আমার পরিচিত এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের কথা। গত তিন বছর যাবত মেয়েটি একটি চাকরি পাবার চেষ্টা করছে আর ব্যর্থ হচ্ছে। ঢাকার বাইরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছে, ফলাফলের দিক দিয়ে তার ক্লাসের সেরাদের একজন হিসেবে। এ পর্যন্ত আসতে তাকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। শৈশবে পিতৃহীন হবার পর তার বড় ভাইবোনেরা সবাই নানা ধরনের কাজে লেগে পড়ার ফলে একজনও স্কুলে যেতে পারেনি। ভাই-বোনদের সবার ছোট মেয়েটি নিজের চেষ্টায় স্কুলে পড়তে পেরেছে এবং একসময় কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াও শেষ করেছে। এতদূর আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, কিন্তু স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করতে পারবে, সেই স্বপ্ন তাকে উদ্দীপনা যুগিয়েছে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।
তার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার ধারনা ছিল, যেহেতু ও একটা ভালো বিষয়ে পড়েছে আর যেহেতু ও ক্লাসের টপার তাই চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না। কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রভাষক হিসেবে না হোক, অন্ততপক্ষে কোন ল্যাবের পরিদর্শক হিসেবে চাকরি নিশ্চয়ই পাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তা হয়নি। বিসিএস দিয়েছে কিন্তু দুয়েক ধাপ যাবার পর আর পাশ করতে পারেনি। অন্য অনেক জায়গায় ও ৩-৪ ধাপের পরীক্ষা দিয়ে ভালো করেছে, ভাইভা শেষে ভাইভা গ্রহনকারীরা তাকে অভিনন্দন জানাবার পরও দেখা গেছে তার চাকরি হয়নি, সেটা অন্য কেউ পেয়ে গেছে। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বেসরকারি স্কুল, ব্যাংক আরও নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোথাও চাকরি হয়নি। হতাশ হয়ে বলেছিল, শক্ত খুঁটির জোর অথবা টাকা ছাড়া এখন কোন চাকরি হয় না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও। খুঁটির জোর বা চাকরি কেনার মতো টাকার জোর তার নেই।
এখন সে যে চাকরির জন্য আবেদন করছে সেটা একটা বেসরকারি স্কুলে, "স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা" বিষয়ে (এই পদে উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যার স্নাতকোত্তরদের আবেদন করতে বলা হয়েছে) ১১তম গ্রেডের চাকরি।
এর মোট বেতন হয় আঠার হাজার টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ২৫ হাজার করার দাবি শোনার পর আমার ধারণা ছিল একজন স্কুল শিক্ষকের বেতন অন্তত ত্রিশ হাজার টাকা হয়। তাই মাত্র আঠার হাজার টাকা দেখে আমি অবাক হলাম, মেয়েটিকে বললাম এত কম বেতনে চাকরি করবে কেন!! মেয়েটা তখন বলল চাকরির এই কঠিন বাজারে তার অনেক সহপাঠী ১৬ এবং ১৭ গ্রেডের চাকরি করে, যার মোট বেতন ১২ হাজার টাকা!! তাই আঠার হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেলে সে বর্তে যায়।
কিন্তু আমি একটা হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছি না বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২৭৮৪ মার্কিন ডলার, টাকার হিসাবে যা দাঁড়ায় ৩,২৫,৭২৮ টাকা। (বর্তমান সরকারী বিনিময় হার ১ ডলার= ১১৭ টাকা হিসেবে।)
১৮০০০ টাকা মাসিক হিসেবে বাৎসরিক বেতন হয় ২,১৬,০০০ টাকা। গড় মাথা পিছু আয়ের চেয়ে ১,০৯,৭২৮ টাকা কম!!!!
অবশ্য এর চেয়ে কম বেতনেও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা চাকরি করেন। কয়েকদিন আগে এক খবরে দেখলাম, সম্প্রতি রেলওয়েতে যে ২১৭২ পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ পেয়েছেন (পদের নাম ওয়েম্যান) তারা সবাই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এদের বেতন গ্রেড ১৯তম, শুরুর বেতন ৮৫০০ টাকা। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী একজনের মাসিক বেতন ৮৫০০ টাকা ডলারে দাঁড়ায় ৭২.৬৫ ডলার, একবছরে ৮৭১.৮ ডলার!!
আমার পরিচিত একটা ছেলে বিবিএ পাশকরে সুপরিচিত এক কোম্পানিতে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজার পদে চাকরি করছে সর্বসাকুল্যে মাসিক ১৮০০০ টাকা বেতনে।
আরেকজন মধ্যবয়সী মানুষকে চাকরি খুঁজতে দেখেছি, যার এমবিএ ডিগ্রি এবং বায়িং হাউসে পনের বছর চাকরির অভিজ্ঞতা আছে। বায়িং হাউসের মালিক শীর্ষ পদে ভারতীয় কর্মী আনলেন, যিনি অফিসে যোগ দিয়েই ১৫/২০ বছর ধরে চাকরি করা অনেককে ছাঁটাই করে দিলেন। আমার দেখা এই চাকরি খোঁজা মানুষটিও এই সময় চাকরি হারালেন এবং তারপর থেকে আর চাকরি পাচ্ছেন না, দুঃশ্চিন্তায় হার্টের রোগ বাঁধিয়ে ফেলেছেন।
ক'দিন আগেই খবর দেখলাম, (এমন খবর প্রায়ই দেখি) মাওয়াতে ধরা তের কেজির একটা পাঙ্গাস মাছ ১৮০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাইশ হাজার টাকাতেও মাছ বিক্রির খবর আছে। একটা মাছের দাম বাইশ হাজার টাকা
সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পে সাহেবের কুকুরের একটি পা পন্ডিত মশাইয়ের পরিবারের পাঁচজনের সমান ছিল। আমি চাইনা, তবু আমার মাথায় এরকম নানা হিসাব নিকাশ ঘুরতেই থাকে, একটি মাছ সমান স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের পরিবারের কজন... বিশেষ করে এইবার কোরবানির সময় গরু ছাগলের দাম দেখার পর হিসাব মাথা থেকে বের করতে পারিনা।
আমার পরিচিত মেয়েটিকে নিয়ে আরেকটা ভাবনা আছে, যদি অন্য প্রার্থীদের পেছনে ফেলে সে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে শিক্ষকতার এই চাকরি পায়, তবে সে কি নেচে গেয়ে ছাত্রদের আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে পারবে!! (এখনকার নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের নেচে গেয়ে আনন্দের সাথে ছাত্রদের শিক্ষা দিতে হয়।) ১৮০০০ টাকা (এটা ঢাকার একটা নামী বেসরকারি স্কুলের বেতন, অনেক স্কুলে বেতন এরচেয়ে কম) বেতন প্রাপ্ত শিক্ষকের মনে কতটুকু স্বস্তি আর আনন্দ থাকে যে অন্যকে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা দান করতে পারে!!
অবশ্য অনেকে ভালো চাকরি পায়। আমার প্রতিবেশীর মেয়ে, যে লেখাপড়ায় একদমই ভালো ছিল না, এইচএসসির পর সে ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়েছে। এখন সে ৫৫ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করে কোন একটি ফ্যাশন হাউসে। উপরে উল্লেখিত আমার পরিচিত মেয়েটি এবং প্রতিবেশীর মেয়েটি একই বছরে এইচএসসি পাশ করেছে। আমার পরিচিত এক ছেলে দু'বছর আগে এক সরকারি সংস্থায় চাকরিতে যোগ দিয়েছে। সে এখন মাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে, আয় কত করে জানা নেই।
কেউ হয়তো বলবেন চাকরির পেছনে না ছুটে ব্যবসা করে না কেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কি ব্যবসা করার মতো পুঁজি থাকে নাকি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অনুমতি নেবার সামর্থ্য থাকে? চাকরি বা ব্যবসা ছাড়াও অন্য কিছু করা যায়, যেমন উম্মে কুলসুম পপি করছে। কিন্তু এমন সাফল্য সবার কাছে আসে না।
স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আয় করেন ড্রাইভাররা। এখন নতুন ড্রাইভারদের বেতনও অন্ততপক্ষে ২২ হাজার টাকা। এই ড্রাইভারদের বেশিরভাগই কোনরকম লেখাপড়া জানেনা।
এই সব দেখে আমার মনে হয়, তারুণ্যের ছয়/ সাত বছরে সময় এবং শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তেমন লাভ হয় না। বরং ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভারের চাকরি করা ভালো, এটাতে বেতনও বেশি আবার শত কোটি টাকার মালিক হবার সম্ভাবনাও থাকে। কিন্তু মেয়েরা কী করবে... তাদের জন্য ড্রাইভারের চাকরি উপযুক্ত না নিরাপত্তা ইস্যুতে। ভালো হয়, মেয়েরা লেবানন, সৌদি আরব, আর মধ্যপ্রাচ্যের অন্য সব দেশে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে চলে গেলে। এর ফলে আমাদের রিজার্ভের ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে সহজে...
আসলে গৃহকর্মী হিসেবে কাজের কথাটা বলছি ক্ষুব্ধ হয়ে, কিন্তু বাস্তবে এমনটা হচ্ছে। এখন চাকরি না পেয়ে মাস্টার্স পাশ অনেক মেয়ে কেয়ার গিভিং ট্রেনিং নিচ্ছে এবং তারপর সহজেই কেয়ার গিভার হিসেবে চাকরি করছে এখানে। দেশে এখন বিত্তশালী একাকী থাকা মানুষ বেড়েছে যাদের কেয়ার গিভারের সহায়তার প্রয়োজন হয়। কেয়ার গিভার শব্দটা নতুন, ইংরেজি শব্দ বলে শুনতে ভালো লাগে কিন্তু আদতে এই কাজ গৃহকর্মীর কাজের চাইতে তেমন স্বস্তিদায়ক কিছু না...
কী ভীষণ দুরবস্থায় আছে চাকরি প্রার্থী আমাদের শিক্ষিত তরুণরা..
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