নদীর তীরে থেমে থাকা স্টীমার
বছর কয়েক আগে খুলনা গিয়েছিলাম বেড়াতে। যাবার সময়ই আমি বলেছি আসার সময় কিন্ত স্টিমারে ফিরবো ঢাকায়। ঢাকা বরিশাল রুটের বড় বড় লন্চে চড়েছি অনেকবার, কিন্ত কোনোদিন স্টিমারে চড়িনি, তাই আমার আগ্রহ খুব বেশী ছিল। ছোটো বেলা থেকেই কত শুনেছি গাজী, অস্ট্রিচ, লেপচা নামের স্টিমারের গল্প। নদীর তীর থেকে বা দেশের বাড়ি যাবার ছোট ছোট লন্চ থেকে দেখেছি বড় বড় চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে তারা পানি কেটে কেটে রাজকীয় চালে।
কোরবানির ঈদের বাকী আর দুদিন। স্টিমার পি এস মাহ্সুদ এর টিকেট কাটা হোলো। আমরা ছিলাম রূপসার পাড়ে আইডাব্লিউটিএর রেষ্ট হাউজে। অফিসের গাড়ি রাত সাড়ে দশটায় আমাদের পৌছে দিল স্টিমার ঘাটে। ঠিক রাত ১২টায় স্টিমার ছেড়ে আসলো খুলনার ঘাট থেকে। অন্ধকার ঘুট ঘুটে শীতের রাত, ঘন কুয়াশায় চারিদিক মোড়ানো। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে চামড়া ফুড়ে হাড্ডি মজ্জা পর্যন্ত জমে যাবার অবস্হা। কিছুক্ষন ডেকে এসে দাড়াই আবার কিছুক্ষন কেবিনে গিয়ে বসি। সাধারনত বাইরে বসতেই আমি বেশী পছন্দ করি। কিন্ত এই ভয়ংকর শীত আর অন্ধকার আমার স্টিমার ভ্রমনের প্রচন্ড উৎসাহের উপর যেন পানি ঢেলে দিচ্ছে। জাহাজে যাত্রীর পরিমানও খুব কম।কারন সবাই তো যার যার দেশের বাড়ি চলে এসেছে, ঢাকায় যাচ্ছে কজন আমার মত!
যাই হোক সেই গভীর অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা তার মধ্যেই ইন্চি ইন্চি করে এগোচ্ছ স্টিমার। কি ভাবে যে সারেং সেই জলযানকে চালাচ্ছে বলতে পারবোনা। আমার হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরলাম, নাহ দেখা যাচ্ছেনা।তখন রীতিমত আমার ভয় করছিল। ভাবছিলাম এখন যদি কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খায়, পি, এস, মাহসুদের যা অবস্হা টুকরো টুকরো হয়ে পরাটা সময়ের ব্যাপার। মংলা পোর্টের কাছাকাছি এসেছি মনে হলো। জেটির বাইরে ওখানে অনেক বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজ নোঙর করা। দোতালার ডেকের একবারে মাথায় দাড়িয়ে থেকে একজন নির্দেশ দিচ্ছে (তাকে বোধহয় পাইলট বলে) সেই অনুযায়ী সারেং চালাচ্ছে।
হঠাৎ একটা ছোট্ট স্পিডবোট আমাদের স্টিমারের সামনে দিয়ে আড়াআড়ি যাবার সময় এক লোক চিৎকার করে বলে গেল:
'সাবধান, সাবধান, আরেকটু ডাইনে, আরেকটু ডাইনে কাটোওওওওও'।
ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে জরাজীর্ন পিএস মাসুদ কোনোমতে ডানদিকে একটু টার্ন নিতে না নিতেই বিশাল এক জাহাজের একেবারে পাশ ঘেষে যেতে লাগলো।আমাদের স্টিমারটা কিন্ত ঐ জাহাজটার মুখোমুখি আসছিল।ঐ লোকটা সাবধান না করলে কি হতো আল্লাহই জানে। নোঙ্গড় করা এই জাহাজটির বিরুধ্বে কেস থাকায় অনেক দিন ধরেই ওখানে ওটা আটকে আছে। বাতি নেই, মানুষ নেই, অন্ধকার ঘন কুয়াশার ভেতরে পরিত্যাক্ত, কালো রঙের সেই বিশাল দানবাকৃতির সামুদ্রিক জাহাজটিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাইরেট অব দ্যা ক্যারিবিয়ানের জলদস্যু জ্যাক স্প্যারোর সেই ভুতূড়ে জাহাজটি।
আমরা যখন মংলা নৌবন্দরের কাছে পৌছুলাম হঠাৎ কুয়াশা কেটে গিয়ে আলো ঝলমলে রোদ।তখন বুঝলাম বেশ বেলা হয়েছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই ঘন কুশায়ার চাদর অবিকল অমনি রয়েছে সেখানে। মংলায় কিছু লোক উঠলো কিছু নামলো।
আবার যাত্রা শুরু বরিশালের দিকে। মংলার পরে এখান কার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটা সুন্দরবনের মত। অবিরত জোয়ার ভাটার খেলা চলছে। গোলপাতা গাছ দেখা যাচ্ছে নদীর দুই পারে। চরের মধ্যে ঘর বেধেছে কিছু কিছু পরিবার। বাশের আড়ায় জাল আর চালা্র উপর শুটকি রোদে শুকাচ্ছে। তাতে বুঝে নিলাম হয়তো জেলে পরিবার। আবার গোলপাতা কেটে বিক্রি করে তাও হতে পারে কে জানে !
