২৫০ হিজরি, ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ।
শান্ত বিষণ্ণ এক বিকেল। সামারা নগরীর প্রাসাদে পায়চারি করছেন খলিফা আবু আল আব্বাস আল মুসতালিন, দৃষ্টি নিবদ্ধ তাঁর প্রাসাদ মসজিদের সর্পিলাকার মিনারটি ছাড়িয়ে দূরে দজলা নদীর পানে। মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে খেজুরবিথীর সারি, খেয়া নৌকাগুলো এসে ভিড়ছে তীরে, বাড়ি ফিরছে জেলেরা। কিন্তু খলিফা ভাবছেন আরও দূরে অনেক ভাটিতে বাগদাদ নগরীর কথা—বৃত্তাকার নগরী বাগদাদ, ১৪৫ হিজরিতে যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ খলিফা আবু জাফর আল মনসুর।
আল মনসুর যখন নগরীটি নির্মাণ করেন, চারপাশে চারটি সিংহদ্বার নির্মাণ করেন তিনি, যাতে হেজাজ থেকে আগত কোনো মানুষ প্রবেশ করবে কুফা ফটক দিয়ে, আল মাগরেব বা পশ্চিমের আগন্তুক আসবে দামেস্ক ফটক দিয়ে, আহওয়াজ, বসরা, ইয়ামামা ও বাহরাইনের আগন্তুক বসরা ফটক দিয়ে, আর পূর্বদেশীয় আগন্তুকরা খোরাসান ফটক দিয়ে। এদের ভেতর দিয়েই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতেন প্রজাবৎসল খলিফা হারুন আল রশীদ—কবি আবু নুয়াস, উজির জাফর বার্মেকি আর জল্লাদ মাসরুরকে সঙ্গে করে গভীর নিশীথে ঘুরে বেড়াতেন বাগদাদের পথঘাট, বাজার, সরাইখানা। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ঐশ্বর্য্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগরী বাগদাদ, সেখানেই কেটেছে আল মুসতালিনের শৈশব কৈশোর, পিতামহ খলিফা আল মুতাসিম বিল্লাহর কাঁধে, পিতৃব্য-ফুপুদের কোলেপিঠে, আর প্রাসাদের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে ভাইবোনদের সাথে লুকোচুরি খেলে।
শিল্পীর চোখে, আল মনসুরের বাগদাদ
কিন্তু বাগদাদের স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে একদিন দাঙ্গা বেঁধে যায় মুতাসিমের সামরিক বাহিনীর মামলুক তুর্কী সৈন্যদের; ২২০ হিজরিতে মুতাসিম রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন দজলা নদীর পূর্ব তীরে, ১৩৫ কিলোমিটার উজানের এ নগরীতে। সামারা, প্রাতিষ্ঠানিক নাম যার সুররা মান রা—যে দেখে তাকে আনন্দিত হয় সে, আল মুসতালিনের মনে বরং বিষণ্ণতা আর অস্বস্তিই উদ্রেক করে কেবল। মামলুকদের সমর্থনেই সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি, বয়োজ্যেষ্ঠ চাচাতো ভাইদের সরিয়ে, কিন্তু চারদিকে আজ ষড়যন্ত্রের ভারী দেয়াল, ঘিরে ধরছে ধীরে ধীরে।
প্রাসাদের দরজায় এসে দাঁড়ায় দৌবারিক, মৃদুকণ্ঠে ঘোষণা করে, "পণ্ডিত আল কিন্দি আমিরুল মুমেনিনের দর্শনপ্রার্থী।"
"নিয়ে এসো তাকে," অনুমতি দান করেন মুসতালিন।
"আপনার উপর স্রষ্টার শান্তি বর্ষিত হোক, হে বিশ্বাসীদের নেতা," বিনম্র সালাম প্রদান করেন আল কিন্দি।
"আপনার উপরও শান্তি বর্ষিত হোক, হে প্রজ্ঞাবানদের নেতা," সম্ভাষণের জবাব দেন খলিফা।
আল কিন্দি
আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক ইবনে আল সাব্বাহ ইবনে ইমরান ইবনে ইসমাইল ইবনে আল আশআত ইবনে কায়েস আল কিন্দি, আরবদের দার্শনিক হিসেবেই আজকে যিনি সমধিক পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১৮৫ হিজরিতে, জাজিরাতুল আরবের নজদ অঞ্চল থেকে আগত বিখ্যাত কিন্দাহ গোত্রে। তাঁর পূর্বপুরুষ কিন্দাহ গোত্রের শেষ রাজা আল আশআত ইবনে কায়েস ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং রাসুল মুহম্মদ (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার অনন্য সৌভাগ্য লাভ করেন। পরবর্তীকাল শাম, ইরাক এবং পারস্য অভিযানে বিজয়ী আরব বাহিনীর সঙ্গী হন তিনি; তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.) বিশেষ মিশনে আজারবাইজানও প্রেরণ করেন তাঁকে একদা। শেষজীবনে পরিবার পরিজন নিয়ে ইরাকের কুফা নগরীতে স্থায়ী হয়েছিলেন আশআত।
উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ মর্যাদা লাভ করতে থাকেন আল আশআতের উত্তরসূরীগণ। আল মনসুর-পুত্র আল মাহদি এবং মাহদি-পুত্র হারুন আল রশীদের খেলাফতে কুফার শাসনভার ন্যস্ত থাকে আল কিন্দির পিতা ইশহাক ইবনে আল সাব্বাহর হাতে। আর এখানেই নবম শতকের সূচনালগ্নে জন্মগ্রহণ করেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল কিন্দি।
৮০৯ খ্রিস্টাব্দে, যে বছর মারা যান আল রশীদ, সেবছরই পরলোক গমন করেন ইশহাকও—কিন্দি তখন নিতান্তই শিশু। কঠিন সে শৈশবেই কুফার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে কুরআন পাঠ, আরবি ব্যাকরণ, সাহিত্য ও পাটিগণিতে দক্ষতা অর্জন করেন আল কিন্দি। অতঃপর তরুণ বয়সে তিনি গমন করেন বসরা নগরীতে, আল আশআতের একদা ক্রয়কৃত ভূসম্পতি লাভ করেন উত্তরাধিকারসূত্রে, অর্জন করেন ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর বিদ্যাশিক্ষা।
আল রশীদ-পুত্র আল মামুনের খেলাফতে বাগদাদ গমন করেন আল কিন্দি, রাজনৈতিক পদের জৌলুস ও সম্মানের প্রাচুর্য্য উপেক্ষা করে মনোনিবেশ করেন জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে। গ্রিক ও আরামায়িক ভাষায় দখলের দরুণ সাবলীলভাবেই তিনি হেঁটে বেড়ান প্রাচীনকালের জ্ঞানীদের পথে, অনুসন্ধিৎসু মনে মুক্তা খুঁজে ফিরেন তাঁদের মূল রচনাগ্রন্থে।
আল রশীদের আরেক পুত্র খলিফা আল মুতাসিম তাঁর পাণ্ডিত্য ও ধীশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে সভাজ্যোতির্বিদ পদে নিয়োগ দান করেন তাঁকে এবং নতুন রাজধানী সামারাতে পুত্র আহমাদের শিক্ষাভার অর্পণ করেন তাঁর হাতে। বাগদাদের কিংবদন্তিতুল্য গ্রন্থাগার বায়তুল হিকমা'র (House of Wisdom) অধ্যক্ষও নিযুক্ত হন কিন্দি, তাঁরই অধীনে কাজ করতেন বীজগণিতের জনক আল খোয়ারিজমি এবং বনু মুসার ভ্রাতৃত্রয়। দর্শনের উপর ফি আল-ফালসাফা আল-উলদ নামক তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থটি আল কিন্দি উৎসর্গ করেছিলেন আল মুতাসিমকে; বর্তমানে এর শুধু প্রথম খণ্ডটির অস্তিত্ব আছে বলে জানা যায়।
কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিময় কাটেনি আল কিন্দির জীবন। খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলে গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির ষড়যন্ত্রে প্রাসাদের বিরাগভাজ হন তিনি, তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। ঐতিহাসিক তাবারী (মৃত্যু ৯২৩ খ্রি.) বর্ণনা করেন, আল কিন্দির সাথে বন্ধুত্ব ও তাঁর দর্শনসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দান করার কারণে বনু মুসার পুত্রদের প্ররোচনায় খেলাফতের যথার্থ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন আহমাদ ইবনে আল মুতাসিম। ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাগারটি ফিরে পান আল কিন্দি, সেসঙ্গে কিছুটা সম্মানও, কিন্তু আহমাদের সাথে বন্ধুত্বের কারণে প্রাসাদে তাঁর অনন্য স্থানটি আর ফিরে পাননি, যদিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বস্ত থেকেছিলেন দেশ ও খেলাফতের প্রতি।
চামড়ার থলেটি খলিফার সামনে পেশ করেন আল কিন্দি, "আপনার জন্য সামান্য উপহার।"
"কী সেই উপহার," কৌতুক খেলা করে খলিফার মুখে।
"দার আল সালামের বাদশার খেদমতে তথ্যগুপ্তিবিদ্যার রহস্য উন্মোচনে রচিত একটি গ্রন্থ।"
উত্তেজনায় হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে খলিফার কণ্ঠস্বর, "এটি কি সেই গ্রন্থ!"
