রোলেক্স ঘড়ির প্রতি ক্যাপ্টেন প্রদীপ বাবুর চিরদিনই একটা দুর্বলতা ছিল এবং বর্তমানেও আছে বৈকি। জাহাজের ক্যাপ্টেন হবার জন্য যে পরীক্ষাটা দিতে হয় সেটা দেবার জন্য অনেক বছর আগে বিলেত পাড়ি দিতে হয়েছিল তাঁকে। তখনকার দিনে বিলেতই ছিল ক্যাপ্টেনগিরি পরীক্ষা দেবার বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র। হংকং, সিঙ্গাপুর বা অস্ট্রেলিয়াতেও এই ক্যাপ্টেনগিরি পরীক্ষা দেওয়া যেত বটে, তবে সেরা জিনিস বলে কথা। ক’টা টাকা বেশী লাগবে লাগুক, তবু বিলেতী সার্টিফিকেট তাঁর নেওয়া চাইই চাই, তিনি হচ্ছেন একজন সৌখিনদার মানুষ। প্রাচীন খানদানী জমিদার বংশের ছেলে। তাঁর দাদার দাদা শুভ্রদীপ বাবু যেবার কলকাতা গেলেন ইংরেজ লাটসাহেব লর্ড কার্জন সাহেবের ডিনারের নিমন্ত্রন খেতে, সেবার আচকানের পকেটে সোনার চেইনযুক্ত সুইজারল্যান্ডের তৈরি দামী ঘড়ি নিয়ে গেছিলেন সে গৌরবময় গল্প ক্যাপ্টেন প্রদীপ বাবু জাহাজের অফিসারদের সামনে প্রায়ই বলে বেশ মজা নেন। যারা এই বস্তাপচা গল্প আগে অনেকবার শুনেছে তারা আস্তে করে কাজের ছুতায় কেটে পড়ার মতলব করে। শেষমেশ শ্রোতা না পেয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে বেচারা ক্যাডেট মদনকেই শ্রোতা হিসেবে নির্বাচন করে ফেলেন এবং তাঁর প্রপিতামহের সেই লর্ড কার্জনের প্রাসাদে ডিনার খাওয়ার গল্প জুড়ে দেন।
ক্যাডেট মদনও অন্যদের মত এই বোরিং গল্প অনেকবার শুনেছে, কিন্তু কি আর করবে বেচারা। ঘুমে তার চোখ ঢুলুঢুলু করছে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটে, তারপরও ক্যাপ্টেন সাহেবকে তেল মারার জন্য সে বলতে থাকে, ও মাই গড, আপনার গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড ফাদার সোনার পকেট ঘড়ি পকেটে নিয়ে লাটসাহেবের বাংলোয় ডিনার খেতে গিয়েছিলেন? হেভি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো স্যার।
আরে মদন, ইন্টারেস্টিংয়ের আর দেখলে কী? আমার দাদা নিষ্প্রদীপ বাবুর কাহিনী শোনাই তাহলে। সেই ব্রিটিশ আমলে হয়েছিল কি - - - - - -।
এমন সময় জাহাজের নেভিগেশন ব্রীজ থেকে একটা জরুরী ফোন আসায় ক্যাপ্টেন সাহেব গল্প ছেড়ে ব্রীজের দিকে ছুটলেন আর মদনও গল্প শোনা থেকে রেহাই পেয়ে হাই তুলতে তুলতে ঘুমাতে গেল সেদিনের মত। ক্যাপ্টেন সাহেবের পূর্বপুরুষদের নামগুলো মদনের বেশ মজারই লাগে। পরদাদা শুভ্রদীপ – দাদা নিষ্প্রদীপ, তারপর বাপের নাম যে সুদীপ বাবু তা সে একদিন ক্যাপ্টেন সাহেবের সিডিসির ভিতর দেখেছিল বটে! দাদার বাপের নামটাও জেনে নিতে হবে একদিন।
তো এই ক্যাপ্টেন প্রদীপ যখন বিলেত গেলেন বিলেতি সনদ নিতে, তখন বড় বড় শপিং মলে দামী দামী ঘড়ির দোকান দেখে তাঁর তো ঘড়ি কেনার বড্ড শখ হল। আহা কি সুন্দর দামী দামী সোনার রোলেক্স ঘড়ি সাজানো আছে থরে থরে। বিভিন্ন মডেলের, বিভিন্ন আকারের। কোন কোনটায় আবার প্রতি ঘণ্টার দাগে দাগে একটা করে হীরা বসানো আছে, সে হীরাগুলো উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারিদিকে। একেকটার দাম