এক
নানা সমস্যার কারণে রাজধানী ঢাকা শহর ক্রমশই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এর দায় অনেকটাই রাজউক বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। অথচ ঢাকাকে একটি আধুনিক বসবাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করার জন্য পরিকল্পনা করা এবং বাস্তবায়নের ক্ষমতা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
রাজউকের শুরু ৬৯ বছর আগে ১৯৫৬ সালে, ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা ডিআইটি নামে। ১৯৫৯ সালে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান অধিবাসীদের বাসস্থান, শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখে ঢাকার ৫৭০ কিলোমিটার এলাকার জন্য একটা মাস্টার প্ল্যান করা হয়। এই মাস্টারপ্ল্যান করার দায়িত্বে ছিলেন ব্রিটিশ পরিকল্পনাবিদ মিনোপ্রাইয়ো, স্পেন্সলী এবং ম্যাকফারলেন। এই পরিকল্পনায় ঐতিহ্যবাহী এবং দৃষ্টিনন্দন ভবন সমৃদ্ধ পুরনো ঢাকাকে অপরিবর্তিত রেখে নতুন ঢাকায় ধানমন্ডি গুলশান বনানী ইত্যাদি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়, মতিঝিলকে গড়ে তোলা হয় বাণিজ্যিক এলাকা হিসাবে। এই পরিকল্পনার অধীনে নতুন ঢাকায় কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করা হয়। মার্কিন স্থপতি ড্যানিয়েল ডানহাম এবং বব বুইগির নকশায় ইসলামী স্থাপত্য রীতিতে ষাটের দশকে তৈরি হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। 'সেকেন্ড ক্যাপিটাল' নামে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য সমৃদ্ধ এলাকা গড়ে তোলা হয় মার্কিন স্থপতি লুই কানের নকশায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আজকের সংসদ ভবন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে লাগলো। এই বাড়তি জনসংখ্যার আবাসস্থল হিসেবে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য ডি আই টি বা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টকে ১৯৮৭ সালে পরিবর্তিত করা হয় রাজউক বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হিসেবে। ১৯৯১ সালে রাজউকের আওতাধীন এলাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৫০০ বর্গ কিলোমিটার। রাজউক প্রতিষ্ঠার পর (এবং এত বছর অবধি) ঢাকা শহর নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা করা হয় ১৯৯৫ সালে, এর নাম ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান বা ডিএমডিপি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয় ১৯৯৫-২০১৫, পরে এই সময়কাল ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ড্যাপ বা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান এই ডিএমডিপি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত।
ড্যাপ অর্থাৎ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার, গাজীপুরের শালবন থেকে নারায়ণগঞ্জের বানিজ্যিক এলাকা, মাঝে আছে সাভার, কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকাসহ ঢাকার অন্যান্য এলাকা। ড্যাপের উদ্দেশ্য এই এলাকায় নাগরিক সুবিধা বাড়িয়ে এক উন্নত মহানগর গড়ে তোলা। এজন্য ড্যাপে যা যা আছে:
১)ভূমি ব্যবহার নির্ধারণ: আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা, এবং সবুজ অঞ্চল আলাদা এবং নির্দিষ্ট করা।
২)সড়ক এবং পরিবহন ব্যবস্থা: রাস্তা, ফুটপাত, এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পরিকল্পনা।
