ভিকারুন্নেসা স্কুলে বছরের শুরুতে প্রত্যেক ছাত্রীকে এক পৃষ্ঠার একটা ছাপা কাগজ দেয়া হয়, যেখানে স্কুলে থাকাকালীন অবশ্য পালনীয় সব নিয়মকানুন লেখা থাকে। কোন ক্লাসে পড়ুয়া ছাত্রীরা কিভাবে চুল বেঁধে আসবে সেটা পর্যন্ত নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। মাথার উপরিভাগের চুল যদি হাল ফ্যাশনে কাটা হয়, তবে স্কুলে থাকাকালীন সেই চুল ক্লিপ দিয়ে এমনভাবে আটকে রাখতে হবে যেন কাটা বোঝা না যায়; ক্লিপ হতে হবে মান্ধাতার আমলের কাল চিকন ক্লিপ। এরপর রয়েছে আরো নানা নিয়ম, যেমন স্কুলে নেলপালিশ দিয়ে আসা যাবে না, ভ্রু প্লাক করা যাবে না ইত্যাদি। এই নিয়মগুলো না মানার অপরাধে জন্য শাস্তি পেতে হবে, সেটার উল্লেখও ঐ কাগজে থাকে। এই নিয়মগুলো না মানা ছোটখাটো অপরাধ, গুরুতর অপরাধ হল স্কুলে ঢোকার পর অনুমতি ছাড়া বাইরে গিয়ে সময় কাটানো, পরীক্ষায় নকল করা, মোবাইল নিয়ে আসা ইত্যাদি। ছাত্রীদের জন্য স্কুলে মোবাইল পুরোপুরি নিষিদ্ধ, অভিভাবকদের কেও জানিয়ে দেয়া হয়, যেন তারা মেয়েকে স্কুলে মোবাইল না দেন। নিষেধ সত্বেও ছাত্রীরা মোবাইল আনে, কখনো পোশাকের ভেতর লুকিয়ে, কখনো সালওয়ার দিয়ে ঢাকা মোজার ভেতরে করে। ধরা পড়লে প্রথমবার ছাত্রীকে বকাঝকা করে মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়, তারপর ছাত্রীর অভিভাবককে ডেকে সেটা ফেরত দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এরপর আবার মোবাইল পাওয়া গেলে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে, স্কুলের ডিসিপ্লিন রক্ষার স্বার্থে।
আমার মেয়ে দশ বছর ভিকারুন্নেসা স্কুলে পড়েছে, এই স্কুলের নিয়মের সাথে আমি ভালভাবেই পরিচিত। আমি মেয়েকে সবগুলো নিয়ম কড়াকড়িভাবে মানা শিখিয়েছিলাম। কারণ আমি ভাবতাম, প্রত্যেকেরই নিজ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন মান্য করা উচিত; সেটা নিজ বাড়ি হোক বা স্কুল হোক। ডিসিপ্লিন মানার এই অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা দরকার। মোবাইল ফোন স্কুলে নেবার দরকার হয়না, কারণ জরুরী প্রয়োজনে শিক্ষিকারা তাদের ফোন ব্যবহার করতে দিতেন। আমার মেয়ের অন্তত তিনজন সহপাঠীকে টিসি দিতে দেখেছি; একজন নকল করার অপরাধে আর আরেকজন স্কুলের সময় বাইরে যাওয়ার অপরাধে। একবার ক্লাস নাইনে পড়া এক মেয়েকে তার মা স্কুলে দিয়ে চলে যাবার পর মেয়েটি ক্লাসে ব্যাগ রেখে, গেটের দারোয়ানকে কলম কেনার কথা বলে বাইরে আসে। তারপর কয়েক ঘন্টা পর, ডে শিফটের ছাত্রীদের সাথে আবার স্কুলে ঢোকে এবং কিছুক্ষণ পর মর্নিং শিফটের ছুটি হলে তার ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু তার শ্রেণী শিক্ষিকা লক্ষ্য করছিলেন যে, ক্লাসে সে নেই কিন্তু তার ব্যাগ আছে। পরদিন মেয়েটি স্কুলে আসার পর শ্রেণি শিক্ষিকা ও হেডমিস্ট্রেস প্রথমে জেরা করে জানেন, মেয়েটি গতদিন স্কুলের সময় বয় ফ্রেন্ডের সাথে কাটিয়েছে। স্বীকারোক্তির পরপর মেয়েটির মা-বাবাকে ফোন করে ডেকে আনা হয়। মেয়ে এবং মা- বাবার বারংবার অনুরোধ এবং ক্ষমা প্রার্থনা সত্বেও মেয়েটিকে সেই মুহুর্তেই টিসি দেওয়া হয়, এটা বলে যে, স্কুলের ডিসিপ্লিন রক্ষার জন্য এই শাস্তি দিতেই হবে। মেয়ে এবং তার মা চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে যাচ্ছে, এ দৃশ্য এখনো আমি দেখতে পাই। আরেকদিন দশম শ্রেণীর একটি মেয়েকে টেস্ট পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হেডমিস্ট্রেস ছোটদের সামনে চড় মারেন, ভ্রু প্লাক করার অপরাধে! আমাদের, অভিভাবকদের, কখনোই মনে হয়নি যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেয়া হচ্ছে।
