তিস্তা ব্যারেজ।
দেশে প্রতিবছর বন্যা হয়, বন্যায় প্রতি বছর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে এবারের ক্ষতি সব ছাড়িয়ে গেছে! নদীমাতৃক আমাদের দেশে এত নদী, এখানে বন্যা আটকানো সম্ভব নয় কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব যদি ঠিক সময় বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। বন্যার পূর্বাভাস কে দেবে? বৃষ্টিপাতের ডাটা বিশ্লেষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। এ কাজের জন্য অনেকগুলো সরকারি সংস্থা আছে। যেমন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে বন্যা পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র আছে, Institute of water modelling নামের সংস্থা বিভিন্ন নদীর গাণিতিক মডেল তৈরি করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়, এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রন করার জন্য আরো নানা ধরনের মডেল তৈরি করে। আছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, আবহাওয়ার খবর দেয়ার পাশাপাশি বন্যার পূর্বাভাস দেওয়াও তাদের কাজ। বুয়েটে আছে ইনস্টিটিউট অফ ফ্লাড কন্ট্রোল এন্ড ড্রেইনেজ রিসার্চ, এদের কাজও বন্যা নিয়ে। এছাড়া আছে ওয়ার্পো, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা। এদের কাজ সরাসরি বন্যা বিষয়ক না হলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণও তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত। বন্যা নিয়ে কাজ করার জন্য আরো আছে নদী গবেষনাগার বা River research institute. বুয়েট বাদে উপরের সবকটি সংস্থা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এতগুলো সংস্থা মিলেও কিন্তু কোন উপায় বের করতে পারেনি কিভাবে বন্যা জনিত ক্ষতি প্রশমন করা যায়, বন্যা আটকানো দূরে থাক!!
এখানেই শেষ নয়, নদী নিয়ে কাজ করার জন্য আরো মন্ত্রণালয়, আরও সংস্থা আছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে IWTA বা আন্তঃ নদী পরিবহন কর্তৃপক্ষ, এবং নদী রক্ষা কমিশন। ২০১৩ সালে নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এগারো বছরেও এই কমিশনের করা কোনো কাজের উল্লেখ কোথাও দেখিনি। তাই এর কর্ম পরিধি সম্পর্কে জানার জন্য গুগল করলাম আর এটা পেলাম।
নদী রক্ষা কমিশন নামের সংস্থার কাজ হচ্ছে নানা ধরনের জিনিস কেনাকাটা করা এবং কর্মশালায় মানুষ পাঠানো! নদীতে বন্যা হলে তা রক্ষার দায়িত্ব নদী রক্ষা কমিশনের নয়!!
এছাড়া আমাদের আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বন্যার মত জাতীয় দুর্যোগে এই মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো কর্মকান্ড দেখা যায়নি। আরো আছে যৌথ নদী কমিশন, যার কাজ ভারত এবং বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা যেন দু'দেশে সমবন্টিত হয় তা নিশ্চিত করা।
সাম্প্রতিক বন্যার কোন পূর্বাভাস বা সতর্কতা সংকেত আমাদের এই এতগুলো সংস্থার কোনোটাই দিতে পারে নি কেন তা বোঝা যায়, হঠাৎ এভাবে বাঁধ খুলে দেবে প্রতিবেশী দেশ এটা কেউ ভাবতে পারেনি। কিন্তু এত ডিজিটাল ডিজিটাল ডিজিটাল হয়েও কেন একটি সংস্থাও বুঝতে পারল না যে অতি বৃষ্টির ফলে উজানে বান দেখা গিয়েছে, এরা বাঁধ খুলে দিলে আমাদের দেশ ভেসে যাবে !!