এরপর আমাদের স্টিমার আসলো সেই বিখ্যাত বিশাল বলেশ্বর নদে। যার এক দিকে শ্মরনখোলা রেন্জ, অন্যদিকে মঠবাড়িয়া, বরগুনা। এই নদের উপর দিয়েই ধেয়ে এসে ছিল ভয়ংকর ঘুর্নিঝড় সিডর, রাতভর যার উন্মত্ত তান্ডব আর ছোবলে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল গোটা উপকুলীয় এলাকা।
বলেশ্বর নদ পেরিয়ে বা দিকে মঠবাড়িয়া লঞ্চঘাট রেখে আমরা এসে পৌছালাম ছোট এক নদীতে।এই ছোটো ছোটো নদীগুলোর পাড়ে কত বসত বাড়ি। চারি দিকে সবুজের সমারোহ, নারিকেল আর সুপারির গাছে ছেয়ে আছে দু পাশ। নিরিবিলি শান্ত দুপুর বেলায় সেই ছায়া ছায়া নদীর ঘাটে মেয়েরা হাড়ি পাতিল মাজছে, কাপড় ধুচ্ছে,সারছে দৈনন্দিন গৃহস্হালীর কাজ, কিছু লোক গরু নিয়ে এসেছে নদীতে গোসল করাতে,বাচ্চারা নদীর উপর ঝুলে থাকা গাছগুলো থেকে লাফিয়ে পড়ছে। গ্রামের মানুষের এই প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার চালচিত্র আমি সানন্দে এবং কৌতুহল নিয়ে উপভোগ করছি।উপভোগ আমি করছি কিন্ত তাদের মনে হয়তো কত দুঃখ, কত কস্ট, কত বন্চনার ইতিহাস, কত পাওয়া না পাওয়ার করুন গাঁথা লুকিয়ে আছে তার হিসাব কি কেউ রাখে?
শান্ত নিস্তরঙ্গ জল কেটে কেটে গাবখান চ্যানেল অতিক্রম করে বরিশালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মাহ্সুদ।বিকালে বরিশাল ঘাটে ভিড়লাম। ব্রিটিশ আমল থেকেই বরিশাল হলো স্টিমার কোম্পনীর হেড-কোয়ার্টার, তাই সেখানে তার আভিজাত্য আর মর্যাদা বেশী।তারই নমুনা হিসেবে পুরানো একটা শতচ্ছিন্ন সতরন্জি বিছিয়ে দিল যাত্রী উঠা নামার পথে। বেশির ভাগ লোকই নেমে গেল। একা এক অল্প বয়সী বিদেশীনি পরিব্রাজক মংলা থেকে উঠেছিল, সেও বরিশাল দেখার জন্য নেমে গেল। তাকে ঘিরে ধরলো কিছু তরুন যুবক। মেয়েটাকে নিয়ে ভাবলাম তারপর মনে হলো সে একা একা ঘুরছে তাঁর মানে সে নিজেকে রক্ষা করতে জানে। ধীরে ধীরে দূর দিগন্ত জুড়ে সাঝের আধার নেমে আসছে। সুর্য্যদেব তাঁর দিনের পরিক্রমা শেষ করে পর্দা টেনে ঘুমানোর আয়োজন করছে যেন। মাগরিবের আযান শেষে কীর্তনখোলা নৌবন্দর ছেড়ে ঢাকার দিকে রওনা হলো পি এস মাহ্সুদ।
অনেক রাতে চাঁদপুরে শেষ যাত্রীটাও বোধহয় নেমে গেল আর কেউ উঠেনি।কেনই বা উঠবে সকালেই ঈদ। খালি স্টিমার মেঘনার তিন নদীর মোহোনায় দুলে দুলে উঠছে, ভয় লাগছিল কারন সাতার আমি জানিনা আর জানলেই বা কি এই বিশাল মহাসমুদ্রে !
আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছি চিরচেনা সেই ঢাকার দিকে। নদীপথের দুইপাশের দৃশ্য অন্ধকারে অদৃশ্য, তারপরও অন্ধকার ফুড়ে দেখার চেস্টার কোনো কমতি নেই আমার যা আমার হাজার বার দেখা।খুব ভোরে বাদামতলীর ঘাটে ভিড়লো দুই রাত একদিন ভ্রমনের পর।
নেমে আসলাম ঈদের সকালে ...