দজলা-ফোরাতের অববাহিকায় গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার বিস্ময়কর প্রাচীন পৃথিবী, হাজার হাজার বছর ধরে অদম্য কৌতূহল জাগিয়ে যায় আমাদের—কী বলে গেছে অতীতের মানুষেরা? রাজা-রাণীদের রোমাঞ্চকর সমরগাঁথা, গ্রহ-নক্ষত্রে বিচরণকারী দেব-দেবীদের সভাকার্য, মৃত্যু-দরিয়া অতিক্রমের গল্প, নাকি সাধারণ মানুষের আনন্দ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বঞ্চনা-দ্রোহের কথা?
কিন্তু সুমের, আক্কাদ আর ব্যাবিলনের এসব মানুষেরা বলে গেছে তাদের কথা কীলকলিখন (cuneiform) লিপিতে, রহস্যময় এক ভাষা, চিত্র যেখানে কাজ করে ধ্বনির। ধীরে ধীরে একদিন হারিয়েও যায় তারা, মাটির নীচে চাপা পড়ে তাদের ভাষা।
না, একেবারে হারিয়ে যায় না! বাইবেলে বর্ণিত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের বিখ্যাত সম্রাট প্রথম দারিয়ুস, অধীনস্থ করেন হিব্রুভাষীসহ বহু জনগোষ্ঠিকে। নিজের বংশলতিকা ও বিজয়াভিযান কীলকলিখন ভাষায় উৎকীর্ণ করে রাখেন পারস্যরাজ, পশ্চিম পারস্যের বেহিস্তুনে জাগরোজ পর্বতমালার শৈলচূড়ায়। আর কেউ যাতে কোনোদিন তার কীর্তিকে বিনাশ করতে না পারে, তাই পাহাড়ের ধারগুলো কেটে দেন তিনি। আড়াই হাজার বছর ধরে মানুষ দূর থেকে অবলোকন করে গেছে এ লিপি, কিন্তু জানতে পারেনি কী লিখে গেছেন পারস্যরাজ পাহাড় চূড়ায়।
প্রাচীন পার্সি, এলুমাইট এবং কিউনিফর্মের ব্যাবিলনীয় রূপে বেহিস্তুন শিলালিপি
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্যার হেনরী রলিনসন নামে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একজন সেনাকর্মকর্তা পারস্যে শাহের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে গিয়ে খুঁজে পান রহস্যময় এ শিলালিপি। পরবর্তী চার বছর, পাহাড়ের সঙ্কীর্ণ অরক্ষিত কিনারায় দাঁড়িয়ে জীবনের উপর হুমকি নিয়ে, শিলালিপিগুলো নকল করেন তিনি। সম্পূর্ণ নকলকাজ শেষ হবার পর, যা লিখা ছিল প্রাচীন পার্সি, এলুমাইট এবং ব্যাবিলনীয় ভাষায়, রলিনসন প্রথমে পার্সি লিপির পাঠোদ্ধার করেন যেহেতু তার জানা ভাষার সাথে এর ছিল সবচেয়ে বেশি মিল। পরে আরো কিছু ভাষাবিদের সহায়তায় এলুমাইট এবং ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্ম ভাষারও পাঠোদ্ধার হয়, যদিও তুলনামূলকভাবে অনেক দুরূহ ছিল সেগুলো।
পরবর্তী বছরগুলোতে আমাদের চোখের সামনে একের পর এক উদ্ভাসিত হতে থাকে গৌরবময় এক সভ্যতা, যা আমাদের দান করেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখনপদ্ধতি, সভ্যতাকে বেগবানকারী যন্ত্র চাকা, নগররাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সংখ্যাতত্ত্বে শূন্যের ব্যবহার।
এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে, প্রাচীন উর নগরীর ধ্বংসস্তুপে, মর্মরসদৃশ নরম কালো পাথরের এক চাকতিতে, আমরা জানতে পারি রাজকীয় এক নারীর কথা—এন-হেদু-আনা, যার অর্থ আন-এর রমণীয় অলঙ্কার বা আন-এর উচ্চ যাজকীয় অলঙ্কার; আন সুমের-ব্যাবিলনীয় পুরাণের আকাশদেব। এনহেদুয়ানা অবশ্য নারীটির আসল কিংবা জন্ম নাম নয়, একটি উপাধি, আর আসল নামটি হারিয়ে গেছে, কিংবা হয়তো লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গর্ভে। পাথরের চাকতিটিতে কীলকলিখনে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে: নান্নার স্ত্রী এবং পৃথিবীর রাজা সারগনের কন্যা।
এনহেদুয়ানার চিত্রখচিত চাকতি; সবচেয়ে দীর্ঘাঙ্গী নারীটি তিনি
২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে কীশ নগরীর রাজপ্রাসাদের সামান্য পেয়ালাবাহক থেকে ধীরে ধীরে পরাক্রমশালী এক সম্রাট হয়ে উঠেন আক্কাদের সারগন (Sargon of Akkad), ধীরে ধীরে দখল করে নেন দক্ষিণে অবস্থিত সুমেরের নগর রাষ্ট্রসমূহ, উরুক, উর, লাগাশ, উম্মা, এবং একসময় পৌঁছে যান নিম্ন সাগরের (Persian Gulf) কাছে, পানিতে তরবারি নিমজ্জিত করে উত্তোলন করেন মাথার উপর—সুমেরের বিজয় সম্পন্ন হলো।
আক্কাদের রাজা প্রথম সারগন (সম্ভবত)
সারগন এবার দৃষ্টি প্রসারিত করেন উত্তর ও পূর্বে উচ্চ সাগরের (Mediterranean Sea) দিকে, আর তখন জটিল এক সমস্যা এসে পথ রোধ করে তার: আক্কাদ ও সূমের, ভিন্ন দুই জাতি, ভিন্ন তাদের ভাষা, অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে—কার তত্ত্বাবধানে রেখে যাবেন বিশাল বিবদমান এ সাম্রাজ্য।
এগিয়ে আসেন সারগনের তরুণী কন্যা এনহেদুয়ানা, জানেন তিনি রঙ-বর্ণ-ভাষা ভিন্ন হলেও আত্মিক বন্ধন মানুষকে নিয়ে আসে কাছাকাছি, শত্রুকে করে বন্ধু। আক্কাদের দেবী ইশতার, সুমেরের দেবী ইনান্নাকে একীভূত করেন তিনি, দায়িত্ব নেন উর নগরীতে ইনান্নার পিতা চন্দ্রদেব নান্নার মন্দিরে উচ্চ যাজিকা'র (High Priestess)। পরবর্তী ৫০০ বছর মেসোপটেমিয়ার মানচিত্রে, সম্রাটদের রাজনীতিতে, এবং গণমানুষের জীবনাচরণে বিশাল প্রভাব রাখে এনহেদুয়ানা ও তার উত্তরসূরী এসব উচ্চ যাজিকাগণ।
এবং এনহেদুয়ানা, বেঁচেছিলেন যিনি শেক্সপিয়ারের জন্মের প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বে, গ্রিক গীতিকবি স্যাফো'র ১৭০০ বছর এবং চারণকবি হোমারের ১৫০০ বছর পূর্বে, রচনা করে গেছেন অনন্য ভাষা শৈলী ও শব্দচয়নে চমৎকার অনেক কবিতা, ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত, যুগ যুগ ধরে মেসোপটেমীয়ার বিদ্যালয় (edubba) ও উপাসনালয়গুলিতে লেখকরা যা পাঠ করে যেত গভীর ভক্তিতে, এবং এখনও বিস্ময় জাগিয়ে যায় আমাদের।
এনহেদুয়ানা—এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ইতিহাসে, বিশ্বের প্রথম কবি, যাকে চেনা যায় নাম ধরে, উত্তম পুরুষে প্রথম কবিতা লেখার কৃতিত্বও যার।
এনহেদুয়ানার কবিতা
১। নিন-মে-সার-রা (ইনান্নার পরমানন্দ)
২। ইন-নিন-সা-গুর-রা (দৃঢ় আত্মার নারী)
৩। ইন-নিন-মে-হুস-আ (ইনান্না ও এবি)
৪। এ-উ-নির (মন্দির গীতি)
৫। এ-উ-গিম-এ-আ (নান্না গীতি)
৬। এনহেদুয়ানার প্রশংসা গাঁথা
সারগনের বংশ ধারা
তথ্যসূত্রঃ
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Enheduanna
http://www.angelfire.com/mi/enheduanna/
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৭:০৪