামনা। তার ভেতরের প্রবল পুরুষটি এক ঝটকায় তাকে বিছানায় আছড়ে ফেলে। প্রবল বাসনায়, উদগ্র কামনায় তারা আঁকড়ে ধরে পরস্পরকে। উন্মত্ততা এক পর্যায়ে ভেঙে দেয় মায়ার হাতের চুড়ি, গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা রক্ত। সুখের শেষ চ’ড়াটায় পৌঁছানোর আগ মূহুর্তে মানুষটার চোখ পড়ে সেদিকে, সে থমকে যায়। মূহুর্তেই সে নেমে আসে থরথর এক স্বপ্ন থেকে। তার চোখে ভর করে নির্লিপ্ততা, সে চরম নিস্পৃহ গলায় বলে, ”না, আজ নয়। এভাবে নয়।” মায়াকে ফেলে সে উঠে যায়, পরিপাটি করে নেয় নিজেকে, কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়। পায়চারী করে ঘরময়, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোরলাগা চোখে চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে।
ওদিকে বিছানায় এলোমেলো পড়ে থাকে মায়ার নগ্ন, পরিত্যক্ত দেহটা। প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণায় মায়া ফুলে ফুলে কাঁদে। আজ মায়ার ভালবাসা তাকে আর টানে না, মায়ার শঙ্খের মত সাদা, কোনারকের মূর্তির মত নিখুঁত দেহটা তার মধ্যে কোন আকর্ষণ তৈরি করে না। কত অবলীলায় সে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায়। এখন তার আরো তীব্র, আরো মোহময় কিছু চাই।
অথচ একদিন ছিল এই মায়ার চেয়ে বড় আকর্ষণ পৃথিবীতে আর কিছু ছিল না। কোন বিকেলে বারান্দায় পাঁচ মিনিটের জন্য মায়ার চুল উড়তে দেখা বা একটা বাঁকা চাহনি কি মিষ্টি এক টুকরো হাসি তাকে রাতের পর রাত কবিতার অজস্র চরণ জুগিয়েছে। মায়া ছিল তার কবিতা রচনার একমাত্র প্রেরণা। তার সেইসব গভীর আবেগময় চিঠি, দীর্ঘ প্রেমময় কবিতা, আর অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলা মায়াকে পাগল করেছিল। বাবা-মা, সমাজ, নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ- সবকিছু অগ্রাহ্য করে সে বেরিয়ে এসেছিল এই মানুষটার হাত ধরে। মানুষটার প্রতি তার ভালবাসা যে কত তীব্র, গভীর তা অনুভব করার ক্ষমতা তার নেই। পেয়ে যাওয়ার পর মায়ার প্রতি তার ভালবাসার জোয়ারে ভাটা পড়েছিল খুব দ্রুতই। মায়ার চোখ, নাক, ঠোঁট, চুল, শঙ্খসাদা শরীর- কোনকিছুই তাকে আর টানতো না। সে যে মায়াকে ভালবাসেনি কোনকালে তা বুঝতেই তার সময় লেগে গিয়েছিল অনেক। পুরোটাই ছিল অদ্ভূত একটা মোহ, দুর্লভকে পাওয়ার আকর্ষণ। কিন্তু যখন টের পেল, তখনো পারল না তাকে ছেড়ে দিতে। দাঁড়ের ময়নার মত, খাঁচার খরগোশের মত তার প্রতিও যে জন্মে গেছে এক অবোধ্য মায়া! তাই একদিকে তাকে পুরোটাই অধিকার করে থাকা, অন্যদিকে এই নিদারুণ উপেক্ষা।
কিন্তু মায়া...মায়া কি করবে! সে যে পাগলের মত এই মানুষটাকে ভালবাসে। তার ভালবাসা, উপেক্ষা, তার কবিতা, সৃষ্টি-মানুষটা যে তাকে চারদিকে কত বিচিত্র মায়ার জাল পেতে জড়িয়ে আছে। এই জাল কেটে সে বেরুতে পারে না কিছুতেই। মায়া...বেচারি মায়া...