৩) সার্ভিস সুবিধা: পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ব্যবস্থার উন্নয়ন।
৪) পরিবেশ সংরক্ষণ: জলাশয়, খাল, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা, ঢাকা নগরীকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত নিম্ন ভূমি এবং জলাধার রাখা।
৫) জনসংখ্যা ও ভবন পরিকল্পনা: একটি এলাকার জনসংখ্যা ঘনত্ব অনুযায়ী ভবন নির্মাণের বিধি-বিধান তৈরি করা। এজন্য আছে রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা।
এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে ড্যাপ তৈরি হলেও ড্যাপ বলতে এখন কেবল বাড়ি বানানোর নিয়ম কানুন বোঝায়। ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে যেন এলাকার জনঘনত্ব এবং নাগরিক সুবিধা অনুযায়ী বাড়ির ফ্লোর স্পেস নির্ধারিত হয়। ড্যাপের আগে জমির মালিক তার জমিতে যতগুলো ইচ্ছা ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে পারতেন, এখন পারেন না। এখন বাড়ি নির্মাণের জন্য এলাকা অনুযায়ী রাজউক বাড়ির ফার (floor area ratio) নির্ধারণ করেছে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা উত্তরায় একটা তিন কাঠার প্লটে ফার ৩.৫, সেই অনুযায়ী একজন বাড়ি মালিক প্রতি ফ্লোরে ১৩৫০ বর্গফুট করে ছয় ফ্লোর (G+6) বানাতে পারেন, কিন্তু উত্তরার খুব কাছে অবস্থিত উত্তরখানে যেহেতু নাগরিক সুবিধা কম ( নাগরিক সুবিধা অর্থ রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি) সেখানে তিন কাঠা প্লটের ফার ২, ফলে সেখানে কম উচ্চতার বাড়ি অর্থাৎ কম ফ্ল্যাট বানানো যাবে।
আবার জনঘনত্ব বেশি আছে কিন্তু নাগরিক সুবিধা আর বাড়ানো সম্ভব না এমন এলাকা যেমন পুরনো ঢাকায়, জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ড্যাপে ফার কম রাখা হয়েছে, ফলে এসব এলাকায় কম ফ্লোর স্পেসের বাড়ি বানাতে হবে।
মোটামুটিভাবে এই হচ্ছে ড্যাপ, অর্থাৎ ডিএমডিপি নামে রাজউক ঢাকা শহরের জন্য চল্লিশ বছর (১৯৯৫-২০৩৫) সময় কালের যে মহাপরিকল্পনা করেছে তার সার অংশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে বাড়ির ফ্লোর সংখ্যা ও ফ্ল্যাট সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার বিধিমালা তৈরি করেছে রাজউক। কিন্তু এলাকায় নাগরিক সুবিধা বাড়ানো, বা বিকেন্দ্রীকরণের কোনো কার্যক্রম করছে না।
দুই
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ক্রমশই রাজধানীকে অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্য অবনতি ছাড়াও, আক্ষরিক অর্থেই ঢাকার ভূমির অবনতি হচ্ছে বছরে ১০.৪১ মি.মি. করে, বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা এবং তা রিচার্জ না হবার কারণে। ঢাকার ভূমি অবনমন
রাজউক এত বছর ধরে কী করেছে? রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য ছাড়পত্র দেয়া, নকশা অনুমোদন, নির্মাণের বিভিন্ন স্তরে তদারকি করা ইত্যাদি এবং আবাসিক এলাকা তৈরি করা ও প্লট- ফ্ল্যাট বিক্রি। গত ত্রিশ বছরে রাজউক তিনটা আবাসিক প্রকল্প করেছে, উত্তরা থার্ড ফেজ, পূর্বাচল এবং ঝিলমিল। আগের আবাসিক এলাকাগুলো (ধানমন্ডি ইত্যাদি) মোটামুটি পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যেতো, কিন্তু এখন একটা আবাসিক এলাকা বসতি স্থাপন উপযোগী করতে রাজউক কমবেশি ২০ বছর সময় নেয়। উত্তরা থার্ড ফেজের কথা ধরি। প্লট বরাদ্দ দেবার জন্য আবেদন নেয়া হয় ২০০১ এবং পরে আবার ২০০৩ সালে, বরাদ্দ দেয়া হয় ২০০৭ সালে। তারপর প্লটের সীমানা নির্ধারণ এবং রাস্তা নির্মাণ করে বাড়ি বানানোর উপযোগী করেছে ২০২০/২০২১ সাল নাগাদ, অর্থাৎ প্রকল্প শুরুর ২০ বছর পর। এখনো এই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠেনি। যদি রাজউক আরও সক্রিয় হতো, তাহলে পূর্বাচল, উত্তরা থার্ড ফেজ, ঝিলমিল এলাকা স্যাটেলাইট টাউন হিসেবে গড়ে উঠতো এবং ঢাকার উপর চাপ কম হতো।