দু’হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্য্যন্ত আছে। তাঁর মত একজন খানদানী ব্রিটিশ আমলের জমিদার বংশের সুযোগ্য ছেলে যদি ব্রিটেন থেকে এইরকম একটা রাজকীয় হীরা বসানো রোলেক্স নাই কিনতে পারলো তাহলে তো জীবনই বৃথা। অবশ্য কিস্তিতেও ঘড়ি কেনা যায়, তবে দোকানে খোঁজ খবর নিয়ে প্রদীপ বাবু দেখলেন তিনি যত বড় জমিদার বংশের সন্তানই হোন না কেন তাঁকে বিলেতের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে কিস্তিতে মাল কিনতে হলে। মনের দুঃখে রোলেক্স কেনার চিন্তা বাদ দিয়ে পড়া লেখায় মন দিলেন এবং যথাসময়ে পরীক্ষায় পাস করে দেশের পথে রওয়ানা দিলেন। লন্ডন হিথ্রো বিমান বন্দরের ডিউটি ফ্রি শপের কাঁচের শো কেসের ভিতর দিয়ে শেষবারের মত আবার সেই আগের দেখা মডেলের ঘড়িগুলিকে বিদায় জানিয়ে যখন উড়োজাহাজের দিকে হাঁটা দিলেন তখন বুকের ভিতর এমন কষ্ট অনুভূত হল যেন তিনি তাঁর কয়েক ডজন বিলেতি বান্ধবীকে ছেড়ে যাচ্ছেন।
তারপর অনেকদিন বাদে অনেক দেশ ঘুরে আজ তাঁর জাহাজ এসে ভিড়েছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। সন্ধ্যায় ডিনার সেরে বেশীরভাগ অফিসার ক্রু গেছে শহরে বেড়াতে, শপিং করতে। তিনি বাইরে যাননি আজ, চীফ অফিসার বাইরে গেছে তাই। স্মোক রুমে বসে বসে টিভি দেখছেন এমন সময় রুমে ঢুকল টাই স্যুট পরা কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক। গ্যাংওয়ে থেকে ডিউটি অফিসার তাঁকে গাইড করে নিয়ে এসেছে। ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করতে চান তিনি।
প্রদীপ বাবু তাঁকে বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ মে আই হেল্প ইউ?
ভদ্রলোক কথা শুরু করার আগে বেশ স্মার্টভাবে কোটের হাতাটা সরিয়ে কব্জিতে বাঁধা ঘড়িতে সময় দেখলেন। সোনালী রোলেক্স ঘড়ি। ক্যাপ্টেন প্রদীপ ইংল্যান্ডে অনেক রোলেক্স দেখেছেন। রোলেক্স ঘড়ি দেখতে দেখতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে তাঁর কোন ঘড়ি কোন মডেলের আর কত দামের। এই ভদ্রলোকের রোলেক্সটা কমসে কম সাড়ে তিন থেকে চার হাজার পাউন্ড রেঞ্জের হবে বলেই তাঁর আন্দাজ।
এবার ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন। ‘ক্যাপ্টেন, আমিও তোমার মতই একজন ক্যাপ্টেন। APL এর কন্টেইনার জাহাজে আছি। সমস্যা হয়েছে কি, আমার জাহাজ আউটার অ্যাংকরেজে আছে কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে জাহাজে ফিরে যেতে পারছিনা। শোর লিভ বোট জেটি থেকে ছেড়ে চলে গেছে, আমার দেরী হওয়ার কারণে বোট মিস করেছি। এদিকে পকেটে পয়সাও নাই যে ফোন বুথে গিয়ে এজেন্টকে একটা কল করবো। ভাবছি একটা বোট ভাড়া করে জাহাজে চলে যাব, দু’ঘণ্টা পর জাহাজ সেইলিং, আর আমি ক্যাপ্টেনই যদি জাহাজে না থাকি তাহলে কতবড় কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে না?
ততক্ষণে স্টুয়ার্ড দুই ক্যাপ্টেনকেই চা দিয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে ক্যাপ্টেন প্রদীপ বললেন, বল ক্যাপ্টেন, আমি ক্যাপ্টেন হয়ে তুমি ক্যাপ্টেনের এই বিপদে কী করতে পারি?
