২০১২ সালের ৬ই আগস্ট এক ক্লান্তিকর রোজার দিনে শ্বাসরুদ্ধকর এনাটমির সফট পার্টের ভাইভা শেষ হইল । এর পরের কয়েকদিন শুয়ে বসে থাকা ছাড়া আর তেমন হাতি ঘোড়া মারা হয়নি । অল্প কিছুদিন অপর আমার উপলব্ধি হল, হাতে তো ম্যলা সময় আছে, এই ফাঁকে কোথাও ঘুরে আসলে কেমন হয় । কত আন্ডাবাচ্চা, ফার্মের পুলাপানরা দেখি বাবা-মার সাথে দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরে আসে । আমার বাবা-মা সম্পূর্ণ তার উলটা । কোনখানে যাওয়ার কথা কইলেই বলে, “যাও ঘুরে আস, কে মানা করেছে???” । বাপজান তো আরো এককাঠি সরেস, টিটকিরির সুরে কয়, “যেখানে খুশি যাও, তোমরা মুক্ত, স্বাধীন । ” কিন্তু এইবার আমি কোন কথাকেই পাত্তা দিলাম না । কার কার সাথে কোথায় যাওয়া যায় সেই কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । আমার প্রথম প্রে... ইয়ে পছন্দ ছিল সিলেট । জাফলং, শ্রীমঙ্গল, লালাখাল ইত্যাদি জায়গার নাম শুনলেই তো ছুটে যেতে ইচ্ছা করে । আমি কয়েকজনকে জানানোর ব্যবস্থা করলাম । কিন্তু তখন ঈদ আসি আসি করছে । আগে যাওয়া অসম্ভব, ঈদের পরেও আমাদের শাহজালাল ভার্সিটির বন্ধুদের থাকার কথা নয় । চেনা পরিচিত লোকজনএর অভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সিলেট যেতে রাজি আছে আমিসহ দুইজন!
আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল । এতদিন জানতাম আমি একটু অন্তর্মুখী । কিন্তু আমার চাইতেও যে আরো “অলসদেহ, ক্লীষ্টগতি, গৃহের প্রতি টান......” লোক থাকতে পারে তা প্রথম এক্সপেরিয়েন্স করলাম । মেজাজ টেজাজ খারাপ করে বসে আছি এমন সময় একজন খুলনা যাওয়ার প্রস্তাব পাড়ল, আমাদের একজন নাকি প্রায়ই খুলনা যায় । আমার নতুন জায়গা দেখা নিয়েই কথা । তাই আমি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম ।
১৮ তারিখে ২৬ তারিখের ট্রেনের টিকেট কাটলাম । ট্রেন করে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ছিল আমার মতে ভুল । চার জনের ট্রেনের টিকেট কাটা হল । ২৬ তারিখ ভোর চারটার সময় ঢাকার ট্রেন ধরার জন্য বাসা থেকে বের হলাম । ট্রেন ছাড়ল প্রায় পাঁচটার দিকে । ট্রেনের নোংরা গন্ধ, ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে ট্রেনে যাওয়ার ভীমরতি যার মাথায় চেপেছিল তাকে বকতে লাগলাম । দুঃখের ব্যাপার এই যে, যার কারণে ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সে নিজেই শেষ সময়ে ভ্রমণদল থেকে নিজেকে পরিস্কার করে নিয়েছিল । ট্রেনের ভিতরের জঘন্য পরিবেশে আমার একপর্যায়ে দমবন্ধ হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল নাগরিক জীবনের বিড়ম্বনা নিয়ে নির্মিত কোন ভারিক্কি আর্ট মুভির একটা চরিত্র আমি!!! উফফফ!!!