এই সংস্থাগুলো কি করে তা দেখতে গিয়ে দেখলাম, এরা কিছুই করেনি স্বাধীনতার পরের এই ৫৩ বছরেও!! বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনেকগুলো সংস্থা থাকলেও নদী নিয়ে তেমন বড় কোন প্রকল্প কোন সংস্থাই করে নাই। একমাত্র বড় প্রকল্প করে ছিল তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়েছে ভারতের জন্য। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় সেচ কাজের সুবিধার জন্য তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ১৯৭৯ সনে। বাংলাদেশের এ ধরনের প্রকল্প এটাই প্রথম যা সম্পূর্ণ নিজেদের প্রকৌশলীদের দিয়ে তৈরি হচ্ছিল, সফলভাবে শেষও হয়েছিল। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজের নির্মাণ শুরু হতেই ভারত উজানে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে ফেলে। ফলে তিস্তা ব্যারেজ যে পরিমাণ পানি আসবে বলে ডিজাইন করা হয়েছিল সেটা আসলো না, পানিতে পলি মাটির পরিমাণ বেড়ে গেল, ফলে গেটের কার্যকারিতা কমে গেল। ফলে একসময় তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে গেল।
অথচ বাংলাদেশ হবার আগে, পাকিস্তানকালীন দুঃসময়ে এই পানি উন্নয়ন বোর্ড বা তৎকালীন ওয়াপদা কিন্তু বড় বড় প্রকল্প সম্পন্ন করেছিল। সেসময় কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছিল, কুষ্টিয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঙ্গা কপোতাক্ষ বা জিকে প্রকল্প নামক সেচ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।
এখানে আবার কেউ বলবেন না যে, অনেক বড় প্রকল্প হয়েছে গত পনের বছরে, যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে মেট্রোরেল পদ্মা সেতু... আমি নদীমাতৃক দেশের নদীকে নিরাপদ করা এবং কাজে লাগাবে এমন প্রকল্পের কথা বলছি। অবশ্য উনারা আরেকটা প্রকল্পের কথাও বলতে পারেন, যা ২৭৬৫ কোটি টাকা খরচ করে আকাশে ওড়ানো হয়েছিল, গালভরা নাম বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট। view this link
উপরের লিংক থেকে উদ্ধৃতি দিলাম:
"এখন থেকে তিন দিনের স্থলে ১০ দিনের পূর্বাভাস দেয়ার পাশাপাশি, দুর্যোগের দিনক্ষণ ও স্থায়িত্বকাল উল্লেখসহ আবহাওয়ার প্রতিঘন্টার অগ্রগতি তুলে ধরার কথা জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক।
কোথায় কখন বৃষ্টি হবে, সেই বৃষ্টি ভারী নাকি মাঝারি হবে, আদ্রতা কেমন থাকবে তার সবই উল্লেখ থাকবে আবহাওয়া পূর্বাভাসে।"
এটা ২০১৮র খবর, বঙ্গবন্ধু১ দিয়ে কোনোরকম কোনো কাজ হয়েছে বলে কোনদিন শুনিনি!!
