= বদিউল সাহেবের রোজাটা টিকবে তো? =
সিয়াম সাধনার এ পবিত্র মাসে অফিস সময় সংক্ষিপ্ত। তাই, অন্য সবার মতো বদিউল সাহেবও সচরাচর অফিস হতে বাসায় ফিরে খোশ মেজাজে থাকেন। কিন্তু, আজ তাঁর মন কেমন যেন উথলা। উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করে চলেছেন ঘরময়।
দীর্ঘ বাইশ বছরের সংসার জীবনে সহধর্মিনী তসলিমা বেগমের চোখ এড়ায়নি বদিউলের এ অস্বাভাবিক আচরণ। ফলে, তিনি নিজেও দুশ্চিন্তায় পড়লেন।
- মিশুর বাবা, কি হলো তোমার আজ? এমন অস্থির পায়চারি করছো কেন? অফিসে কি খারাপ কিছু হয়েছে?
বদিউল এড়িয়ে যান। কোন কারণে মন খারাপ বা দ্বিধাগ্রস্থ হলে মানুষ অনেকসময় কারো সাথে কথা বলতে চায় না। জোহরের নামাজ পড়তে ওযু করার সময় অফিসে যে বিশেষ ঘটনাটি ঘটেছে তা নিয়ে চুপচাপ ভাবতে থাকেন তিনি।
বদিউল তাঁর অফিসে নির্বিবাদী সৎ কর্মকর্তা বলে পরিচিত। এতো দীর্ঘ চাকুরী জীবনে তিনি কারো ফাইল আটকে জবরদস্তি অর্থ আদায় করেছেন বলে জনশ্রুতি নেই। তাঁর স্বাক্ষরের জন্য আসা প্রতিটি ফাইলে তাঁর ভাগের এক হাজার টাকা 'নিয়মানুযায়ী' তাঁর নামে অফিস সহকারী জামিল সাহেবের কাছে জমা হয়। নিয়মটা কে কবে ঠিক করে দিয়েছে তা তাঁর জানা নেই। জানার দরকারও বা কি? এই নিয়মে তাঁর কোন ক্ষতি তো আর হচ্ছে না!
নিয়ম মেনেই দিনশেষে হাজার তিরিশেক টাকা উপরি আয় হয়ে যায়। জামিল সাহেব টাকাটা সমান তিন ভাগ করে তিন বান্ডিলে কর্মদিবস শেষে স্যারের (বদিউল) হাতে তুলে দেন। বদিউল ঘুষ-দুর্নীতির বিপক্ষে বলে কখনও নিজ হাতে কারো কাছ থেকে উপরির টাকা গ্রহণ করেননি। হাশরের ময়দানে যেন নিজের দুটি হাত তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয় তা ভেবেই এ ব্যবস্থা।
তিন বান্ডিলের একটি তিনি অফিসে তাঁর গোপন সেইফে জমা রাখেন। বাকি দুটি বান্ডিল বাসায় নিয়ে তসলিমা বেগমের হাতে তুলে দেন। এভাবে, বেতনের বাইরে আহরিত অর্থের সিংহভাগই যায় তসলিমার পকেটে। তসলিমা ওই টাকা হতে সামান্য কিছু বদিউল সাহেবকে হাত খরচের জন্য দেন। বাকি টাকা তাঁর একমাত্র ভাই কানাডার নাগরিক শাহেদের কাছে পাঠিয়ে দেন। শাহেদ তাঁর খরচের টাকাটা রেখে বোন তসলিমাকে ডলারে বাকি টাকা 'উপহার' হিসেবে পাঠিয়ে দেন।
বদিউলের চালচলনে অস্বাভাবিকতা কমছে না দেখে তসলিমা আরেকবার জোর দিয়ে জানতে চান, 'বলোতো তো মিশুর বাবা, তোমার হয়েছেটা কি? বেশি খারাপ লাগলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো; খুলে বলো তোমার কেমন লাগছে?'
- আজকের রোজাটা মনে হয় কবুল হবে না তসলিমা। হাশরের দিন কি জবাব দেব আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে তা নিয়েই ভাবছি।
- কেন, রোজা টিকবে না কেন? কি হয়েছে তোমার? বিশেষ অঙ্গ দিয়ে কিছু ...
- আরে না, তোমার শুধু বাজে চিন্তা। ... জোহরের নামাজের ওযু করার সময় কুলকুচি করতে গিয়ে ভুলে অনেকখানি জল গিলে ফেলেছি। পেটে পানিটা একটু বেশিই ঢুকেছে। সেই থেকে টেনশনে আছি, ভীষণ টেনশনে, রোজাটা টিকবে তো? সামনের বছর যে রোজা রাখার সুযোগ পাবো তার তো কোন গ্যারান্টি নেই। দেখলে না, কত অল্প বয়সে রফিক সাহেব চলে গেলেন!
- অসাবধানতায় সামান্য পানি গিলেছো, তা নিয়ে এতো টেনশনের কি আছে? তুমি ইচ্ছে করে তো আর পানি গেলোনি!
- তোমাকে বুঝাতে পারবো না তসলিমা বেগম, যাও যাও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও, একটু প্রায়শ্চিত্ত করি। রোজার গুরুত্ব তুমি আর কি বুঝবে, তুমি রান্নাঘরের মানুষ? যাও, রান্না ঘরে যাও।
বদিউলের বাড়াবাড়ি তসলিমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। সত্য হলো, তসলিমা কোন অর্থেই বদিউলের চেয়ে কম রোজাদার নন। মাসিকের কারণে যে কটা রোজা ছেড়ে দিতে হয় তাও ঈদের পরপর পুরিয়ে দেন। সেই, পাকা রোজাদার তসলিমাকেই কিনা তাচ্ছিল্য করে রোজার গুরুত্ব বুঝানোর চেষ্টা। তা কি মেনে নেয়া যায়?
তসলিমাও বদিউলকে দু'কথা শুনিয়ে দিলেন: 'এই রোজা-রমজানের দিনে ঘুষের টাকার দু'দুটি মোটাসোটা বান্ডিল জেনেবুঝে গিলেও তোমার কোন অনুতাপ নাই, আর ওদিকে, অসাবধানতায় সামান্য পানি গেলাতেই যত সমস্যা; তামাশা আর কতো দেখবো এই এক জীবনে? তোমার পাগলামো আর গেল না মিশুর বাবা। ...
কথাগুলো বলতে বলতে তসলিমা থরথর করে রান্নাঘর অভিমুখে রওনা দিলেন।
https://www.facebook.com/moh.l.gani/
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ১২:২২