ঢাকায় পৌঁছলাম সাড়ে আটটার দিকে । নাস্তা খাওয়ার সময় মাথায় ভূত চাপল বসুন্ধরা সিটিতে সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে । যেই ভাবা সেই কাজ, কিন্তু বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে দেখা গেল সিনেপ্লেক্স তো বটেই, সাথে ফুড কোর্টও বন্ধ! কিছু ছেলেপিলে এসে নিরাশ মুখে ফিরে যাচ্ছে । তো বাকি পোলাপান মোবাইল ও শার্টের দোকান ঘুরে দেখতে দেখতে আমি কাছেই এক খালার বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসলাম ।
এরপরে দুপুরে গেলাম নভোথিয়েটার । মনের ভুলে মনে হয় আমি নিজেই অথবা অন্য কেউ নভোথিয়েটারের কথা উঠে পড়েছিল । আমাদের এক সদস্যের মাথায় যেন ভূত চেপে গেল, আজ সে নভোথিয়েটারের শো দেখেই ছাড়বে । প্রায় এক দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সে চারটা টিকিট সংগ্রহ করেই ছাড়ল । এদিকে আমি আমার বিশাল ব্যাগ নিয়ে পড়েছি বিড়ম্বনায় । বসুন্ধরা সিটিতেও গার্ড আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল “মামা, ব্যাগে এত কি?” । আর কিছু না চারদিনের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে আসাতেই এত ভয়ংকর দেখাচ্ছিল ব্যাগটাকে । যাই হোক, সিনবাদ সেজে ব্যাগ-দৈত্য ঠেলতে ঠেলতে নভোথিয়েটারের ভিতরে আমি হামাইলাম(মানে প্রবেশ করলাম, এখানে “চুমা” খাওয়ার কথা বলা হয়নাই) । নভোথিয়েটারে বাংলাদেশ সরকারের গুনগান গাওয়া পূর্বক নানা কিসিমের গ্রহতারা দেখানো হল । আমাদের সাথের একজনের জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ আছে, সে নানা হিন্ট দিল । তবে একটা জিনিস বলতেই হবে, নভোথিয়েটারের বিশাল পাতিল(!) আর বিশাল প্রজেক্টরটা আসলেই চরম জিনিস । ভালোই কেটেছে সেই সময়টা ।
নভোথিয়েটার থেকে বেরিয়ে একটা জ্বালার মাঝে পড়লাম । একে ত সিএনজি পাচ্ছি না, তার ওপরে......(না থাক, এই অংশটা বরং বাদ দিই......) । যাই হোক, কোনমতে সিএনজি করে কমলাপুর রেলস্টেশন গিয়ে পৌঁছলাম । সন্ধ্যা সাতটার দিকে ট্রেন ছাড়ার কথা । আমাদের শখের জ্যোতির্বিদ ইতিমধ্যেই ঢাকার বাসায় চলে গেছে(তার খুলনা যাওয়ার কথা ছিল না ।) সাড়ে ছয়টার দিকে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানোর একটু পরেই এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম । জানা গেল ট্রেন লেট করবে । ট্রেন আসল প্রায় নয়টার দিকে । এর মাঝে কমলাপুর রেলস্টেশন মুখস্থ হয়ে গেছে মনে হয় । যাই হোক, অবশেষে ট্রেন মাঝারে স্বীয় গাত্র সেঁধাইয়া দিতে সমর্থ হইলাম আমরা তিনজন ।
(নভোথিয়েটারের ছবিটা ছাড়া বাকি ফটোগুলো আমার বন্ধুর তোলা)
ট্রেন এ সেই ঢাকা-ময়মনসিংহ ট্রেনের মত দমবন্ধ পরিবেশ না থাকলেও খুব একটা স্বস্তিতে থাকার উপায়ও নেই । চিত্রা এক্সপ্রেস নামের এই ট্রেনের জানালার নিচের অংশ বন্ধ, খুব সম্ভবত নিরাপত্তার জন্য এই কাজ করা হয়েছে, কাজেই বাতাস কিছুটা আসলেও সেটা মার্কামারা আর্ট মুভির মত মাথার উপর দিয়েই চলে গেছে ।
ট্রেনের ভিতরে ভ্যাপসা গরম, পিঠ ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে । ট্রেনের সিটে হেলান দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম, সিট নামছে ত নামছেই, তাই সোজা হয়ে যাই আবার । অনেক ইতস্তত করার পর একবার হেলাতেই থাকি, এবার থেমে গেল । সকাল নয়টার দিকে খুলনা রেলস্টেশনে থামার আগে কিভাবে যে ঘুমাইলাম বুঝলাম না । ঈদের পরে লাইনে ট্রেনের খুব চাপ থাকায় ট্রেন যে কতবার থামছে তার হিসাব নাই । আর তখনি ঘুম ভাংত আমার আর আমি ভাবতাম, এত কস্ট করে খুলনা ঘুরতে আসার সিদ্ধান্তটা কি তাহলে ভুল?
(চলবে)
এক ময়মনসিংহনিবাসীর ঢাকা-খুলনা ভ্রমণনামা-১(ঢাকা পর্ব)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন