সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রস্তুতি নিন বিএনপির আলোচনা সভায় আহবান
স্টাফ রিপোর্টার
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ড. আরএ গনি দলীয় চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুতি গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।
আইন-অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারান্তরীণ রাখাকে মানসিক নির্যাতন অভিহিত করে তিনি বলেন, এ ধরনের নির্যাতন মানবাধিকারের চরম লংঘন।
ড. গনি দলের মূল স্রোত থেকে ছিটকে পড়া নেতাদের উদ্দেশে বলেন, এখনো সময় আছে সঠিক পথে ফিরে আসুন। কারণ দুর্দিনে বেঈমানী করলে তা কেউ সহ্য করবে না।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির উদ্যোগে গতকাল বুধবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আসম হান্নান শাহ, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বেগম সেলিমা রহমান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও অধ্যাপক এমএ মান্নান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ, প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ শাহজাহান, সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট একেএম মজিবর রহমান, সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান কবির মুরাদ, জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শামসুজ্জামান দুদু, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মিয়া মোঃ সেলিম, ঢাকা মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি আবু সাঈদ খান খোকন, জাসাসের সভাপতি এমএ মালেক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা খোন্দকার বাবুল চৌধুরী ও হাবিব উন নবী খান সোহেল, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, মুক্তিযোদ্ধা দলের সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, মহিলা দল নেত্রী শিরিন সুলতানা, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মীর শরাফত আলী সপু, শ্রমিক দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও মাওলানা শাহ মোহাম্মদ নেছারুল হক বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিএনপির দফতর সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস রিজভী আহমদ।
ড. আর এ গনি আক্ষেপ করে বলেন, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দু পুত্র আজ বিনা বিচারে কারান্তরীণ রয়েছেন। এ অন্যায় দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের শক্তিই বড় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ শক্তি জেগে উঠলে তাদের দমন করার সাধ্য কারো থাকবে না। সে জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। যারা দেশের ও জাতীয় উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ও দলীয় ভিত্তিক ঐক্যছাড়া মুক্তির পথ নেই। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির জন্য উদ্যম ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসায় তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।
আসম হান্নান শাহ বলেন, আইনী প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করি বলেই ভদ্রভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু সরকার আমাদের আহবানে সাড়া দেয়নি। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সা¤প্রতিক দেয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ট্রুথ কমিশন করা হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু দু নেত্রী সরকারের কাছে ক্ষমা চাননি। ক্ষমা চাওয়ার মতো কোনো অপরাধও তারা করেননি।
তিনি বর্তমান সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ট্রুথ কমিশনের সামনে হাজির হওয়ার জন্য আপনারাও তৈরি হোন। কার ডাক আসে তা তো বলা যায় না। জনাব হান্নান শাহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করে বলেন, সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ এ সরকারকে জনগণ একদিনের জন্যও ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
কাজেই অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। অন্যথায় স্বৈরাচারী এরশাদের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ করা হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। মিথ্যা অপবাদ না দিয়ে অবিলম্বে খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান।
বেগম সেলিমা রহমান বলেন, সরকার জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে নেতাকর্মীরা তাদের পথ বেছে নিবে। তিনি বলেন, দেশের মানুষ আজ শৃংখলিত। আন্তর্জাতিক চক্রান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। লাখো মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জরুরি আইনে নয় গণতন্ত্রের মুক্ত চর্চার জন্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই জরুরি আইনের দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক ও স্থপতি অভিহিত করে বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য যে এ দু নেতার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও স্বাধীনতা দিবস জেলে কাটাচ্ছেন। এর জবাব সরকারকে একদিন দিতে হবে। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই পা ভেঙে দেয়া, কোমর ভেঙে দেয়ার নিয়ম সংবিধানের কোথায় আছে তাও ড. ফখরুদ্দীনকে দিতে হবে।
বাবু গয়েশ্বর ড. কামাল হোসেন গংদের জাতীয় বেঈমান অভিহিত করে বলেন, এসব বেঈমান আজ জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। অথচ জাতীয় সরকারের কথা সংবিধানের কোথাও নেই। এ জ্ঞানপাপীরা অনেকবার ভোটে দাঁড়িয়ে জামানতও হারিয়েছে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তারা জাতীয় সরকারের কথা বলছে। তাদের অনেক পরিশ্রমের ফসল ১১ জানুয়ারির বদৌলতে এবং জাতীয় সরকারের ফলে ভালো একটা পদ-পদবী পাওয়া যাবে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে ড. কামালদের মতো দালালদের প্রতিষ্ঠা করাই ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অপরাধ।
তিনি বলেন, দু নেত্রী ড. ফখরুদ্দীনের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি নেয়ার মতো কোনো পাপ করেননি। সময় খুব দূরে নয়- ক্ষমা আপনাদেরই চাইতে হতে পারে।
বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র মূল স্রোত থেকে ছিটকেপড়া নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা নিজেদের সবল ভাববেন না। জরুরি আইন তুলে নিলে কতো সবল তা বোঝা যাবে। তবে নেত্রী যখন ক্ষমা ঘোষণার আশ্বাস দিয়েছেন তখন ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করুন।
দল না করে এমপি হওয়া যায়। কিন্তু পরিশ্রম ছাড়া বিএনপি নেতা হওয়া খুবই কঠিন। তিনি বলেন, বুটের তলা থেকে একবার যে গণতন্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেই গণতন্ত্রকে আবার কারো বুটের তলায় যেতে দেয়া হবে না।
অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, সরকার অনেক বড় বড় আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতা নিলেও সে আশ্বাস পূরণে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অতীত ইতিহাস এবং নিকট অতীতে পাকিস্তানের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়ে বলেন, নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না। কেউ না চাইলেও আন্দোলন তার আপন গতিতেই বেগবান হবে।
শওকত মাহমুদ বলেন, দেশে কখনো কখনো সামরিক শাসন, জরুরি আইন জারি থাকলেও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা স্তিমিত হয়নি। বিভিন্ন কারণে দেশের মানুষ ১১ জানুয়ারিকে স্বাগত জানিয়ে থাকলেও পরবর্তী কর্মকাণ্ড সকলকে হতাশ করেছে। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনের আগে সামরিক বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারের বিরোধিতা করেছিল তারা আজ নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। দেশের মানুষ রাজনীতিকদের মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক সমাজ দেখতে চায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান বলেন, স্বাধীনতার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে সবসময় একটা ফারাক ছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সেই ফারাক দূর করার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জনগণও তার সুফল পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু চক্রান্তকারীরা তাঁকে বেশিদিন টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ’৯১ সাল থেকে ২০০৬ সালের অর্থনেতিক পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, এ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কারণ প্রতিনিধিত্বশীল সরকারই উন্নয়ন করতে পারে। প্রফেসর সলিমুল্লাহ বলেন, দেশের মানুষ চায় রাজনীতিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার আলাপ-আলোচনা। তারা মাইনাস ফর্মুলায় বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না জাতীয় সরকারের পদ্ধতিতে।
মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, দেশের মানুষ যেভাবে জেগে উঠেছে তাতে বেগম খালেদা জিয়াকে আর বেশিদিন কারাগারে আটক রাখা সম্ভব হবে না। ছোট শিশুদের গান গেয়ে ঘুম পাড়ানোর মতো সরকার দেশের মানুষকে অনেক কথা বলে ঘুমিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানুষের আজ সেই ঘুম ভেঙেছে।
নেত্রীর মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেয়া হলে তার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরে যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।