মাধবপুরে বন, পাহাড় আর হ্রদের মিলনমেলায়
অপরূপ লাউয়াছড়া বনে
ঈদের দ্বিতীয় দিন রাত সাড়ে দশটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমমেট ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিপ্লবের বিয়েতে যোগদানের জন্য আমার তখন বসে থাকার কথা উত্তরবঙ্গগামী কোন বাসে। কিন্তু আমি ও আমরা সায়েদাবাদ থেকে চড়ে বসেছি শ্রীমঙ্গলের বাস শ্যামলীতে। আমরা মানে আমি, সাকিব, শান্তনু, নাহিদ আর আরিফ। গন্তব্য হামহাম ঝর্ণা। বেশ কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকা, ফেসবুক আর ব্লগে ঝর্ণাটি সম্পর্কে জেনে জায়গাটিতে যাওয়ার একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই ঈদের ছুটিতেই স্বচক্ষে ঝর্ণাটি দেখতে পাবো! বড়ই বিচিত্র মানুষের ভাগ্য!
হামহাম সম্পর্কে বন্ধু আরিফ তেমন কিছূই জানত না। তাই বাসে উঠেই সবাই মিলে একটা ব্রিফিং দিলাম । স্বভাবতই সবাই মিলে একটু বাড়িয়ে বলতে ভুল করলামনা। জোঁক, সাপ থেকে শুরু করে চিতাবাঘও নামিয়ে আনলাম রাজকান্দি বনে। হামহাম ঝর্ণা দেখতে হলে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে এই বন। হামহাম ঝর্ণার একাধিক নাম রয়েছে। অনেকে এ ঝর্ণাটিকে হাম্মাম ঝর্ণা বলে। অনেক কাল আগে নাকি হামহাম যাওয়ার পথে রাজকান্দি বনে চিতাবাঘ দেখা যেত। তাই স্থানীয়রা ঝর্ণাটিকে চিতা ঝর্ণা নামেও চেনে। যাই হোক সবকিছু শোনার পর আরিফের বক্তব্য ছিলো- ‘জোঁক আছে শুনে আমি খুশি হয়েছি। আমি পোকামাকড় পছন্দ করি। শুধু একটি বিষয় নিশ্চিত করে বল তো জোঁকে ধরলে শরীরে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর কোন সম্ভাবনা কী আছে ?’ আরিফের এ প্রশ্নে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম!
রাতের বাস জার্নি। তাই যাত্রাপথে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারলাম না বলে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। তবে রাস্তার দু’পাশে যে সারি সারি চা বাগান পেছনে ফেলে আমরা ছুটে চলেছি তা ঠিকই অনুভব করছিলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেছি। হোটেল উজান-ভাটিতে বিরতি সহ শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে মোট সময় লাগলো চার ঘণ্টা। রাত তখন প্রায় তিনটা। শান্তনুর মামাতো ভাই প্রীতম আমাদেরকে বাস স্ট্যান্ড থেকে ওর বাসায় নিয়ে গেলো। উত্তেজনায় হইচই আর গল্প করতে করতে কেউ আর ঘুমুতে পারছিলামনা। তাই এক ঘন্টার তন্দ্রা শেষে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করে তৈরি হয়ে নিলাম।
রওনা হওয়ার সময় দেখলাম আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৭। প্রীতমের বন্ধুরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো হামহামে যাবে। আমরা শুধু ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। সবাই মিলে চড়ে বসলাম ভাড়া করা গাড়িতে। ভেবেছিলাম বয়সে বছর পাঁচেক ছোট এই অপরিচিত ছেলেগুলোর সঙ্গে আমরা ঠিক খাপ খাওয়াতে পারবোনা। কিন্তু ওরাই আমাদের আপন করে নিলো। তাই সারাটা পথ কাটলো হইচই আর গানে গানে। ওদের উচ্ছ্বাস দেখে ফিরে গিয়েছিলাম ক্যাম্পাস জীবনে। বুকের ভেতর চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলাম।