"জ্বি, আমিরুল মুমেনিন, এ-ই সেই গ্রন্থ, যা আদিষ্ট হয়েছিলাম আমি।"
থলের বাঁধন খুলে গ্রন্থটি বের করেন আল কিন্দি, ধূসর কাগজে ঝকঝকে তাঁর মুক্তাক্ষরের ঝিলিক দেখা যায়। খলিফা পড়তে থাকেন দ্রুত:
"পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে, আমাদের জন্য যথেষ্ট যিনি, যিনি সুমহান পবিত্র—
আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক আল কিন্দের এ অভিসন্দর্ভখানি তথ্যগুপ্তিলিপির পাঠোদ্ধারে রচিত, আবু আল আব্বাসের প্রতি নিবেদিত
জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা বিস্তৃত হোক চিরকাল আপনার, আমি অবগত আছি সে বিষয়ের প্রতি যা আপনি আদেশ করেছেন রচনা করতে। আপনার অভিলাষ এমন একটি গ্রন্থ যা ব্যাখ্যা করবে গুপ্তলিপি পাঠোদ্ধারের উপায়সমূহ; গ্রন্থ যা হবে সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত। প্রশংসা সে মহান প্রভুর, যিনি আপনাকে নিমিত্ত করেছেন মানুষের কল্যাণে, মহান অথচ অবহেলিত এক জ্ঞানে। প্রার্থনা করি, আপনাকে তিনি গুণান্বিত করেন সকল শুভ গুণে, সহায় হোন আপনার মনোবাসনায়, বিজয়ী করেন অভীষ্ট লক্ষ্যে আপনার, এবং ধাবিত করেন পদক্ষেপ আপনার পার্থিব ও পরজীবনে সৌভাগ্যের পথে।
আমি বলছি যে, আল্লাহ দান করুন দীর্ঘজীবন আপনাকে এবং উন্নত করুন আপনার অবস্থার, গুপ্তলিপিবিশ্লেষণ প্রদান করে থাকে মহত্তম সুবিধা, কারণ প্রাচীনকালের বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানী অজানা অনেক চিহ্ন ব্যবহার করে গেছেন তাদের গ্রন্থসমূহে। যারা ব্রতী না হয় এ কাজে, তারা কল্যাণ লাভ করে না তাঁদের জ্ঞান থেকে, অর্জন করে না কোনো উৎকর্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। আপনি যা কামনা করেন, তা যেন লাভ করেন সহজে, এতে সাহায্য করাই অভিলাষ এবং দায়িত্ব আমার; নয়তো—স্রষ্টা সহায় হোন কর্মে আপনার—পূর্বসূরীদের পদক্ষেপ অনুসরণ করাই শ্রেয়তর মনে করতাম আমি, নিগূঢ় বিষয়ের অর্থ ব্যক্ত ও প্রদর্শন করার পরিবর্তে গুপ্তই রাখাই অভিপ্রায় যাদের। আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি আমার আত্মোপলব্ধি দ্বারা যে দর্শনের উপর রচিত অনেক গ্রন্থ আপনার নিকট এক মুহূর্তে যা পরিস্ফূট, অন্য অনেকের পক্ষে স্বল্প সময়ে তা অনুধাবন একেবারেই দুরূহ, যদিও তা সুস্পষ্ট হতে পারে হয়তো কেবল প্রচুর পড়াশোনার পর। ফলশ্রুতিতে এ বিষয়ের উপর আমি রচনা করেছি এমন গ্রন্থ যা আমার বিশ্বাস যথেষ্ট সরল হবে প্রজ্ঞাবানদের কাছে, এবং বোধের অগম্য থাকবে সাধারণের কাছে।"
মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রন্থখানি পড়তে থাকেন আল মুসতালিন। কী সুশৃঙ্খল সুলিখিত বিশদ গ্রন্থ এক, গাণিতিক ও ভাষাবিজ্ঞানের দুর্বোধ্য বিষয়, অথচ উপাখ্যানের মতো পড়তে। এ গ্রন্থ কি পারবে তাঁর চারপাশে ষড়যন্ত্রের রহস্য ভেদ করতে!