ভারত যেন ভবিষ্যতে আর এমন পানি সন্ত্রাস না করতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা হিসেবে অনেকে বলছেন ভারত যে ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে, বাংলাদেশেও সেই নদীগুলোর উপর বাঁধ নির্মাণ করা হোক, উচ্চতা ভারতের বাঁধের দ্বিগুন করে! তাদের মতে, এর ফলে ভারত ভবিষ্যতে কখনো এভাবে তাঁদের বাঁধ খুলে দিলে সেই পানি আমাদের বাঁধে বাধাগ্রস্ত হয়ে উজানে ভারতের দিকে যাবে, তারপর ভারতের নীচু বাঁধের উপর দিয়ে গিয়ে ভারতের এলাকায় বান আনবে। কিন্তু এমন হওয়া কখনোই সম্ভব না। কেন সম্ভব না, সেটা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন বলে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। তাছাড়া আরো কতগুলো কারণে এভাবে বাঁধ বানানো যাবেনা।
১) সেতু, বাঁধ এইসব নদীতে ইচ্ছা মতো জায়গায় নির্মাণ করা যায়না। অনেক কিছু বিবেচনা করে জায়গা নির্বাচন করতে হয়। তাই নদী যেখানে বাংলাদেশে ঢুকছে ঠিক সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
২) এতগুলো বাঁধ বানাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
৩) দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। বাঁধ নির্মাণের আগে hydrological এবং hydraulic সমীক্ষা করতে হবে। hydrological সমীক্ষার জন্য প্রয়োজন অন্তত ৫০ বছরের বৃষ্টিপাতের ডাটা, যে এলাকা থেকে রিজার্ভারে পানি আসবে তার বিশদ তথ্য, সেই স্থানে অনেক বছরের বন্যার তথ্য, পানিতে বাহিত পলির পরিমাণ এবং এরকম আরো নানা তথ্য। এই সব তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বন্যার মাত্রা নির্ণয় করতে হবে। এটা নির্ণয় করা হয়ে গেলে বাঁধের hydraulic ডিজাইন করতে হবে, অর্থাৎ নদীর কোথায় বাঁধ বানানো হবে, সেখানে বাঁধের উচ্চতা কত হবে, কতগুলো গেট হবে, কি ধরণের গেট হবে যাতে পানির নিয়ন্ত্রিত রিলিজ করা যায়, এইসব ডিজাইন করা হবে।
এরপর বাঁধের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করতে হবে, এরজন্য বিবেচনা করতে হবে পানির স্রোতের গতি, প্রতি মিনিটে কত পানি যাবে (design flow), পানির চাপ, পানিতে পলির পরিমাণ ইত্যাদি। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করা শেষ হলে বাঁধ নির্মাণ শুরু করতে হবে। এখন বাঁধ নির্মাণ শুরু করার পর যদি দেখা যায় ডিজাইন ফ্লো পাওয়া যাচ্ছে না, অর্থাৎ ভারত আগে যে পরিমাণ পানি ছাড়তো সেই পরিমাণ পানি ছাড়ছে না, তাহলে বাঁধের কার্যকারিতা ঠিক থাকবে না, যা ঘটেছে তিস্তা বাঁধের বেলায়।
অতএব এক বছরের মধ্যে আমরা ভারতের দ্বিগুণ উচ্চতার বাঁধ বানিয়ে তাদের শিক্ষা দিতে পারব এমনটা ভাবা মোটেও ঠিক নয়। আর দ্বিগুন উচ্চতা, এটাও একটা হাস্যকর কথা। অনেকগুলো প্যারামিটার আছে যেগুলা বাঁধের উচ্চতা ঠিক করে দেয়। নিজের ইচ্ছে মতো উচ্চতার বাঁধ বানানো যায় না।
তাই সঠিক কাজ হচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে আমাদের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য আদায় করা আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে। কেবল স্বৈরাচারী সরকার নয়, তার আগের সরকারগুলো কখনো ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। অবশ্য স্বৈরাচারী সরকার দাসত্বের নিম্নতম সীমায় পৌঁছে ভারতকে পানি সেবা দিয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে আবরার ফাহাদকে, এবং সকলকে বার্তা দেয়া হয়েছে যেন ভারতের এই একতরফা পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেউ কিছু না বলে।
তবে এখন আর সেই দাসত্ব মনোবৃত্তির সরকার নেই। তাই এখন এই সমস্যা সমাধান করতে হবে ভারতের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করে, অভিন্ন নদী নিয়ে যে আইন আছে সেটার ভিত্তিতে। সমস্যা সমাধানে ভারত সহযোগিতা না করলে আন্তর্জাতিক আদালতে আমাদের নিজেদের ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে হবে। এর ফলেই সহজে সমস্যার সমাধান হবে। এটা বাঁধ নির্মাণ করার মত ব্যয়বহুল হবে না এবং দীর্ঘ সময় লাগবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ৯:৪৬