আমার ছেলের স্কুলেও ছিল নিয়মের কড়াকড়ি। সেখানে বছরের নির্দিষ্ট তারিখে শীতকালীন এবং নির্দিষ্ট তারিখে গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরা শুরু করতে হত। এর ব্যত্যয় হলেই শাস্তি। সেই স্কুলেও মোবাইল নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, পাওয়া গেলেই শাস্তি। স্কুলের অধ্যক্ষ সামরিক বাহিনীর ছিলেন তাই সব সময় ছাত্রদের চুল সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো ছোট করে কাটতে হতো। শিক্ষক যদি কারো চুল মুঠি করে ধরতে পারতেন, তাহলে সেই চুল গরু চোরের মতন করে কেটে দিতেন। এই স্কুলেও টিসি দেওয়া হতো অনেককে, হরদম।
টিসি দেবার সিস্টেম শুধু ভিকারুন্নেসা স্কুলে নয়, যেসব স্কুলে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তি হতে হয়, সেই সব স্কুলেই টিসি দেবার এই সিস্টেম আছে। এটা তৈরি করেন স্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বাররা। (পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, অরিত্রির বাবা-মাকে যখন অপমান করা হয়, তখন অধ্যক্ষের রুমে গভর্নিং বডির মেম্বারও বসে ছিলেন)। এর কারণ যতটা না ডিসিপ্লিন রক্ষার্থে তার চাইতে বেশি অর্থ লোভে; একজনকে টিসি দিলে আরেকজনকে ভর্তি করা যাবে বিশাল অর্থের বিনিময়ে। ভিকারুন্নেসা স্কুলে মাঝে মাঝে যেসব ছাত্রী ভর্তি করা হয়, শোনা গেছে তাদের কেউ কেউ পনের লক্ষ টাকার বিনিময়েও ভর্তি হয়েছে। সুতরাং টিসি দেবার এই সিস্টেম পাল্টানো যাবে না, তাই ছাত্রীদের চেষ্টা করতে হবে এমন কিছু না করার যাতে টিসি দেয়া হতে পারে। মা-বাবার উচিত মেয়েকে সতর্ক করা, যাতে সে স্কুলের নিয়ম না ভাঙ্গে, ভাঙলেই বিপদ!
ভিকারুন্নেসায় পরীক্ষার হলের নিয়ম হল, একটা ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগে শুধু কলম, পেন্সিল, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি নেয়া যাবে; এ ছাড়া আর কিছু নেয়া নিষিদ্ধ। অরিত্রি সেটা জেনেও মোবাইল নিয়ে গিয়েছে। স্পষ্টতই লুকিয়ে নিয়েছে। কেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
যখন তার মা-বাবাকে স্কুলে পরদিন দেখা করতে বলা হয়, তখন তাদের এটা না বোঝার কোন কারণ ছিল না যে, অরিত্রির টিসি দেবার জন্যই তাদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। এটা বোঝার পর অরিত্রির সাথে তাদের আচরণ কেমন ছিল জানার কোন উপায় নেই। হয় তারা আদর করে মেয়েকে বলেছেন, "কোন ব্যাপার না", অথবা তারা পরিচিতের লোকজনের কাছে ছোট হয়ে যাবার ভয়ে, নিজের মনের জ্বালা মেটাতে সারারাত মেয়েকে বকাঝকা করেছেন, তারপর সকালে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন।
ভালো হতো যদি তারা অরিত্রিকে শেখাতেন মাথা উঁচু করে চলতে; অন্যায় আচরণ না করতে, এবং জীবনে যদি আঘাত- অপমান আসে, তবে তার মোকাবেলা করতে। কোন মা-বাবার কি উচিত, সন্তানকে কারো পা ধরতে দেয়া!
অরিত্রির বাবা বলেছেন স্কুলে তাদের এত অপমান করা হয়েছে দেখে অরিত্রি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তারা কেন মেয়েকে একা ছেড়ে দিলেন? পত্রিকার খবরের দেখা যাচ্ছে, অরিত্রি মা বাবার আগেই বাড়ি ফিরে এলো এবং মা বাবা পৌঁছে দেখলেন অরিত্রি গলায় ফাঁস দিয়েছে। অরিত্রি তো মা বাবার সাথে ছিল, সে যখন একা বাড়ি ফিরলো, সে সময় মা বাবা কোথায় গেলেন? অরিত্রি একা বাড়ি ফিরল কেন এবং কি করে? তার কাছে কি বাড়ির চাবি ছিল যে ঘরে ঢুকলো, নাকি অন্য লোকজন বাসায় ছিল যারা দরজা খুলে দিয়েছিল? অরিত্রি যখন ঘরে ঢুকে ফাঁস দিচ্ছিল তখন সেই লোকজন কি করছিলেন? যদি ঘরে অন্য কেউ দরজা না খুলে দিয়ে থাকে, সে নিজে চাবি দিয়ে খুলে থাকে তাহলে মা-বাবা তাকে চাবি দিলেন কেন, একা একা ঘরে ফেরার জন্য? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও জানা দরকার। তাহলেই জানা যাবে দুর্ভাগ্যজনক এই মৃত্যুর দায় কি শুধুই স্কুলের সিস্টেমের আর শিক্ষকের, নাকি বাবা মায়েরও কিছু আছে! !