somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি, আলোয় আলোয়!

২৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জনগনকে ভয় দেখানোর জন্য লীগ গং যতগুলো ব্যবস্থা নিতো তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী ছিল গুম করা। হুটহাট মানুষ হারিয়ে যেতো, কখনো শোনা যেত রাস্তায় একটা মাইক্রোবাস থামিয়ে সাদা পোশাকের ক'জন মানুষ তুলে নিয়ে গিয়েছে, কখনো বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে, কখনো কোন চিহ্ন না রেখে মানুষ হারিয়ে যেতো।‌ একে বলা হতো গুম করা। আমাদের সামু ব্লগের কয়েকজন ব্লগারও গুম হয়েছেন। এ সংক্রান্ত দুটো পোস্ট:

লঞ্চের কেবিন থেকে ব্লগার জুলভার্ণ নিখোঁজ।

দিনে দিনে ব্লগারদের গুম ও গ্রেফতার লিস্ট দীর্ঘায়িত হচ্ছে: কান্ডারী অথর্ব, শের শায়রী, জুল ভার্নের পরে কি আপনি?

এই গুম করার মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছিল হাসিনা গং। এখন আর গুম হবার ভয় নেই, মানুষের মনে এখন ভয়-মুক্তির আনন্দ! এই স্বাধীনতার আনন্দ অনুভব করার জন্য অগাস্ট মাসে অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে আসছেন। এইসময় কেন আসছেন, একথা প্রশ্ন করলে উত্তর পাই সেই বিখ্যাত উক্তি, "এই মনে করেন- ভাল্লাগে, খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে... " এইসময়ে এই শব্দাবলীর ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়, "স্বাধীনতার স্বাদ পেতে আসলাম!"

"ভয়ের সংস্কৃতি" নামের বইয়ের লেখকও ক'দিন আগে দেশে এসেছেন শুনে তার এক আপনজনকে সেই একই প্রশ্ন করলাম, কেন এইসময় এসেছেন! উত্তর পেলাম, "মুক্তির স্বাদ নিতে, মুক্ত দেশ দেখতে! এতদিন তো দেশে আসতে হতো গুম হবার সম্ভাবনা মাথায় রেখে।!" ইনি হাসিনা রেজিমের দুঃশাসন নিয়ে এতো কথা বলেছেন, বই লিখেছেন, পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন, ফেসবুকে সমানে লিখে গেছেন, তাই তাকে কোন একটা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া বা গুম করা স্বাভাবিক ছিল। এটা তাঁরা করেনি, কারণ তিনি মার্কিন নাগরিক, একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক যাকে গুম করে হজম করা হাসিনার জন্য মুশকিল হতো।‌

এনার মতো দুয়েক জন ছাড়া এদেশের যে কোন নাগরিক, তা যত গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হোন না কেন, হাসিনার কোন অপরাধ নিয়ে ফেসবুকে লিখে পার পাননি। সম্প্রতি ইউটিউবে একজন সাবেক রাষ্ট্রদূতের একটি ভিডিও দেখতে পেলাম। তিনি বলছেন, তিনি ফেসবুকে হাসিনা সরকারের দুঃশাসন নিয়ে লিখতেন তাই তাকে ১৬ মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। গুম করার কয়েক মাস আগে থেকে ফোন করে তাঁকে নিষেধ করা হতো ফেসবুকে লিখতে, তিনি বাড়ি থেকে বের হলে তার গাড়ির সাথে সাথে দুটি মোটরসাইকেল চলতে থাকতো। তারপর একদিন তাঁর গাড়ি থামিয়ে দিয়ে মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিল। তাকে মেরে ফেলতে পারতো, কিন্তু মারে নি। ১৬ মাস পর হাসিনা গং ফিরিয়ে দিয়েছিল যেন বাকিদের কাছে তিনি একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন, বাকিরা যেন ভয় পায়। তিনি গুম থাকাকালীন তার সন্ধান পেতে সাহায্য চেয়ে পরিবার থেকে, দেশি-বিদেশি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ বারবার সরকারকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু সন্ধান মেলেনি। একদিন জানা গেল তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন, কিন্তু কারো সাথে কথা বলছেন না। অবশ্য বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে গেল না ভয়ে, সবাই জানতেন এখনো তাঁর উপর নজরদারি বজায় আছে!

দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা (সুকান্ত)। মানুষ ফেসবুকে মনের কথা লিখতে পারে। কিন্তু হাসিনার আমলে বাংলাদেশে ফেসবুকের দেয়ালে মনের খেয়ালে যা খুশি তাই লেখা যেত না। দুটি আইন খড়গ হয়ে ঝুলত ফেসবুকারদের মাথার উপরে, "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন" এবং "জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন ২০০৯"। এদেশে বসে কেউ হাসিনা কিম্বা তার পরিবারের কারো সম্পর্কে ফেসবুকে তৈলবিহীন পোস্ট দিলে আর রক্ষা নাই, সাথে সাথে সারা দেশের নানা জায়গা থেকে হাসিনাকে তৈল মর্দনকারীরা পোস্ট দাতার বিরুদ্ধে মামলা দিতে শুরু করতেন এই দুটি আইনের বলে। ফলে জেল জরিমানা দিয়ে কখনও রক্ষা হতো কিংবা কখনও রক্ষা হতো না। বিদেশে বসে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও রক্ষা ছিল না, তৈল মর্দনকারীরা পোস্ট দাতার দেশের বাড়ির ঠিকানা বের করে বাপ ভাইকে জেলে ঢুকিয়েছেন, বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। এমন ঘটনা অসংখ্য আছে। ফলে মানুষ কথা বলতো ভয়ে ভয়ে, মানুষের মনে অবিশ্বাস আর আশঙ্কা জেঁকে বসেছিল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার হতো মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে, কখনো চিরদিনের জন্য। মুখ বন্ধ করে দেয়া হতো ফেসবুকে লেখার কারণে। ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার জেরে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলল লীগ। ফেসবুকে লেখার জন্য দীর্ঘদিন বন্দি থেকে কারাগারে মারা যান মুশতাক আহমদ। উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া:

২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তারের আগে আহমেদ তার একটি ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশ সরকারের কোভিড-১৯ মহামারী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেন এবং লিখেন, "যখন একটি সমাজ মানুষের জীবনহানির চেয়ে অর্থনীতির ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে, তখন তার ভাইরাসের প্রয়োজন হয় না, এটি ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে।"
২১ বার জামিন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে মারা যান।


ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়েছিল, মুখ বুঁজে সব মেনে নাও, না হলে মরো! তাই আমি সব মেনে নিতাম মুখ বুঁজে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল, ভিআইপি চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়া রাস্তায় দীর্ঘ সময় বসে থাকা, বাসের নিচে চাপা পড়া দুজন শিক্ষার্থী নিহতের খবর শুনে পরিবহন মন্ত্রীর হাসিমুখ দেখা, আর এমন নানা অন্যায় দেখে চুপ করেই থেকেছি। মাঝে মাঝে ক্ষোভের কথা জানাতে ইচ্ছা করতো, তখন কখনো ক্ষোভের আভাস দেয়া পোস্ট দিয়েছি সামুতে। view this link এরকম একটা পোস্ট দেবার পর একজন ব্লগার (যার সাথে আমার ব্লগীয় মিথস্ক্রিয়া ভালো ছিল) একটি পোস্ট দিলেন । পোস্টে বলা হয়েছিল, আমি যে পোস্ট দিয়েছি সে ধরণের পোস্ট সামুতে দেয়া বিপজ্জনক। পোস্টে মন্তব্য করে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "কথাটা কি আমাকেই বললেন"? তিনি উত্তর দিলেন "আপনাকেও, আবার সবাইকেও"! আমি সাথে সাথে আমার সেই পোস্ট মুছে দিলাম, ভয় পেয়ে! সেই প্রথম বুঝতে পারলাম সামুতেও ফেসবুকের মতো নজরদারি করা হয়।

গতবছরের শেষ দিকে নতুন কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েও তাই ভয়ে ছিলাম, কারণ এই বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেবার পর কয়েকজন অভিভাবক এবং শিক্ষককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কখনো কমেন্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। গতবছর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের মাহাত্ম্য বর্ণনা মূলক সামুর এক পোস্টে আমি মন্তব্য করেছিলাম যে, এই উদ্বোধন উদযাপন করতে সারাদেশ থেকে আসা লীগের বাসের কারণে ঢাকা অচল হয়ে গিয়েছিল, ফলে আমি ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করেছি। আমার মন্তব্য দেখে যুক্তরাষ্ট্র বাসী একজন ব্লগার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।

দুঃখের কথা, হাসিনার পলায়নের পর থেকে সেই ব্লগারকেও যেমন আর সামুতে দেখছি না তেমনি আগে সামুতে নিয়মিত ছিলেন এমন অনেক ব্লগারদেরই এখন আর দেখতে পাইনা।

