ছোটবোনের নিজ হাতে লাগান গাছের ফুল , তার মেলবোর্নের বাড়ীতে ।
একজন সেদিন ফোনে বলল মেলবোর্ন থেকে , ' জানেন আপা , আজ মনাশ ইউনিভার্সিটির জাপানী ছাত্র কাঁদছে , আমেরিকান ছাত্র কাঁদছে , গতকাল ইকোনোমেট্রিক্স এন্ড বিজনেস ফ্যাকাল্টির ক্লাস সাসপেন্ড ছিল তাহেরা পারভীনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে । তাকে যারা চিনত , ভালবাসত । অনেক জনপ্রিয় ছিল সে । '
শুনতে হল " ছিল সে " ।
শুনছি শেষদিন আম্মার সাথে একঘন্টারও বেশী কথা বলেছিল সে , অনেক হাসি ঠাট্টা ; প্রতিদিন যেমন বলত । সাত সন্তানের কনিষ্ঠ কন্যা ছিল সে , ছিল আম্মার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু , আম্মার সেবিকা ।
তাই আম্মাজী সেদিন সবার মাঝে বসে বলেছিলেন ,' তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমার কুটন ( আম্মা তাকে এই নামে ডাকতেন )তার আব্বার পাশে থাকবে চিরকালের , তার ঐপাশে আমি ; সবার ছোট তো , বাবা-মায়ের কোলের মধ্যে থাকবে সে '। আমি বললাম , " আম্মা দেখেন আপনার ছোট মেয়ে কেমন চালাকী করে সবার আগে ভাল জায়াটা দখল করে নিল " ।
আম্মার মতের সাথে সহমত আমাদের সবার ।
তাই হয়েছে , আমাদের অসম্ভব কষ্টের মধ্যে ফেলে সে দ্রুত চলে গেল , আব্বাজীর পাশে চিরশান্তির ঠিকানা খুঁজে নিল ।
হঠাৎ মনে পড়ল , ও যেখানে ঘুমিয়ে আছে অনেকদিন আগে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল ঐখানে , এখন নেই । নেই আর নেই ; চারিদিকে কি বিষম শূন্যতা , হাহাকার ! এত মানুষ আছে তবু মনে হয় ফাঁকা সব , সবকিছু ফাঁকি , জীবন ফাঁকি --- মিথ্যা , ছলনা । মরনটাই সত্য । তা না হলে কেন সে সেখানেই গেল সব ছেড়ে ?
মনে পড়ছে কত কিছু । ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে পড়বার সময় শিক্ষা সফরে কক্সবাজার গিয়েছিল একবার , সেখানে বসে আমাকে লিখেছিল চিঠি । একটা লাইন ছিল , " এখানে এসে মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামের বাড়ীটা এর চেয়ে অনেক সুন্দর ! " তার ভাল লাগা প্রিয় জায়গায় শেষ ঠিকানা বেছে নিল সে । পৃথিবীর এত জায়গা ছেড়ে জীবনের মায়া এড়িয়ে অল্প বয়সে ।
গত ১৪ই আগষ্ট মেলবোর্নে দুর্ঘটনায় চলে গেছে সে মৃত্যুর পরপারে আকস্মিক ভাবে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ....... রাজেউন । যেখান থেকে শত ডাকেও আর সাড়া দেয় না সে ; কেউ দেয়না , দিতে পারে না । তা না হলে আমাদের বুক ফাটা আর্তনাদে সে কি ছুটে আসত না ।
মনাশ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল সে , সামনের বছরের জুনে শেষ হবার কথা ছিল । আম্মাকে বলেছিল , " আমি আপনার জন্য আমার পিএইচডির সার্টিফিকেট নিয়ে আসব , দেখবেন কত্ত খুশী লাগবে আপনার " । সেই সার্টিফিকেটের পরিবর্তে এল এক নিষ্ঠুর সংবাদ ।
আমাদের জন্য এক চরম বাস্তবতা , অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা ।
আগে একবার মনাশে এম এস করতে পাঠিয়েছিল তাকে মন্ত্রনালয়ে চাকুরীর শুরুতে । ২০০০ বা ২০০১ সালে মনাশ অ্যাওয়ার্ড দেবে বলে তাকে যখন নিমন্ত্রনপত্র দিয়েছিল , সে জানিয়েছিল যে সে বাংলাদেশ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা , সে তো আর কোথাও কোনকিছুর জন্য এ্যাপ্লাই করে নি । জবাবে কতৃপক্ষ জানিয়েছিল , কেন্দ্রীয়ভাবে তাকে খুঁজে বের করেছে তারা । সেবার বেস্ট স্টুডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করেছিল ছিপছিপে গড়নের , শ্যামলা বাঙালী মেয়েটি , ছোট বোনটি আমার ।
মনে পড়ে ১৮ তম বি সি এস এর সময় তার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে , রেজাল্ট হয় নি , আমার আগ্রহে সে পরীক্ষা দিতে যায় এবং তার মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট হবার কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রনালয়ে তার পোষ্টিং হয়ে যায় । ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হয়ে বের হয় সে । সেখানে সে জনপ্রিয় ছিল সেটাও জানতাম ।
সে মেধাবী ছিল , তাই মনাশ থেকে ফেরার পর তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করবার পরে আবার পিএইচডি করবার অনুমতি পেয়েছিল সে কয়েকবছরের মধ্য । বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিল সে পদমর্যাদায় । অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে সে এসব অর্জন করেছিল নিজ যোগ্যতায় , পরিশ্রমে এবং আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ।
সব কিছু সে আগে ভাগে করতে চেয়েছে , পেরেছেও । তার হয়তো যাবার তাড়া ছিল , আমরা বুঝতে পারি নি । ও কি বুঝেছিল ?