দেখে মনে হচ্ছে সব কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়, আসলে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয়না।
রাজউক উন্নয়নের বদলে যেভাবে অবনতি করছে:
১) বায়ু দূষণ: রাজধানীর বায়ু দূষণের দায় অনেকটাই রাজউকের। বিভিন্ন নির্মাণকাজের সময় সিমেন্ট, বালি, ও অন্যান্য উপকরণের ধূলা বাতাসে মিশে দূষণ বৃদ্ধি করে। নির্মাণ সামগ্রী যাতে খোলা জায়গায় না থাকে তদারকি করা রাজউকের দায়িত্ব, রাজউক তা করে না।
২) জলাবদ্ধতা: রাজধানীতে জলাবদ্ধতাও অনেকটা রাজউকের গাফিলতির কারণে। ড্যাপে রাজউক ঢাকার আশেপাশের নিম্ন ভূমিকে জলাধার হিসেবে সংরক্ষণ করার বিধিমালা তৈরি করেছে অথচ সেই ভূমি ভরাট করে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিরা ভূমি ব্যবসা করছে। রাজউক তা নিয়ন্ত্রণ করছে না।
৩) তাপমাত্রা বাড়ানো: গরমকালে রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ কাঁচ দিয়ে আবৃত বাড়ি। ঢাকার অধিকাংশ বানিজ্যিক ভবন দেখা যায় কাঁচ দিয়ে আবৃত, কারণ এই ধরনের ভবন নির্মাণে তুলনামূলকভাবে কম খরচ হয় এবং সময় কম লাগে। কিন্তু এই ভবনগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বহুল ব্যবহার করতে হয়, ফলে ভবনের বাইরে গরম বেড়ে যায়।
৪) অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি: আবাসিক এবং বানিজ্যিক ভবনগুলোর ৬৬ শতাংশ অগ্নি নিরাপত্তার বিধান মেনে তৈরি হয় না। অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে রাজুকের বিধি-বিধান আছে এইখানে view this link
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে ঢাকার দুই তৃতীয়াংশ ভবন।
৫) ভূমিকম্পে ধসে যাবার মতো বাড়ির অনুমোদন: আজকাল মাঝে মাঝেই মৃদু ভূমিকম্প হচ্ছে। একটু বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে কতগুলো বাড়ি টিকে থাকবে সেই হিসেবে যেতে ইচ্ছা করছে না!
রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এত ভবন নির্মাণ হচ্ছে, সেসব কি রাজউক দেখছে না? অবশ্যই দেখছে। কিন্তু "যত অনিয়ম তত আয়", রাজউক এই তত্ত্বে বিশ্বাসী।
তিন
ঢাকা শহরের জমি উচ্চমূল্যের, রাজউক ক্ষমতাসীনদের জন্য প্লট উপহার দেয় কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে। নিয়ম আছে রাজউকের প্লট বা বাড়ি যিনি একবার পেয়েছেন, তিনি দ্বিতীয়বার আর রাজউক থেকে কিছু পেতে পারেন না। রাজউক শেখ রেহানাকে গুলশানে একটি বাড়ি দেবার পর আবার পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি দিয়েছে। পত্রিকার শিরোনাম: রাজউকের সহায়তায় অনুগত ও তোষামোদকারীদের ৮৩০ প্লট উপহার দেন হাসিনা। view this linkএভাবে প্রভাবশালীদের আদেশ অনুযায়ী বিধি বহির্ভূতভাবে প্লট দেয়ার মাধ্যমে রাজউকের কর্মকর্তারা নিজেদের জন্য নানা সুবিধা আদায় করে নেন। রাজধানীর উন্নয়ন নয়, বরং একে খুবলে খাওয়াই রাজউকে কর্মরত সকলের কাজ। এখানকার পিয়নরাও সবাই কোটিপতি (চারশো কোটিপতি কিনা জানিনা অবশ্য)! সামান্যতম কাজও রাজউকে ঘুষ ছাড়া করা যায়না। এভাবে ঘুষের বিনিময়ে অবৈধকে বৈধতা দিয়ে দিনে দিনে এই রাজধানীকে বসবাসের জন্য অসুবিধাজনক, বিপজ্জনক এবং অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১:৫২