তবে সুখের কথা, এখন ব্লগে অনেক অনেক ব্লগারদের দেখা যায়। এদের কেউ কেউ এক দশক বা তারও বেশি সময় পর ফিরে এসেছেন! কিছুদিন আগেও যে ব্লগ নিস্প্রভ হয়ে থাকতো তা এখন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।

এই প্রাণবন্ততা দেখতে খুব ভালো লাগছে, ভালো লাগছে ভয়ের থেকে মুক্তি পেয়ে। এখন কিছু লিখতে গেলে আর ভাবতে হচ্ছে না, লিখে বিপদে পড়ব কিনা! মুক্তির এই আনন্দে এই মাসে নয়টা পোস্ট দিয়েছি। আমার আট বছরের ব্লগীয় জীবনে কখনো এক মাসে এত পোস্ট দেই নি! এই মাসেই সামু ব্লগে আমার আট বছর পূর্তি হল। আট বছরে ভার্চুয়াল এই জগতে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে, বেশিরভাগই আমার সাথে তেমন ব্যবহার করেছেন বাস্তব জগতে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে যেমন ব্যবহার করে। ‌ কেবলমাত্র একজন আমার সম্বন্ধে নানা মিথ্যা কথা লিখেই চলেছেন, সম্ভবত তার স্বভাব দোষে। এই ভালো ব্যবহার করা, কটুক্তি করা ব্লগার, সবাই ভালো থাকুন। আমি সবার সাথে সামুতে ব্লগিং করতে চাই আরো অনেক বছর।

যে কেহ মোরে দিয়েছ সুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়,
সবারে আমি নমি ।
যে কেহ মোরে দিয়েছ দুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়,
সবারে আমি নমি ।
যে কেহ মোরে বেসেছ ভালো জ্বেলেছ ঘরে তাঁহারি আলো,
তাঁহারি মাঝে সবারি আজি পেয়েছি আমি পরিচয়
সবারে আমি নমি ।
যা-কিছু কাছে এসেছে, আছে, এনেছে তাঁরে প্রাণে,
সবারে আমি নমি ।
যা-কিছু দূরে গিয়েছে ছেড়ে টেনেছে তাঁরি পানে,
সবারে আমি নমি ।
জানি বা আমি নাহি বা জানি, মানি বা আমি নাহি বা মানি,
নয়ন মেলি নিখিলে আমি পেয়েছি তাঁরি পরিচয়,
সবারে আমি নমি ।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: গীতবিতান)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১০:৫২
২৬টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্লোগান কোলাজঃ

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৩৬

জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্লোগান কোলাজঃ

* ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’
* ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’
* ‘নাটক কম করো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসসালামু আলাইকুম। ইদ মোবারক।

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৯



ঈদ এখন এক নিরানন্দময় উপলক্ষ্য।
কিতাবে আছে ধনী-গরীব অবিভাজনের কথা বরং এদিন আরো প্রকটতা নিয়ে প্রস্ফুটিত হয় বিভেদরেখা কেননা আমরা আমাদের রাষ্ট্র- সমাজব্যবস্থা ও জনগণকে সেভাবে দিয়েছি ঘিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঈদের শুভেচ্ছা: দূর থেকে হৃদয়ের কাছ

লিখেছেন আমিই সাইফুল, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:০৩

আসসালামু আলাইকুম,
আজ ঈদের দিন। চারদিকে উৎসবের আমেজ, হাসি-খুশি, নতুন জামা আর মিষ্টি মুখের আদান-প্রদান। আমি ইউরোপে আমার পরিবারের সাথে এই আনন্দের মুহূর্ত কাটাচ্ছি। কিন্তু আমার হৃদয়ের একটা কোণে একটা ফাঁকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে......

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪০


বাংলা গানের ভাণ্ডারে কাজী নজরুল ইসলাম এক অনন্য নাম। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সংগীতের এক শক্তিশালী ধারা তৈরি করেছেন। তারই লেখা কালজয়ী গজল "ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে এলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেই যে আমার নানা রঙের ঈদগুলি ......

লিখেছেন অপ্‌সরা, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪২


পেছনে ফিরে তাকালে আমি সবার প্রথমে যে ঈদটার কথা স্মরন করতে পারি সেই ঈদটায় আমি পরেছিলাম আমব্রেলা কাট নীলচে বলবল রং একটা জামা এবং জামাটা বানিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×