সবার ছোট হয়ে ও চলে গেল সবার আগে ।
" ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে ,
সেই দিয়েছে সকল শূণ্য করে "
--- ছোটবেলায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ' ছিন্নমুকুল ' কবিতা পড়ে কবির এমন অস্বাভাবিক চিন্তায় বিরক্ত হয়েছিলাম । মন খারাপ হত বলে এড়িয়ে যেতাম বাড়ীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের বিয়োগব্যথা নিয়ে লেখা এই কবিতা । আর আজ ? এই কবিতাটাই আমাদের পরিবারের চিত্র হয়ে গেল ।
সব খানে তার ছোঁয়া । বাড়ীর সবচেয়ে ছোট বলে আদরের ছিল , তার আদর পাবার বিশেষ যোগ্যতা ছিল । বাড়ীর বড় সন্তানের মত দায়িত্ব পালন করত , মধ্যমনি ছিল সে ।
মনটা খুব নরম ছিল , অনেক বড় হয়েও মুরগীর গোসত খেত না । যে কোন জীবের জন্য তার মায়া ছিল । মেলবোর্ণের বাড়ীতে আছে তার আদরের টিনটিন , যাকে ছেড়ে সে অন্যত্র থাকত না , টিনটিনের যদি কষ্ট হয় এই কথা ভেবে । এখন কি করে থাকছে টিনটিনকে ছেড়ে ?
বলেছিল আম্মাকে , " আম্মা ,আমি চাইলে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারব , চাই না সেটা । আমি দেশে ফিরব , সাধারন মানুষের মত অল্প টাকাতে চলব ।" ওর বরের প্রবাসী জীবনের জন্য আগ্রহ ছিল , ওর ছিল না । গল্প করতো , লেখাপড়ার চাপের মধ্যে হালাল - হারাম বেছে খেতে সময় বের করতে ওর কষ্ট হোত । ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলত যেখানেই থাকতো । আমাদের পরিবারের মধ্যে উজ্জলতম ছিল সে , সর্বাঙ্গীন সুন্দর ছিল তার জীবন , জীবনবোধ । তার মৃত্যুর পর শুনছি তার অফিসের অন্যদের মুখে . " মেধাবী এই মেয়েটি মানুষ হিসেবে ছিল অপূর্ব "। অনেক ভাল ভাল কথা শুনছি , শুনে খুশী হবার পরিবর্তে আফসোস হচ্ছে । মনে হচ্ছে যদি দেশে থাকত , ডিগ্রীর জন্য না যেত এবার হয়তো কাছে থাকত আমাদের । হয়তো অন্যরকম হোত দৃশ্যপট । বিধাতা ভাল জানে ।
অনেক কথা মনে পড়ছে । আমি আর ও পিঠাপিঠি বোন , অতীতের অনেক সুখ-দু:খ ভাগাভাগি আমাদের । একটা পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।
ভাবতে পারছি না , ও নেই , ওকে দেখব না আর । আম্মার গলা জড়িয়ে ধরবে না দৌড়ে এসে ! আম্মার হাতে বানান চকলেটের জন্য পীড়াপীড়ি করবে না আর । অনেক কিছু মনে আসছে , লেখার শক্তি পাচ্ছি না । ও সাথে করে নিয়ে গেছে আমাদের আনন্দ, হাসি , গান ,বেঁচে থাকবার স্বাভাবিক শক্তি ।
এয়ারপোর্টে কেউ এলে খুশীমনে তাকে স্বাগত জানাতে গিয়েছি আগে । আর এবার এয়ারপোর্টে ? এবার যা পেলাম .........
এবার যা পেলাম তা যেন আর কোনদিন কোন দুর্ভাগা মানুষকে না পেতে হয় কোনদিন । কোনদিন যেন এমন দু:সহ দু:সময়ের মুখোমুখি না হতে হয় আমাদের মত করে । বিধাতার কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি কেউ যেন আমাদের মত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি না হয় ।
ছোটবোনের আদরের টিনটিন , মেলবোর্নের বাড়ীতে । মনে হচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে তার প্রিয় মানুষকে ।
[ কৃতজ্ঞতা জানাই নাসিমা আপাকে যিনি গতরাতে আমাকে অনেকটা সময় ধরে বুঝিয়েছেন ,যার অনেক কথা আমি বুঝতে চেয়েছি , পেরেছি । যাঁর অনুপ্রেরনায় লিখতে বসেছি । ]