মানুষটা সিগারেট শেষ করে কিছুক্ষণ মায়াকে দেখে, সে চোখে কী ঘৃণা? মায়া বোঝে না। তারপর ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। সামনের বারোয়ারী, চিলতে উঠোনে পায়চারী করে, বিড়বিড় করে চাঁদের দিকে চেয়ে। উঠে বসে মায়া বিছানায়। পানি নেই আর চোখে, শুধু উষ্ণ বাষ্প। মানুষটা বলেছিল খুব তীব্র সুখ বা আনন্দ কিংবা কোন গভীর দুঃখের অনুভূতি তার বুকে যে অনুরণন তোলে তাই তার কবিতার জন্ম দেয়। আর তার মনের মত একটি কবিতা তাকে দেয় উদ্দাম সঙ্গমের তৃপ্তি, সেই পরিতৃপ্তিই কেবল তার জ্বালা মেটায়, সে শান্ত হয়। অসহনীয় সুখের গোড়ায় টেনে নিয়েও মায়া তাকে সেই অনুভূতিটুকু দিতে পারে নি। তবে কি গভীর কোন ব্যথার অনুভূতিই দেবে সে? যে অনন্ত কষ্টের গহ্বরে মায়ার হাবুডুবু তার অতলে টেনে নেবে সে মানুষটাকে? তবে কি জন্ম নেবে একটি কবিতা, যা তাকে সন্তুষ্ট করবে, শান্ত করবে মন? মায়া ফিরে পাবে তার ভালবাসার মানুষকে? কিভাবে? কিভাবে!
ক্ষণিক আগের মানুষটার চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে মায়া তাকায় ঘরের চারপাশে। তার চোখ আটকা পড়ে জানালার সামনের ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে টেবিলটায়। টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো খাতা, মানুষটার সৃষ্টি, সারাজীবনের সঞ্চয়, পাতার পর পাতা যেখানে শব্দেরা এঁকে গেছে মিথ্যে কুহক। মানুষটার নিজের কাছে যেমন, মায়ার কাছেও তেমনি বড় আদরের, গর্বের সম্পদ এইসব কবিতারা। তারা দুজনেই স্বপ্ন দেখে একদিন লোকে জানবে এদের কথা, একদিন লোকের হাতে ঘুরবে মলাটে বাঁধানো এইসব কবিতার দল, লোকের মুখে ফিরবে মানুষটার নাম। অনেক মমতা আর ভালবাসায় মায়া আলতো হাত বুলায় খাতাগুলোর ওপরে। কতটা তীব্র হবে এদের হারানোর বেদনা মানুষটার মনে? সে বেদনা থেকে কি জন্ম হবে ওই কবিতাটার, যা মানুষটার মাথা কুড়ে খাচ্ছে!
খুব সুন্দর করে প্রস্তুতি নেয় মায়া। আলতো হাতে দরজার ছিটকিনি তুলে দেয়, বিয়ের বেনারসীটা পাতে মেঝেয়, তারপর মাঝখানে বসে খাতার পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটা চক্র তৈরি করে নিজের চারধারে। তখনো মানুষটার পায়ের শব্দ ভেসে আসে মায়ার কানে। শেষ পাতাটা ছেঁড়া হয়ে গেলে হারিকেন খুলে কেরোসিন ছিটিয়ে দেয় তাতে, বহুযত্নে তুলে নেয় দেয়াশলাইয়ের একটা কাঠি, এক মূহুর্ত, তারপরই জ্বেলে দেয় আগুন। বোকার মত একটুখানি স্থির থেকেই আগুনটা দপ করে লাফিয়ে ওঠে, মায়ার চারদিকে তৈরি হয় একটা অগ্নিবলয়। তার নগ্ন, সাদা দেহটায় অদ্ভূত এক লাল আভা জেগে ওঠে। মায়া মুগ্ধ হয়ে দেখে।
যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে দরজায় করাঘাতের শব্দ, মানুষটার ক্ষীণ গলা, ”কি করো মায়া? কি করো? দরজা খোল।” চারদিকে জেগে ওঠে আরো আরো লোকজনের শব্দ, কিন্তু মায়ার কানে তার আর পৌঁছায় না। আগুনের লকলকে শিখা মায়াকে গ্রাস করে নেয়ার আগে তার মুখে পরম পরিতৃপ্তির এক হাসি দেখা যায়। অবশেষে সে পেরেছে। মানুষটার বুকে সে তীব্র, গভীর এক অনুভূতির জন্ম দিতে পেরেছে, যে অনুভূতির তীব্রতা রাত পোহালে জন্ম দেবে একটি কবিতার। সত্যি হবে মানুষটার স্বপ্ন!
........................................
ছবি কৃতজ্ঞতা: -দূরদ্বীপবাসিনী_