অন্যদিকে সক্রেটিস ছিলেন একজন গ্রীক দার্শনিক ও শিক্ষক। যীশুর জন্মের ৪০০ বছর পূর্বে তিনি এথেন্সে বাস করতেন। তিনি তার যুক্তি দিয়ে পশ্চিমা দর্শন খন্ডন করেছিলেন। তার ছাত্র প্লেটো ও অন্যান্যদের উপর ছিল প্রচন্ড প্রভাব। সক্রেটিস বলেছিলেন, আসল সত্যটি সবাই জানে, আমাদের আত্নার মধ্যেই এটি আছে, বোঝার জন্য প্রয়োজন শুধু সচেতন উপলব্ধি। পরবর্তীতে এথেন্সের সামাজিক ব্যবস্থার সমালোচনা এবং তরুন সমাজকে প্রভাবিত করার দায়ে তাকে বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। নিজ যুক্তি-দর্শন তুলে নিয়ে নিজেকে মৃত্যুদন্ডের হাত থেকে রক্ষা করার সুযোগ তাকে দেয়া হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। তাছাড়া তার বন্ধু ক্রিটো তাকে জেলখানা থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ এনে দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি কারন তিনি নিজেকে ভন্ড প্রমাণ করতে চাননি, নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাননি।
যীশু আর সক্রেটিসের মধ্যে অমিল অনেক কিন্তু মিলও আছে - দুজনকেই তৎকালীন শাসকেরা ঈশ্বর, ধর্ম ও সামাজিক রীতি নষ্টের দায়ে হত্যা করে। দুজনেই ছিলেন দৃঢ়চেতা, তারা কেউই শাসকগোর্ষ্ঠীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি। যীশু আর সক্রেটিস এ দুজন ধারন করেন সম্পূর্ণ বিপরীত ধ্যান-ধারনা, দর্শন। যীশু কেবলি বিশ্বাসের জোরে ঈশ্বর মান্য করার কথা বললেও সক্রেটিস চান বাস্তব প্রমাণ। সক্রেটিস তার যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করেন এই ঈশ্বর তত্ত্ব। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন খ্রীস্টধর্মের মূলগ্রন্থ বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কি অস্বাভাবিক রকম পরস্পরবিরুদ্ধ।
যীশু আর সক্রেটিসের মধ্যে কখনো দেখা হইনি, অবশ্য তার কোন সুযোগও ছিল না। কিন্তু কেমন হতো তাদের প্রথম সাক্ষাৎটি? সক্রেটিস কি প্রশ্ন করতেন আর যীশুই বা কি উত্তর দিতেন? তা অনুমান করেই লেখা হয়েছে যীশু আর সক্রেটিসের মধ্যে এই কাল্পনিক আলাপচারিতা।
: শুভ সকাল, যীশু। আমি দার্শনিক সক্রেটিস। আপনার তো অনেক জ্ঞান, বহু ভক্ত। অসাধারন আপনার শিক্ষাদান পদ্ধতি। আপনার হাতে যদি কিছুটা সময় থাকে তবে আমার কয়েকটা দুবোর্ধ্য প্রশ্নের জবাব দিন, সারাজীবন ধরে আমি এই কয়েকটা প্রশ্নের জবাব হাতড়ে বেরিয়েছি।
: মানুষকে ঈশ্বরের কথা জানানোই তো আমার কাজ। মনে রাখবে, যদি সত্যিই পেতে চাও তবেই খুঁজে পাবে, যদি প্রশ্ন কর তবেই জবাব পাবে, আর যদি দরজার কড়া নাড় তবেই দরজা খুলবে। বল তুমি কি জানতে চাও।
: প্রশ্ন মূলত একটাই আর এই প্রশ্নটাই আমাকে ভাবিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। আপনার তো অগাধ জ্ঞান; এর উত্তর নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। দেখুন, আমি সবসময়ই সন্মানের সাথে, মহত্ত্বের সাথে বাঁচতে চেয়েছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি সারাজীবন ধরেই হোঁচট খেয়ে চলেছি কারন আমি সত্যিই জানিনা সন্মানজনক কি, মহত্ত্বম কি। আমার সীমিত জ্ঞান নিয়ে আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে, এত সব ভাল-মন্দ থাকা সত্ত্বেও জীবনের আসলে কোন মানে নেই। দয়া করে আমাকে বলুন: একজন মানুষের কিভাবে বাঁচা উচিত, তার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
: সৃষ্টিকর্তার সেবা করা। তার এবাদত বন্দেগি করা।
: কিন্তু কে আমাদের সৃষ্টিকর্তা?
: সৃষ্টিকর্তা তো একজনই, তিনি ঈশ্বর।
: উফ! আপনার এথেন্সেই থাকা উচিত। আপনি বোধহয় জানেন না আমাদের এথেন্সে অনেক দেবতা।
: কিন্তু সত্যিকারের দেবতা একজনই।
: অবশ্যই। তাহলে সত্যিকারের দেবতা কে?
: তিনি মহান ঈশ্বর।
: তা তো বুঝলাম। কিন্তু কে তিনি?
: তার অসীম জ্ঞান। তিনি ভালবাসা, শান্তি আর দয়ার আধার। স্বর্গ, এই পৃথিবী, বলতে গেলে পৃথিবীর সবকিছুই তার তৈরি।
: সবকিছুই!