তুমি আমার চাকরী, মান সম্মান, ইজ্জত, সব বাঁচাতে পারো মাই ডিয়ার ক্যাপ্টেন। তুমি আমাকে জাস্ট একশোটা ডলার দাও। তাহলে আমি বোট ভাড়া করে জাহাজে চলে যেতে পারবো। এই ডলার ফেরত দেওয়ার সুযোগ জীবনে আর নাও পেতে পারি মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। সে কারণে আমার এই সোনার রোলেক্স তোমাকে উপহার হিসাবে দিতে চাই। ইউরোপ ভয়েজে গত মাসেই কিনেছিলাম এই ঘড়িটা, অরিজিনাল সার্টিফিকেট আর গ্যারান্টি লেটার আমার জাহাজেই আছে কিন্তু তোমাকে দিতে পারছিনা, দুঃখিত।
ক্যাপ্টেন তাঁর হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ক্যাপ্টেন প্রদীপের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
“আরে না না, তুমি ওসব নিয়ে একেবারেই ভেবোনা’ ঘড়িটা প্রায় ছিনিয়েই নিলেন তিনি আগন্তুকের হাত থেকে, তারপর বললেন, তুমি চা খাও, আমি ডলার নিয়ে আসছি’।
কেবিনের দিকে রওয়ানা দিলেন তিনি ডলার আনতে। ইতিমধ্যেই তাঁর হাতে শোভা পেতে শুরু করেছে হীরা বসানো সোনার রোলেক্স। একশো ডলারের একটা নোট আগন্তুকের হাতে দিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বাই বাই বলে বিদায় দিলেন তড়িঘড়ি; পাছে আবার লোকটা মত বদলিয়ে ঘড়ি ফেব়ৎ চায় সেই ভয়ে।
লোকটাকে বিদায় দিয়ে প্রদীপ বাবু আয়েশ করে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর ঘড়িটাকে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। একদম অরিজিনাল রোলেক্স, যেমনটি তিনি দেখে এসেছেন ইংল্যান্ডের আসল রোলেক্সের ডিলারের দোকানে। প্রতিটি হীরা একেবারে নিখুঁতভাবে কেটে কেটে প্রতি ঘণ্টার ঘরে বসানো। শুধু বারোটার ঘরে দুটি হীরা বসানো। বারোটা বেজে যাওয়ার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে না? এই বারোটাতেই দিনের শুরু, দিনের শেষ। তিনি ইচ্ছা করলেই এই জাহাজের যে কারো এমনকি মালিকেরও বারোটা বাজিয়ে দিতে পারেন হুঁঃ হুঁ। কাজেই বারোটায় দুটো হীরা তো থাকবেই! আর খাঁটি সোনার কেসিং এবং চেইন স্পটলাইটের আলোতে এমন ঝকমক করছে যে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হয়। যাক, এতদিনে তাঁর অনেক দিনের লালিত মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। তাও আবার অসম্ভব কম দামে। এরকম সুবর্ণ সুযোগ মানুষের জীবনে ক’বার আসে?
ঘণ্টাখানেকের ভিতর শপিং করতে শহরে যাওয়া অফিসার ইঞ্জিনিয়ারদের দল জাহাজে ফিরে এসে স্মোক রুমে বসলো। ক্যাপ্টেন সাহেব তাঁর নতুন কেনা রোলেক্স ঘড়ি সবাইকে দেখানোর আর ঘড়ি কেনার গল্প শোনানোর লোভ সামলাতে পারছেন না। সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি ফর্সা সুন্দর বাহু চোখের সামনে নিয়ে ঘড়িটায় খুব মনোযোগ দিয়ে সময় দেখার ভান করছেন। এমনভাবে ঘড়ি দেখছেন যাতে সবার দৃষ্টিতে ঘড়িটা পড়ে।
সবার দৃষ্টিতে প্রথমেই না পড়লেও সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের দৃষ্টিতে পড়ল।
সে বলে উঠলো, স্যার আপনিও কিনেছেন এই ঘড়ি?
‘আপনিও মানে? আর কেউ আছে নাকি এইরকম একটা অ্যারিস্টোক্রেটিক দামী ঘড়ি কেনার মত’? ক্যাপ্টেন সাহেব এই সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে একদম দেখতে পারেন না। সবকিছুতেই তার মাতব্বরী করা চাই। নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবে বেকুবটা।
‘না, মানে স্যার, জাহাজের যারা যারা বাইরে গেছিল তাদের প্রায় সবাই এই ঘড়ি কিনেছে। কেউ কেউ তো তিন চারটা করে কিনেছে স্যার। মাত্র পাঁচ ডলার করে দাম স্যার, চারটা কিনলে একটা আবার ফ্রিও দেয়। একদম আসল রোলেক্সের হুবহু নকল স্যার। যারা আসলটা না দেখেছে তারা ধরতেই পারবেনা স্যার কোনটা আসল আর কোনটা নকল। এই দেখুন না আমার হাতেরটা। মাত্র পাঁচ ডলার দাম’।
বাকী সবাই যার যার নকল রোলেক্স বের করে দেখালো। ক্যাডেট মদনও কিনেছে একটা।
ক্যাপ্টেন সাহেব মনের বিষ মনে মেরে ঝিম ধরে বসে রইলেন। শালা নকল ক্যাপ্টেন $৫ এর নকল ঘড়ি গছিয়ে $১০০ মেরেছে, ডলার গেছে তাতে কষ্ট নেই, তবে তাঁর মত জমিদার বংশীয় জাঁদরেল ক্যাপ্টেনকে এইভাবে প্রতারণা করলো সেই লজ্জা তিনি কোথায় লুকাবেন?
লজ্জা আর লুকানো রইলো না। রাত না পোহাতেই জাহাজময় চাউর হয়ে গেল ক্যাপ্টেন সাহেব এক প্রতারকের পাল্লায় পড়ে পাঁচ ডলারের ঘড়ি ১০০ ডলারে কিনেছেন।
ব্যাটা স্টুয়ার্ডের কাজ নিশ্চয়। ঘড়ি কেনার সময় আশেপাশে সে ছাড়া আর কেউ ছিলনা। ব্যাটা হারামজাদাকে নেক্সট পোর্টেই ডিসমিস করে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন তিনি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার অভিযোগ করেছিল তার নামে, সে নাকি ঠিকমত খানা সার্ভ করেনা তাঁকে। অভিযোগটা লগ এন্ট্রি করে হেড অফিসে কপি পাঠাতে হবে আজই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০০