দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি খারাপ, খুবই খারাপ। মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ। প্রতিদিন মানুষ প্রাণের ভয়কে সঙ্গী করে ঘর থেকে বাহিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। খোয়াড়ের মধ্যে থাকা দেশী মিডিয়া এ অবস্থার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করছে বিরোধীদলের অতর্কিত বোমাবাজীকে। কিন্তু এ অবস্থার জন্য আরো বেশি দায়ী আরেকটা ভয়, তুুলনামূলকভাবে অনেক বড় ভয়- সেটা হচ্ছে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর "নির্বিচারে হত্যা" বা ক্রসফায়ার।
প্রতি সপ্তাহেই খবরের কাগজে ছাপছে ক্রসফায়ারের বানোয়াট গল্প যেখানে বলা হয় আসামীকে নিয়ে রাতের বেলায় তদন্তকার্যে বের হলে আসামী এবং তারপক্ষের লোকজন অতর্কিতে পুলিশকে আক্রমণ করে। পুলিশ সেই আক্রমণকে প্রতিহত করতে গেলে পুলিশের গুলিতে আসামী নিহত হয়। এমন গল্প যে তাদের বিনাবিচারে হত্যা'কে আড়াল করতে পারেনা, এইটা সকলেই জানে। সবার কাছেই ক্রসফায়ার তাই পুলিশী হত্যাকান্ডই। অনেকে না-বুঝে নিজেদের নৈতিকতাকে দলীয় স্বার্থের কাছে সমর্পণ করেছেন বলে এখন ক্রসফায়ারকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু এই অস্ত্রের বলে পুলিশ যখন সমস্ত জনগণের উপর ফ্রাঙ্কেন্টাইন হয়ে চেপে বসেছে, ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার আম-জনতাকে "গ্রেফতার বানিজ্যের" শিকারে পরিণত করে নিঃস্ব করে ফেলছে, তখনও কি তাদের সমর্থন দিয়েই চলবেন?
বোমাবাজী নিঃসন্দেহে অপরাধ। অতএব, বোমাবাজকে ধরার জন্য আইন আছে, আইনপ্রয়োগকারী পুলিশ আছে, আদালত আছে, কারাগার আছে। কিন্তু ক্রসফায়ারের মাধ্যেমে মানুষ হত্যাকারী পুলিশের জন্য কি আছে?
একটা আড্ডায় আলাপ হচ্ছিল দেশের বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে। রাস্তাঘাটে বোমা-হামলার সমালোচনায় অনেককে পেলাম। বেশ জোড় গলায় তারা বোমাবাজির সমালোচনা করলেন, আর সেই সাথে বিরোধীদলকেও। কিন্তু যেইমাত্র পুলিশের নির্বিচারে হত্যার প্রসঙ্গে আসলাম, তারা দেখলাম বিভিন্ন ভাবে প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করছেন। ক্রস ফায়ারের হত্যা কি তবে অপরাধ নয়? মানবাধিকারের লংঘন নয়? এই ভয় দেখিয়ে পুলিসের গ্রেফতার ও চাঁদাবাজী বানিজ্য কি তবে অপরাধ নয়?
ভাইরে, দ্বিমুখীতা খুব খারাপ অসুখ। শরীরের নয়, আত্মার। এই অসুখ ব্যক্তিবিশেষের মাঝে সব সমাজেই থাকে। কিন্তু সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি যখন এই অসুখে আক্রান্ত হয়, তখন সেই জাতির নের্তৃত্ব মিথ্যাচারীর হাতেই আসবে, এবং তাদের পরিচালনায় সেই জাতির ধ্বংসও অনিবার্য।
গতকাল সব পত্রিকায় দেখেছিলাম আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাতের সময় তারা নাকি বলেছে যে, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা একেবারেই উদ্বিগ্ন নয়। অথচ, এখন দেখলাম মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ডঃ মিজানের কাছে তারা বেশ ক্ষোভের সাথে বলেছেন যে, মন্ত্রী তাদের নিয়ে মিথ্যা বলেছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে চরমভাবে উদ্বিগ্ন। মন্ত্রীর ভাষ্য সকল পত্রিকা ফলাও করে প্রচার করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবাদ এই সংবাদ ছাপিয়েছে মাত্র ২/৩টা ছোট পত্রিকা (আমাদের সময়, মানবজিমন)। কেন, সেইটা নিজগুণে বুঝে নিন।
বিরোধীদল খারাপ কারণ তারা বোমাবাজী করে নিরীহ পথচারীদের মৃত্যু ঘটাচ্ছে, সরকার খারাপ কারণ তারা পুলিশকে বিরোধীদল দমনে লেলিয়ে দিয়েছে যা' এখন পাগলাকুত্তার মতো আম-জনতাকে কামড়াচ্ছে। কিন্তু আপনি/আমি কি? আমরা কি এইসব অন্যায়, অপরাধের প্রতিবাদ করছি, না-কি দলবুঝে তারপর একবার সমালোচনা এবং আরেকবার সমর্থন করছি?
বিরোধীদল বা সরকারকে দায়ী করার আগে নিজেকে বিবেকের আয়নায় সামনে দাড় করান। তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করুন- আমার বিবেক ঠিকঠাক মতো আছে ত'? থাকলে সেটাকে কি দলীয় স্বার্থের কাছে বিকিয়ে দিয়েছি?
অন্যের সমালোচনা করার আগে আত্মসমালোচনা জরুরী। নিজের যদি বিবেক স্বাধীন থাকে, তবেই স্বাধীনতা আশা করতে পারি। অন্যথায় মিথ্যাচারী নের্তৃত্বে অধীনে, আইনপ্রয়োগকারীর হাতে বেআইনি হত্যার বলী হয়ে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়াই অনিবার্য পরিণতি। দেশের খাঁচায়-পোড়া মিডিয়া এই সত্য প্রকাশ করতে না-পারলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খবরের কাগজ ইতোমধ্যেই এই হতাশাজনক অবস্থার খবর প্রকাশ করেছে।
অতএব, নিজের বিবেককে জাগ্রত করুন। যাবতীয় অন্যায়কে সক্রিয়ভাবে "না" বলুন। সমাজ বা দেশটা কোন বিশেষ দলের নয়, আমাদের সকলের। তাই একে রক্ষা করার দায়িত্বও সম্মিলিতভাবে আমাদের সকলেরই।