: হ্যাঁ, সবকিছুই। তার যে অনেক ক্ষমতা। এই পৃথিবীর সব কিছুই নিয়ন্ত্রন করেন তিনি। তিনি সর্বজ্ঞ, কোনকিছুই তার অজান্তে ঘটতে পারে না।
: তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, এই যে মহামারী, পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, অকাল মৃত্যু, অসহায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অপরাধ - এগুলো সব তিনিই তৈরি করেছেন?
: না না। এর জন্য দায়ী শয়তান আর মানুষের বদস্বভাব। ঈশ্বরের সব কিছুই ভাল, তিনি নিশ্পাপ। তিনি শুধুমাত্র ভালগুলোই দেন।
: কে এই শয়তান? আপনি এইমাত্র বলেছেন ঈশ্বর একজনই, কিন্তু যে মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারে, যার এত ক্ষমতা, সে নিশ্চয়ই একজন দেবতা। আপনি বলেছেন ঈশ্বরই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু এখন আবার বলছেন যা কিছু ভাল তা দেন ঈশ্বর আর খারাপগুলো দেন শয়তান। আপনার কথায় আমি বেশ অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি। স্পষ্ট করে বলুন, শয়তান কে আর কোনগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে আর কোনগুলো নয়।
: শয়তান একজন খারাপ অ্যাঞ্জেল, দেবদূতও বলতে পারো। প্রবল উচ্চাকাঙ্খী। ঈশ্বরের শত্রু। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল শয়তান, ঈশ্বরের সব অর্জন সে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল।
: দেবদূত মানে কি?
: দেবদূত মানে দেবদূত।
: অবশ্যই, এটা একটা পরিচয়, যেমন সক্রেটিস হল সক্রেটিস। কিন্তু আপনি তো জানেন আপনার ধর্ম সম্পর্কে আমার ধারনা নিতান্তই সামান্য। তাই আমার বুঝতে সুবিধা হবে এমন কোন কিছুর সাথে এদের তুলনা করুন।
: দেবদূত মানে দেবদূত।
: আমার অজ্ঞতার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন, যীশু। দেখুন, আমি তো আপনার মতো জ্ঞানী নই। আমি কখনোই কোন দেবদূতকে দেখিনি, এমনকি এদের কথা কোনদিন শুনিনি পর্যন্ত। আচ্ছা, অভূক্ত অবস্থায় আপনি যখন ৪০ দিন পর্যন্ত মরুভূমিতে ঘুরে বেরিয়েছিলেন তখন নাকি অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পেয়েছিলেন? সত্যি নাকি? বলুন না, এই দেবদূতেরা দেখতে কেমন?
: ওদের ডানা থাকে।
: মশার মতো? আরেকটু খোলাসা করুন।
: ডানা ছাড়া আর বাকী সব কিছূ ওদের মানুষের মতই।
: আর? ওরা নিশ্চয়ই উড়তে পারে?
: অবশ্যই। ডানা আছে তো সেজন্যই।
: আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বললেন ওরা প্রায় মানুষের মত দেখতে। তাহলে ওরা মানুষের থেকে আলাদা হল কিভাবে? মানে, আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের সাথে ওদের পার্থক্যটা কোথায়।
: ওরা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। ওদের মৃত্যু নেই।
: অনেক উন্নত! কিভাবে?
: ওদের নীতিবোধ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া ওদের ক্ষমতাও অনেক।
: এবার আমি বুঝতে পারছি। নিশ্চয়ই ওরা মহামানব?
: অবশ্যই!
: তাহলে এর মানে দাড়াল যে ওরা মহামানব আর ওদের মৃত্যু নেই। এথেন্সে আমরা কিন্তু এদেরকেই দেবতা বলি।
: ঈশ্বর ওদের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান।
: ঠিক একইভাবে জীউস আমাদের কাছে অলিম্পিক দেবতাদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তারপরও বাকীদের কিন্তু আমরা দেবতাই বলি। আচ্ছা, আপনার কাছে ঈশ্বর কথাটির মানে কি?
: ঈশ্বরই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তার অসীম শক্তি, তিনি মহাজ্ঞানী। তিনি ন্যায়বিচারক, তিনি দয়ালু।
: কিন্তু কখনোই কারো মধ্যে একসাথে এতগুলো গুন থাকতে পারে না। আমি মনে করি একজন ব্যক্তি কখনোই একাধারে শান্তিপ্রিয় আর ক্ষমাশীল হতে পারেন না। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি যদি বিচারে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে অবশ্যই তাকে নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে কিন্তু এটি আবার তার ক্ষমাশীল বৈশিষ্ট্যের লংঘন। কোন ব্যক্তি যেমন একইসাথে ডানে ও বামে যেতে পারে না তেমনি কোন ব্যক্তিরও একসাথে এতগুলো গুন থাকতে পারে না, কারন এগুলো একে অপরের বিপরীত।
: ঈশ্বরের কাজকর্ম রহস্যময়।
: তার মানে আমাদের এই এথেন্সে যেমন অনেক দেবতা আছে তেমনি আপনারও অনেকগুলো দেবতা আছে কিন্তু তাদের সবাইকে আপনি ঈশ্বর বলে মানতে রাজী নন।
: না না! ঈশ্বর সর্বশক্তিমান।
: শুধু পার্থক্য তাদের ক্ষমতায়?
: শুধু তাই নয়। ঈশ্বর তাদের চেয়েও অনেক বেশি নীতিবান, তিনি অনেক ভাল। তিনি পাপ করতে পারেন না।
(চলবে)