২.
সুপ্রাচীন কাল থেকেই তথ্যগুপ্তিলিখনের (cryptography) আদানপ্রদান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মানবসভ্যতায়, অনেক সময় ইতিহাসের গতিপথই পরিবর্তন করে দিয়েছে তা। ঐতিহাসিকভাবে লিপিবদ্ধ গুপ্তলিখনের প্রথম উদাহরণটি আমরা পাই প্রাচীন মিশরে, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে। মিশরে তখন দ্বাদশ রাজবংশের সম্রাট দ্বিতীয় আমেনেমহেতের শাসনামল, তার অধীনে উচ্চ মিশরের মেনেত খুফু নগরীর প্রশাসক ছিলেন দ্বিতীয় খনুমহোতেপ। মৃত্যুর পূর্বে নিজের বংশলতিকা, সমরাভিযান ও অর্জনসমূহ চুনাপাথরের পাহাড়চূড়ায় উৎকীর্ণ করে যান খনুমহোতেপ। সমাধিলিপির বিশ্লেষণে রহস্যজনকভাবে পরিলক্ষিত হয়, বর্ণনার শেষাংশে এসে হায়ারোগ্লিফের চিহ্নগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাল্টে দিয়েছে খনুমহোতেপের সুবর্ণিকগণ, সুপরিচিত চিহ্নের পরিবর্তে কম প্রচলিত চিহ্ন ব্যবহার করেছে, লঙ্ঘন করেছে ব্যাকরণবিধির।
দ্বিতীয় খনুমহোতেপের সমাধি
সুবর্ণিকগণ কেন কাজটি করেছিলেন, আজ আর সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, খনুমহোতেপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসংক্রান্ত বিশেষ এ অনুচ্ছেদটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাল্টে দেয়া হয়েছে যাতে জনসাধারণের কাছে তা অস্পষ্ট থেকে যায়।
১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মেসোপটেমীয় একটি কীলকলিখন (cuneiform)-ফলকে তথ্যগুপ্তিকরণের (encryption) আরও উৎকর্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দজলা নদীর তীরে আবিষ্কৃত ৩ ইঞ্চি x ২ ইঞ্চি মাপের এ ফলকটিতে তৈজসপত্র উজ্জ্বলকরণের একটি সূত্র লুকিয়ে রাখা হয় গুপ্তসংকেতের মাধ্যমে। সূত্রটিতে এমন সব চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে যার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ।
৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, হিব্রু লেখকগণ নবী ইয়াহইয়া'র বাইবেল গ্রন্থটির অনুলিপি তৈরিতে বর্ণপ্রতিস্থাপন ধরণের এক গুপ্তলিখনপ্রণালী (cipher) অবলম্বন করেন, যা আজকে আতবাশ (atbash) নামে পরিচিত।
তথ্যগুপ্তিকরণের গ্রিক উদাহরণ আমরা পাই হেলেকারন্যাসিসের হিরোডিটাস রচিত ইতিহাস গ্রন্থটিতে, যাতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে সংঘটিত গ্রিস ও পারস্যের যুদ্ধবিবাদের ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি। পারস্যরাজ জেরেক্স (Xerxes) গ্রিকদের উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য সৈন্যসামন্ত জড়ো করতে থাকেন গোপনে। ঘটনাক্রমে সেসময় পারস্যদেশেই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিল ডিমেরাটাস নামে এক গ্রিক। দেশের জনগণ ডিমেরাটাসকে বিতাড়িত করলেও মাতৃভূমির বিপদে উদাসীন থাকতে পারল না সে, কাঠের ফলকে বিপদের কথা বর্ণনা করে তার উপর মোমের প্রলেপ দিয়ে পাঠিয়ে দিল গ্রিসে। পারস্যদেশের চৌকিগুলোতে পাহারাদারগণ সবরকমের তল্লাশি চালিয়ে গেলেও নিরীহ কাঠের ফলকটি তাদের হাত দিয়েই বেরিয়ে চলে গেল গ্রিসে। অভিযানের শুরুতেই সম্রাট জেরেক্সই উল্টো অতর্কিত গ্রিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে পরাস্ত হন।
হিরোডিটাস আরেকটি ঘটনার বর্ণনা করেন: মাইলেটাস নগরীর স্বৈরশাসক হিসটিয়াইয়ুস তার জামাতা ও উপদেষ্টা অ্যারিস্টাগোরাসকে একটি গোপন সংবাদ প্রেরণের ইচ্ছা পোষণ করেন। এ উদ্দেশ্যে হিসটিয়াইয়ুস তার এক চাকরের মস্তিষ্ক মুণ্ডন করে তাতে সংবাদটি লিখে রাখেন, এবং বেশ কিছুদিন পর চাকরের চুল গজালে তাকে পাঠিয়ে দেন অ্যারিস্টাগোরাসের কাছে। চাকরের চুল পুনরায় মুণ্ডন করে গুপ্তলিপিটি উদ্ধার করেন অ্যারিস্টাগোরাস, এবং তদনুযায়ী পারস্যরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেন দ্রুত।