লাউয়াছড়া বনের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, টিলা, কাঠের গুড়ি দিয়ে বানানো ছোট ছোট সাঁকো পেরিয়ে আর নাম না জানা হাজারো পাখির কলতানকে সঙ্গী করে আমরা প্রায় দেড় ঘন্টা পর পৌঁছালাম কলাবাগান। কমলগঞ্জ পৌরসভার মোড় থেকে আদমপুর রোড ধরে কলাবাগান পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুড়মা বাগান পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। কুড়মা বাগান থেকে কলাবাগান পর্যন্ত বাকি পথটা কাঁচা রাস্তা। যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়বে প্রাচীন চম্পারায় চা বাগান। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চা শ্রমিকদের ছোট্ট একটি গ্রাম এই কলাবাগান । এখান থেকে একজন স্থানীয় লোককে গাইড হিসেবে নিয়ে নিতে হয়। দুর্গম হাম্মামের পথে এ ব্যক্তিই হবে আপনার পথ প্রদর্শক। আমরাও পাঁচশত টাকা দরে একজন গাইড ঠিক করে নিলাম।
এখান থেকেই শুরু হলো আমাদের মুল অভিযান। পাহাড়ি রাস্তায় চা-বাগান আর বড় বড় গাছের সারিকে পাশ কাটিয়ে গুনগুন করতে করতে আমার হেঁটে চলছিলাম। তখনও জানিনা আমাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে! গাইড সবাইকে সতর্ক করে দিলো সামনে জোঁক থাকতে পারে। কিন্তু জোঁক নয় কিছুদূর এগোতেই আমাদের সামনে পড়লো সেই ঘেন্নাধরা ভয়ঙ্কর সরীসৃপ। সাপ! দলের একজন একবারে সাপ মহাশয়ের উপর তার পদচিহ্ন এঁকে দিলো। কিছুক্ষণের জন্য আতঙ্কে আমরা চুপসে গেলাম। গাইড জানালো ভয়ের কিছু নেই। সাপটি অত বিষাক্ত নয়, আকৃতিতেও ছোট। কিন্তু তারপরও আমাদের ভয় কাটলো না। বাকিটা পথ অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি নিয়েই হেঁটে চললাম। শুরু হলো ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল পথ। সঙ্গে মশা আর মাছির সাড়াশি আক্রমণ। কোন রকম গা বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে থাকলাম রাজকান্দি বনের গভীর থেকে আরো গভীরে। আতংক ভুলে আমরা নিজেদের সমর্পণ করলাম প্রকৃতির বুকে। বুনো এক নির্জনতার মাঝেও প্রকৃতি যেন শুনাচ্ছিল তার সুখ-দু:খের গল্প। হঠাৎ হঠাৎ সুমধুর কন্ঠে ডেকে উঠছিলো নাম না জানা পাখিরা । শুধু পাখি নয় পোকামাকড়ের সরব উপস্থিতিও অনুভব করতে পারছিলাম আমরা। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু গিরিখাত, কখনও পাহাড়ি ছড়া, কখনও ছোট ছোট টিলা পেরিয়ে আমরা ছুটে চলেছিলাম প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে নিজেদেরকে সঁপে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
ঘন্টাখানেক হাঁটার পরই পেলাম প্রথম ঝিরিপথ বা ছড়া। এরকম অনেকগুলো ছাড় পার হতে হয়েছে আমাদের । কোথাও হাঁটু কোথাওবা কোমর পর্যন্ত পানি। এসব ছড়ার উৎস নাকি হামহাম ঝর্ণাই।
প্রায় দেড় ঘন্টার মত হাঁটার পর আমরা যখন রীতিমত বিধ্বস্ত তখন সামনে পেলাম বেশ খাড়া একটা টিলা এবং আরো ঘন্টা দেড়েকের হাঁটা পথ। টিলার ঢাল দেখে আমাদের অর্ন্তআত্মা কেঁপে উঠলো। একজন তো ফিরতি পথেই হাঁটা ধরলো। হাম্মাম ঝর্ণা দেখার খায়েশ তার এখানেই মিটে গেছে। বাকিরা আল্লাহর নাম নিয়ে টিলা বাওয়া শুরু কললাম । একরকম হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠলাম। অনেকেরেই হাত-পা কেটে গেলো। উপরে উঠে যখন পেছন ফিরে চাইলাম মাথাটা পুরো ঘুরে গেলো। সম্পুর্ণ পিচ্ছিল পথ। একটু অসতর্ক হলেই গড়িয়ে একবারে নীচে। আর নীচে বরণ করে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ছোট