আসুন, মৃত বিবেকের জন্য শোক প্রস্তাব পাঠ করি
*আমীর খসরু*
মাত্র এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত হলো এফবিসিসিআই নির্বাচন। ওই নির্বাচন উপলক্ষে সাজ সাজ রব ছিল। ছিল তাদের সদস্যসহ অনেকেরই উপস্থিতি। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদাও গিয়ে ভোট কিভাবে হওয়া উচিত এমন নসিহত দিলেন ওই নির্বাচনটি দেখে। বলে এলেন একদিনেই দুই নির্বাচন অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় কিনাÑ সে সম্পর্কে। কিন্তু সাতদিন পার হতে না হতেই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে দেখা গেল ভিন্ন পরিস্থিতি এবং আচরণ। ওই নির্বাচনের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। জরুরি অবস্থার বিধিবিধান ভঙ্গ হবে এমন যুক্তি এবং অনুমতি নেয়া হয়নি এমন কারণ দেখিয়ে নির্বাচন হতে দেয়া হলো না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে বললেন, তারা শুধু নির্বাচন করবেন। কোন সভা-সমাবেশ করবেন নাÑবিধি ভঙ্গ করবেন না। কিন্তু তারপরেও পারলেন না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো না। তাহলে জরুরি অবস্থা কি পক্ষপাতমূলক? কেউ না বললেও একথা আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের পক্ষে হলে জরুরি অবস্থার বিধিমালা শিথিল হয়ে যায়, আর পছন্দমাফিক না হলে জরুরি অবস্থা বহাল থাকে। আমি আগে মানবজমিন-এ লিখেছিলাম, এই সরকার না নির্দলীয়, না তত্ত্বাবধায়ক। সে কথা বারবার যে প্রমাণিত হয় এবং হবেÑতা আবারও প্রমাণিত হলো। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ পাচ্ছে না, এমনকি একযোগে নেতাকর্মী নিয়ে কোন ঘরেও বৈঠক করতে পারছে নাÑ তাদের পছন্দ না হলে। আবার এর বিপরীতে তাদের গড়া দল সভা-সমাবেশ করছে, করছে রীতিমতো সাংগঠনিক সফর। জরুরি অবস্থার মধ্যে পিডিপি গঠিত হয়েছে এবং তারা এখন সভা-সমাবেশ করছে। জেলা সফরও তারা করেছেন স্বাভাবিক নিয়মে। জরুরি অবস্থা যে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, সমানভাবে ব্যবহৃত নয়Ñতার প্রমাণ সেদিনই মিলেছে যেদিন জেলা শহরগুলোতে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহকারে মাইক ব্যবহার করে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। ওইসব মিছিল, শোভাযাত্রায় কেন অনুমতির প্রয়োজন হয়নি? কারণ তারা সরকারের পক্ষে বলে। কথা ছিল এবং সংবিধান অনুযায়ী (যদিও এক্ষেত্রে আমার ভিন্নমত আছে) তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ হতে বাধ্য। কিন্তু একথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার একটি রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবেই কাজ করছে। যদি তা-ই না হয়ে থাকবে তাহলে কল্যাণ পার্টির নামে এই খোদ রাজধানী ঢাকায় তাদের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানটি কিভাবে একটি ছোটখাটো জনসভায় রূপ নিয়েছিল? সেদিন অনুমতির তোয়াক্কাও করতে হয়নি। কারণ তারা পক্ষের। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ছোটখাটো গোলটেবিল বৈঠক শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কারা এসে ভেঙে দেয়? এরা কারা? সবাই জানলেও বলেন না। আমিও জানি, কিন্তু বলতে পারছি না।
সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন অনুষ্ঠানটি আদায় করতে বহু দেন-দরবার করতে হয়েছে গত রোববার দুপুর থেকে। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গুলশানে ‘নিরপেক্ষ স্থান’ হিসেবে এক বিশেষ অফিসে বৈঠকে বসতে হয়েছে। বৈঠকে অংশ নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের(?) আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফ, এটর্নি জেনারেল ফিদা এম. কামাল এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি আমীর-উল ইসলাম সেখানে গিয়েছিলেন। এদের জন্য করুণা হয়। কারণ তারা ‘নিরপেক্ষ স্থান’ হিসেবে আইন উপদেষ্টার অফিসকে বেছে নিতে পারতেন। বেছে নিতে পারতেন এটর্নি জেনারেলের অফিস কিংবা সুপ্রিম কোর্টের এতগুলো কক্ষের যে কোন একটি। কিন্তু তা না করে তারা গেলেন ‘নিরপেক্ষ স্থানে’। আর গেলেনই বা কেন? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না বা কবে অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়ে আলোচনার জন্য আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফই কি যথেষ্ট নন? তাহলে কি ধরে নিতে হবে হাসান আরিফরা ক্ষমতাহীন, অসহায়? প্রধান উপদেষ্টা সহ সরকারের বেসামরিক অংশের পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হয়, ওয়াদা করা হয়, অঙ্গীকারের কথা শোনানো হয়- তার কোনই গুরুত্ব নেই? নাকি তাদের যা বলতে বলা হয় তাই তারা বলেন? বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠানে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। একটি পক্ষ সরকার, অন্যটি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি- তা আমরা জানি। কিন্তু তৃতীয় পক্ষটি কারা? জাতীয় সরকার গঠনের নামে কতিপয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কারা এখনও করছেন এবং করেছেন? এসব ঘটনা এই নতুন নয়Ñ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনার সময়ও আমরা একই পরিস্থিতি দেখেছি। এসব ঘটনা বড় বলেই আমাদের অনেকেরই হয়তো নজরে এসেছে। কিন্তু ছোটখাটো যে কত ঘটনা ঘটছে তার ইয়ত্তা নেই। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান কিভাবে হবে, এসব অনুষ্ঠানে কারা অংশ নেবেন এবং যারা অংশ নেবেন তারাও কি বলবেন, তা-ও যখন বলে দেয়া হচ্ছে ‘কঠিন অবশ্য পালনীয় বাণী’ হিসেবে- তখন আমরা বড়ই দুঃখবোধ করি। কিন্তু আশ্চর্যান্বিত হই না। কারণ বরাবরই আমরা বলে এসেছিÑ সরকারের ক্ষমতার মূলভিত্তি এবং কেন্দ্রবিন্দু অন্যত্র।
যখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হলো, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো- তখন জাতির বিবেক ড. কামাল হোসেনরা কোথায়? এখন তারা আইনের শাসন, সংবিধান, গণতন্ত্রের কথা বলছেন না কেন? আমি ইতিপূর্বে এই মানবজমিন-এর এক লেখায় ‘বিবেক প্রতিবন্ধী’ কিছু মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি এই সমাজে শুধু বিবেক প্রতিবন্ধীরাই নেইÑ অনেকের বিবেক ইন্তেকাল করেছে। তাই আসুন আমরা বিবেক প্রতিবন্ধীদের আরোগ্য কামনা করি এবং মৃত বিবেকের জন্য শোক প্রস্তাব পাঠ করি। তার আগে একটি প্রশ্ন করি- হচ্ছেটা কি? আমরা যাচ্ছি কোথায় এবং আছিই বা কিসের মধ্যে?
আমীর খসরু, বিশ্লেষক