মূল তথ্যকে পরিবর্তন না করে কেবল শত্রুর নজর থেকে গোপন রাখার এ পদ্ধতিকে বলা হয় স্টেগানোগ্রাফি (steganography)।
কেল্টিক গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে পরিচালিত গলের যুদ্ধে জুলিয়াস সিজারের সেনাপতি কুইন্টাস তুলিয়াস সিসেরো শত্রুবেষ্টিত হয়ে যখন আত্মসমর্পণের দিন গুনছিল, দ্রুত এক চিঠি দিয়ে সৈনিক পাঠান সিজার তার কাছে। চিঠিতে রোমান বর্ণগুলো গ্রিক বর্ণ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেন তিনি, যাতে সৈনিক ধরা পড়লেও শত্রু তার পাঠোদ্ধার করতে না পারে। সিজারের চিঠি পেয়ে মনোবল চাঙা হয় সিসেরো বাহিনীর, এর কিছুদিন পরই সিজার উদ্ধার করে তাদের।
সিজার আরও এক ধরণের প্রতিস্থাপন সাইফার ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। যেখানে চিঠির প্রতি বর্ণকে বর্ণমালায় তার তিন ঘর ডানের বর্ণটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতেন। অর্থাৎ
"প্রতিরোধ করো, আমি আসছি" এ সংবাদটি সিজার লিখতেন এভাবে
"ভষধঊষখফ ঘষখ উলঊ উড়ঞঊ"
চতুর্থ শতকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বাৎসায়ন কামসূত্র নামে বড়দের জন্য যে বইটি রচনা করেন, তাতে মেয়েদের জন্য চৌষট্টি কলা শিক্ষার প্রস্তাব করেন তিনি। রন্ধন, পোশাক পরিধান এবং প্রসাধন প্রস্তুতকরণের মতো সুপরিচিত কলার পাশাপাশি ম্লেচ্ছিত বিকল্প বা গুপ্তলিখন বিদ্যা নামে গূঢ় এক কলা উল্লেখ করেন তিনি, তালিকার ৪৫ নম্বরে, যার দ্বারা নারীরা তাদের গোপন প্রণয়ের কাহিনী নিশ্চিত গোপনীয়তায় সংরক্ষণ করতে পারবে। তার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে দৈবক্রমে অন্য একটি বর্ণের সাথে প্রতিবর্ণ হিসেবে সমন্বিত করা, এবং কাহিনী রচনার সময় মূল বর্ণকে তার প্রতিবর্ণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে ফেলা।
তাওরাত ও ইঞ্জিলে গূঢ়ার্থ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে ইউরোপের মঠগুলোতে ব্যাপকভাবে গুপ্তলিখনের চর্চা হয় অন্ধকার যুগে। সন্যাসী রজার বেকন, যিনি আরব গ্রন্থসমূহ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন, গুপ্তলিপির উপর রচনা করেন "Epistle on the Secret Works of Art and the
Nullity of Magic"। ক্যান্টারবুরি কাহিনী-খ্যাত জিওফ্রে চসার জ্যোতির্বিদ্যার উপর তাঁর একটি গ্রন্থের কয়েকটি অনুচ্ছেদ গুপ্তলিখনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
রেনেঁসার যুগে বিজ্ঞানের নানা শাখায় নিজেদের ধারণা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকতেন আবিষ্কারকগণ, ফলে নিজস্ব গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল অনেক সময় তাঁরা প্রকাশ করতেন সংকেতের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী হুক তাঁর একটি আবিষ্কারকে বর্ণনা করেন এভাবে: ceiiinosssttuv; সংকেতের সমাধানটি তিনি প্রকাশ করেন দেড়যুগ পরে, পূর্বের বর্ণগুলো পুনর্বিন্যস্ত করে: ut tensio, sic vis—সেরকমই প্রসারণ, যেরকম প্রযুক্ত বল, আজকে যা হুকের স্থিতিস্থাপকতা সূত্র নামে পরিচিত।
এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেক্সিকোর কাছে পাঠানো জার্মানির জিমারম্যান টেলিগ্রাম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ব্যবহৃত এনিগমা মেশিনের পাঠোদ্ধার বিশ্বযুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে ইতিহাসের গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তথ্যগুপ্তিকরণের করুণ উদাহরণও। স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি তার প্রটেস্ট্যান্ট চাচাতো বোন প্রথম এলিজাবেথকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন থেকে উৎখাতের পরিকল্পনায় ক্যাথলিক যড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগ দেন; গুপ্তলিখনের মাধ্যমে সংবাদ আদানপ্রদান করতে থাকেন তারা। একসময় রাণীর গুপ্তচরদের হস্তগত হয় কিছু সংবাদ এবং প্রচুর পরিশ্রমের পর সেগুলোর মর্মোদ্ধার (decipher) করেন তারা। এলিজাবেথ ও মেরি, একই বিছানায় হেসেখেলে যারা কাটিয়েছিলেন শৈশবের অনেকটা সময়, জীবনকে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছিলেন একেবারেই ভিন্নভাবে। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে এলিজাবেথের নির্দেশে শিরশ্ছেদ করা হয় মেরির।
৩.
আল কিন্দির গ্রন্থও করুণ পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি খলিফা আল মুসতালিনকে। ২৫১ হিজরিতে উৎখাত হন মুসতালিন, পরবর্তী খলিফা চাচাতো ভাই আল মুহতাজের নির্দেশে ২৫২ হিজরিতে শিরশ্ছেদ করা হয় তাঁর।
এর কয়েক বছর পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বৃদ্ধ আল কিন্দি। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে জৌলুসপূর্ণ বাগদাদ নগরী ধ্বংস করে হালাকু খান, বায়তুল হিকমার গ্রন্থাগারটি নিক্ষেপ করে দজলা নদীতে। লক্ষ লক্ষ বইয়ের বাধায় থমকে দাঁড়ায় দজলার স্রোত, প্রায় ছয় মাস ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে থাকে তার পানি। সুখের বিষয়, বেঁচে যায় আল কিন্দির গ্রন্থটি, পারস্যের গণিতবিদ নাসির আদদিন তুসী শেষ মুহূর্তে যে চার লক্ষ গ্রন্থ রক্ষা করে আজারবাইজানে নিয়ে এসেছিলেন, এটি সম্ভবতঃ তাদের মধ্যে ছিল। তবে গত এক সহস্র বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায় গ্রন্থটি, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে লেবাননের গবেষক ড. মুহম্মদ মরিয়াতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সুবিশাল সুলাইমানিয়া উসমানী গ্রন্থাগারে ঘুরে বেড়ানোর সময় হঠাৎই তার মুখোমুখি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
আল কিন্দির পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠা
সুপ্রাচীনকাল থেকেই তথ্যগুপ্তিবিদ্যার (cryptography) প্রচলন থাকলেও গুপ্তলিপি পাঠোদ্ধারে (cryptanalysis) ভাষাবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান গণিতের সমন্বয়ে প্রথম যুগান্তকারী মৌলিক আবিষ্কারটি সাধন করেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক ইবনে আল সাব্বাহ ইবনে ইমরান ইবনে ইসমাইল ইবনে আল আশআত ইবনে কায়েস আল কিন্দি। যে অনন্য গ্রন্থটি নিয়ে এ রচনা, নাম তার রিসালা ফী ইসতিখরাজ আল মুয়াম্মা।
________________
* দৌবারিক, খলিফা ও আল কিন্দির কথোপকথন অংশটুকু কাল্পনিক, তবে আল মুসতালিনের অনুরোধেই কিন্দি গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, এটি ঐতিহাসিক সত্য।
* গ্রন্থটিতে খলিফাকে আল মুসতালিন না বলে কেবল আবু আল আব্বাস হিসেবে সম্বোধন করেছেন আল কিন্দি; অতএব গ্রন্থটি সম্ভবতঃ আরও অধিককাল পূর্বে রচিত হয়েছিল।
* পোস্টটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। নানা ব্যস্ততায় দেরি হয়ে যায় পোস্ট দিতে, খসড়ার আনন্দই ভাগাভাগি হোক পাঠকের সঙ্গে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৩২