(এটি একটি কাল্পনিক গল্প। কোন ব্যক্তি বা বাস্তব ঘটনার সাথে কোন প্রকার সামঞ্জস্য নেই)
চট্টগ্রাম বন্দরের ১নং গেট পেরিয়ে জেটিতে ঢুকে মহিরুল। তারপর গিয়ে উঠলো আল শারমিন্দা জাহাজে। এই জাহাজে তার স্কুল জীবনের বন্ধু ফানিসুর রহমান চাকরী করে। খুব বড় পোস্টে চাকরী করে। ইঞ্জিনিয়ার পোস্ট। বিদেশগামী জাহাজ এটা। তার দোস্ত এই জাহাজে চড়ে সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান, জাপান আরও কত দেশে যায়; সেসব দেশ থেকে নানান জিনিস আনে। হেভী পোজপাজে চলে ফানিসুর। অ্যাডিড্যাশের স্নিকার, বিদেশী জিনসের প্যান্ট, রিবোক না কী যেন একটা বিদেশী ব্র্যান্ডের শার্ট আর রেবন সানগ্লাস পরে মাঝে মধ্যে যখন সে নিউমার্কেট বা মিমি সুপার মার্কেটে ঘোরে তখন ভার্সিটি বা মেডিক্যাল পড়ুয়া সুন্দরীরা বেশ খানিকটা ইন্টারেস্ট নিয়ে আড় নয়নে তার দিকে তাকায়।
সুন্দরী মেয়েদের এই কান্নি মারাটা বেশ উপভোগ করে ফানিস। সে খুব ডাঁট মেরে মাথার লম্বা চুলগুলোকে সানগ্লাসের সামনে থেকে সরায় মাথা ঝাঁকিয়ে। হাত দিয়ে চুল সরালে আনস্মার্ট লাগে, তাই মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরানো। তারপর মেয়েরা দ্বিতীয়বার তার দিকে তাকায় যখন সে বিদেশী ৫৫৫ বা বেনসন সিগারেট ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে দামী লাইটার দিয়ে বিশেষ কায়দায় ধরায়। কোন মেয়ে পরপর দুইবার এক ছেলের দিকে তাকালে জীবনে আর কিছু চাওয়া পাওয়ার থাকে?
ফানিসের দিকে মেয়েরা এভাবে তাকালে ফানিসের দিলটা কেমন করে তা বাদ দিয়ে আশেপাশের অন্য ছেলেদের মনের অবস্থাটা কেমন হয় সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
তা মহিরুল তার এই দোস্তের জাহাজ আসার খবর পেয়ে এই ভর দুপুরে এসে হাজির হয়েছে জাহাজে। উদ্দেশ্য, দোস্তকে সিল মেরে ভালমন্দ কিছু খাওয়া। এইরকম পাত্তিওয়ালা দোস্তকে সিল মারবে না তো কাকে মারবে?
জাহাজের গ্যাংওয়েতে উঠে ডিউটি সুকানীকে বড় ইঞ্জিনিয়ার ফানিসুর রহমানের নাম বলতেই সুকানী বলল, “ ও, ইঞ্জিন ক্যাডেট ফানিস সাবের কাছে যাবেন? ঠিক আছে, সেকেন্ড ডেকে গিয়ে ২৪ নং কেবিনে নক করুন, ওটাই উনার কেবিন।
মহিরুল জাহাজের অ্যাকোমোডেশনের ভিতর ঢুকে ফানিসের কেবিনের দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে আওয়াজ, “কাম ইন”।
দরজা ঠেলে মহিরুল ভিতরে ঢোকে। আরে দোস্ত হালায় কেমন আছিস – বলে ফানিস ওকে সোফায় বসতে বলে। বাইরের কাঠফাটা রোদ থেকে এসে এই এসি কেবিনের ঠাণ্ডায় মহিরুলের শরীর জুড়িয়ে যায়। এবার কেবিনের ভিতরটায় একবার নজর বুলায় সে। পুরা কেবিনের মেঝে থেকে ছাদ অবধি কেস কেস সাজানো কোক, ফানটা, মিরিন্ডার ক্যান। আরও কয়েক ধরনের ক্যান দেখা যাচ্ছে যেগুলোর নাম আগে কখনও শোনেনি মহিরুল।
এত ধরনের ড্রিঙ্কস দেখে তার রোদে পোড়ানো তৃষ্ণার্ত শরীরটা আনচান করে উঠলো। টেবিলে নানান ধরনের স্ন্যাক্স, কুকিজ আর বাদামের প্যাকেট দেখা যাচ্ছে। আজ দোস্তের কেবিনে বসে সে মজা করে ক্যানের কোক খাবে ঝাল ঝাল বাদাম দিয়ে। খাওয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ জীবনে কয়বার আসে?
ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে সে কোকের দিকে একবার তাকায় আবার দোস্তের দিকে তাকায়। সঙ্কোচ হয় তার, দোস্ত খেতে না বললে সে খায় কিভাবে? খেতে বলার আগেই খাওয়াটা হ্যাংলামির পর্যায়ে পড়ে না? ভাববে ছোটলোক।
তার যতই লোভ হোক প্রথম অফারে সে ভদ্রতা করে না না করবে। তারপর দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার অফার পেলে এমন ভাব দেখাবে যে কোক খাওয়ার ইচ্ছা তার মোটেই নেই, শুধু বন্ধুর অনুরোধে কোকটা সে খাচ্ছে।
কিন্তু ফানিস একবারও তাকে খেতে অফার করছে না। খাবার আর পানীয় পরিবেষ্টিত একটা বুভুক্ষ মানুষ লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর এদিকে ফানিস শুরু করেছে দেশের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা।
“বুঝলি মহিরুল, এই হালার বেহায়া এরশাদ দেশটারে একেবারে শেষ কইরা ফ্যালাইলো। মানুষের পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই আর এরশাদ দুই দুইটা বউ লইয়া সুখ মারাইতেছে। হালার ল্যাওড়াটা কাইটা ফ্যালোন দরকার।
এরশাদের নুনু কাটার ব্যাপারে এই মুহূর্তে মহিরুলের কোন ইন্টারেস্ট নাই, তবে তার কথায় সায় দেয় এই ভরসায় যে সায় দিলেই হয়ত ফানিস তাকে খেতে দেবে একটা কোক। কিন্তু কোক খাওয়ানোর নাম নিশানাও নাই ফানিসের মুখে। সে আরও প্রবল উৎসাহে সরকারের সমালোচনায় মেতে উঠে। কাস্টমস বিভাগ এতই করাপ্টেড যে তারা ঘুষ ছাড়া তার এইসব মালামাল ক্লিয়ার করবে না – আল্লাই এর বিচার করবে – এই বলে ফানিস তার লম্বা বক্তৃতায় একটা সাময়িক বিরতি দেয়।
মহিরুল আর থামতে না পেরে এবার ইতস্তত করে বলেই ফেলে, “দোস্ত, খুব তিয়াস লাগছে, একটু পানি খাওয়া”।
সে ভেবেছিল, ফানিস বলবে, “পানি কেন খাবি দোস্ত, এত কোক আছে, একটা কোক খা”।
কিন্তু না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। ফানিস সোজা বাথরুমের দিকে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে বাথরুমে বেসিন আছে ওখান থাইক্যা পানি খাইয়া ল। দেখিস, ফ্লোরে পানি ফেলবি না যেন”।
মহিরুল যেন কোক টোক একেবারেই পছন্দ করেনা এমন ভাব নিয়ে মিথ্যামিথ্যি পানি খাওয়ার ভান করে বাথরুমের দিকে যায়। তারপর বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে বলে আজ তাহলে যাইরে দোস্ত।
“হ, যা, আবার অন্যদিন আসিস”।
মহিরুল পায়ে পায়ে হেঁটে জাহাজ থেকে নামে, তারপর এগোয় আগ্রাবাদের দিকে।
ক্যানের কোক খাওয়ার শখ তার অনেক দিনের। দামী দামী রেস্টুরেন্টে বা সী বীচে ক্যানের কোক বিক্রি হতে দেখেছে সে। একবার কিনতেও চেয়েছিল একটা ক্যান। কিন্তু দোকানদার গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে আর একবার কোকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ এটা বিদেশী কোক, একশো টাকা দাম পড়বে, দিতে পারবেন?
মহিরুলের পকেটে ছিল সর্বসাকুল্যে তের টাকা। সে লজ্জায় দোকানের সামনে থেকে পালিয়ে এসেছিল। আশেপাশেই কয়েকজন প্রেমিক তাদের প্রেমিকাকে ক্যানের কোক খাওয়াচ্ছে। সেদিকে বেশী না তাকিয়ে পাশের ফুটপাথের দোকান থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা বোতলের কোক কিনে খেয়েছিল। বোতলের কোকই ভাল। বোতলটাও কেমন জিরো ফিগার মেয়েদের মত কোমরটা চিকন, উপর নীচ মোটা। ৩৬ – ২৪ – ৩৬। হাতে নিয়ে চুমুক দিলে মনে হয় বান্ধবীর কোমর চেপে ধরে মুখে চুমু দেয়া হচ্ছে।
তবে আজকের কথা আলাদা। আজ তার পকেটে ১০০ টাকা হয়ে যাবে, নোট আর খুচরা মিলিয়ে। টাকার অভাবে এতদিন ক্যানের কোক খাওয়া হয়নি। আজ হবে।
ফানিস যে অপমান তাকে করেছে তার প্রতিশোধ নিতেই হবে। কক্সি মার্কেটে গিয়ে কনফেকশনারীর দোকানে ঢুকে একটা ঠাণ্ডা ক্যানের কোকের অর্ডার দিল মহিরুল। দোকানদার তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “একশো টাকা দাম লাগবে, কিনবেন?
মহিরুল দামের তোয়াক্কা করেনা আজ। অর্ডার দেয়। আর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কোন মেয়ে তার কোক কেনা দেখছে কি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ রাত ৩:৩১