বড় নানা আকৃতির সব পাথর। পড়লে আর রক্ষা নেই। এ পথে আর যাই হোক ফেরা সম্ভব না। আমরা টিলাটার নাম দিলাম ‘মৃত্যুপাহাড়’। যদিও টিলাটার প্রকৃত নাম নাকি 'মোকাম টিলা'। টিলাটা পেরিয়ে সামনে আবার পেলাম ঝিরিপথ। পিচ্ছিল পাথর-কাদামাটিতে সবাই কতবার যে আছাড় খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। শরীরে আর এতটুকুন শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমাদের দলের একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লো। ভয় পেয়ে গেলাম। পরে গাইড ওকে ধরে ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। এভাবে আরো মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর জলপতনের ধ্বনি কানে এলো। গাইড জানালো আমরা গন্তব্যের খুব কাছে চলে এসেছি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দেখতে পেলাম ঝর্ণাটা। অবর্ণনীয় কষ্টটা বৃথা যায়নি। প্রকৃতি তার সব রূপ যেন ঢেলে দিয়েছে আমার বাংলাকে। তারই এক অপূর্ব নিদর্শন এই হামহাম ঝর্ণা। আবারো মনে হলো দুর্গমতাকে জয় করে প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে ফেরার মত আনন্দের আর কিছূই নেই। ১৪৭ ফুট (মতান্তরে ১৬০ ফুট) উচুঁ থেকে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। আর নীচে জলতরঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব এক নৃত্য। কেওক্রাডং যাওয়ার পথে চিংড়ি ঝর্ণা নামে এরকম একটি ঝর্ণা পড়ে । কোনটা সবচেয়ে বড় সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এমনকি মাধবকুন্ডের ঝর্ণাও এর চেয়ে ছোট, ১৩২ ফুট।
আমাদের দলের বেশিরভাগ সদস্যই আমার আগেই ঝর্ণায় পৌঁছে গিয়েছিলো। গিয়েই গা ভিজালাম ঝর্ণায়। ঝর্ণায় আধ ঘন্টার মত সময় কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু ফেরার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো কী করে পেরুবো ‘মৃত্যুপাহাড়’! আমাদের হাঁটার গতি এবার অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। টিলার কাছে এসে আল্লাহর নাম নিতে শুরু করলাম আবার। প্রায় বসে বসে নামতে শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর দেখলাম একটা লোক দড়ি বেঁধে দিয়েছে নামার জন্য। লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেলো। দড়িটা না থাকাল আমরা অনেকেই হয়ত নামতে পারতাম না। এ জায়গা পার হওয়ার পর মনে হলো যাক অবশেষে হামহামকে জয় করতে পেরেছি। এরপর আরো অনেকক্ষণ হাঁটতে হলেও মন ছিলো ফুরফুরে। ফেরার সময় দ্রুতই কলাবাগান চলে এলাম। তবে এবার আমাদের দলের সদস্যরা জোঁকের শিকার হলো। একজনকে তো একসঙ্গে দশটা জোঁকে ধরলো। বীভৎস দৃশ্য! আমাদের আরিফকেও একটা জোঁকে ধরলো। অবশেষে নানা ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। এবার ফিরতে হবে শ্রীমঙ্গলে। ফেরার পথে আরিফের বক্তব্য ‘আই এম থ্যাঙ্কফুল টু জোঁক। তোরা এত গল্প করলি আর একটা জোঁকও না কামড়ালে তো হামহাম ঝর্ণা জয়ের মজাটাই পানশে হয়ে যেত!’
(ছবিগুলো আমার এবং বন্ধু সাকিব এর ক্যামেরায় তোলা)
২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ দৈনিক সমকালের মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র শৈলীতে ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত
***আমার যত ভ্রমণ ও ছবি ব্লগ ***