১৭৫৭ সালের সকালে, ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে যখন যুদ্ধ হচ্ছিল নবাব ও ইংরেজ দস্যুদের, তার অনতিদূরেই জমি চাষ করছিল বাঙালি দুই কৃষক। একজন প্রশ্ন করে অন্যজনকে, "এত গোলাগুলির আওয়াজ আসে কই থেকে?"
"আমাগো নবাবের সাথে যুদ্ধ হৈতাছে ইংরাজের।"
"অ...," বলে হালচাষে মনোযোগ দেয় প্রথম বাঙালি।
বিকেল বেলায় থেমে আসে গোলাগুলির আওয়াজ। লাঙল-জোয়াল খুলে বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নেয় কৃষকগণ। প্রথমজন প্রশ্ন করে আবার, "গোলাগুলি থাইমা গেল যে, বিষয় কী, যুদ্ধের কী খবর?"
"আমাগো নবাব হাইরা গেছে।" জবাব আসে।
"অ...," লাঙল-জোয়াল গুছিয়ে গরু নিয়ে গাঁয়ের দিকে হাঁটা দেয় কৃষক।
ইতিহাসে এ দুই কৃষকের অস্তিত্ম হয়তো নাই, তারা আছে কেবল গল্পেই; কিংবা না, তার চেয়েও বেশি, তারা আছে বাঙালির সামগ্রিক জাতিচেতনায়—সমগ্র দেশ যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তখনও আমরা বলতে পারি, অ!
ন্যায়বিচার সহজ নয়। মৃত্যুদণ্ডের মতো ভয়ঙ্কর শাস্তি নিশ্চয়ই অপছন্দের কাজ, তবু কখনো কখনো মানবগোষ্ঠিকে মৃত্যুদণ্ডের কাজটি করতে হয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই। সৌদি আরবে আট বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদে ন্যায়ের প্রতি সৌদি রাজতন্ত্রের একনিষ্ঠতার কোনো প্রমাণ সাধারণ বিবেচনাবোধে পাইনি আমি, কারণ এরা স্বৈরশাসক, নৈতিক মেরুদণ্ড ভঙ্গুর এদের, ফলে দুর্বল বাঙালি এবং সবল ব্রিটিশ/আমেরিকানদের জন্য ভিন্ন বিচার এদের।
নিচের ছবিটি তীব্র লজ্জিত ও ব্যথিত করে আমাকে,
না, আমি ভুলে যাইনি, মিশরের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পুত্রের ছবির উপর বৃদ্ধ এক বাবার মাথাটি হয়তো ঝুলে আছে। কিন্তু বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ সৌদি আরবের ন্যায়বিচার নয়, ভণ্ডামি। গরীব উভয় পরিবারের জন্যই চূড়ান্তভাবে দুঃখজনক হয়ে থাকবে এ বিচার।
এক বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী বড় কঠিন জায়গা। দুর্ভিক্ষে, অরাজকতায় শস্যের পরিবর্তে মারণাস্ত্র সহজলভ্য আজকে। শক্তিমত্ত রাষ্ট্র নিজের ভেতরে চাষ করে শান্তির, সন্ত্রাস পাঠায় অন্যদেশে। সৌদি কিংবা বাইরের বিশ্বকে দোষারোপ করার পূর্বে, নিজেদের নির্লিপ্ত অ-থেকে মুক্তির বড় প্রয়োজন আমাদের। আট বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ যেদিন হয়, সেদিনও দেশের বাইরে নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে স্লোগান-মিছিল হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কেন নোবেল পেলেন না। আমাদের সামগ্রিক জাতীয় সচেতনতায় এটি ছোট্ট একটি উদাহরণমাত্র, দুঃখ পেলেও দোষারোপ করি না।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনীতি নয়, বরং আমাদের নির্লিপ্ততা। কিন্তু আশার ব্যাপার, নির্লিপ্ত হলেও শান্তিকামী আশাবাদী মানুষ আমরা। যারা মারা গেছেন, তারা আর ফিরে আসবেন না কোনোদিন। ব্লগে বা আসরে তীব্র ঝড় তুলে কয়েক দিন পর ভুলে যাওয়া স্বভাব আমাদের, এ-ও বড় হতাশার। বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করাও সহজ কাজ নয়, তাই আমি ঠিক করেছি আমার গ্রাম নিয়ে অন্ততঃ দুটি কাজ করব:
১. যারা দেশের বাইরে আছেন, তাদের নিয়ে একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করব।
২. আগামী বছর থেকে কিছু বৃত্তির চালু করব গ্রামে, যাতে শিশুকিশোরদের সমাজসচেতনতা ও নেতৃত্বের বিষয়টি একটি বড় নিয়ামক হবে।
কিছুদিন আগে নরওয়েজিয়ান এক ভদ্রলোকের সাথে প্রথম দেখা, তিনি যখন শুনলেন আমি বাংলাদেশী, কিছুটা অবাক ও উজ্জ্বল হলো তাঁর চেহারা। তারপর বললেন, "আমি শুনেছি তোমরা বাংলাদেশীরা খুব মেধাবী!" তিনি কিছু উদাহরণও দিলেন।
১ ও ২-এর সাথে আমার ৩নং কাজটি হবে, জাতি হিসেবে নিজেদেরকে আরেকটু বেশি শ্রদ্ধা করা, মূল্যবান ভাবা।